কারিগরি ক্ষতিতে গ্যাস অপচয় বৃদ্ধি

তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) উচ্চ মূল্যে আমদানি করেও চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। একই সময়, কারিগরি ক্ষতির (সিস্টেম লস) কারণে গ্যাস অপচয় বাড়ছে। অবৈধ সংযোগ, অনুমোদিত সীমার চেয়ে বেশি ব্যবহার এবং পাইপলাইনে ছিদ্র (লিকেজ) হওয়ার কারণে এই অপচয় ঘটছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানির ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা এবং অদক্ষতার কারণে এই সমস্যা তীব্র হচ্ছে।

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে কারিগরি ক্ষতির নামে গ্যাসের অপচয় হয়েছে ১৩৭ কোটি ঘনমিটার। প্রতি ইউনিট (ঘনমিটার) এলএনজি আমদানি ও সরবরাহে পেট্রোবাংলার খরচ ৭৯ টাকা ৩৪ পয়সা। এ হিসাবে গ্যাস অপচয়ের কারণে ক্ষতি হয়েছে ১০ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা।

আগের বছরের তুলনায় গত বছর কারিগরি ক্ষতি কিছুটা কমেছিল। চলতি অর্থবছরে ক্ষতি আবার বেড়েছে। ২০২২–২৩ অর্থবছরে গ্যাস অপচয় হয়েছে ২৬৪ কোটি ঘনমিটার, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২৩৯ কোটি ঘনমিটার। এ বছর ক্ষতি ৩০০ কোটি ঘনমিটারের কাছে পৌঁছাতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

বিইআরসির কর্মকর্তা ও জ্বালানিবিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাইপলাইন ও সঞ্চালন লাইনে গ্যাস বের হওয়ার কথা নয়। তবে গ্যাস বিতরণ পাইপলাইনে নানা কারণে ছিদ্র হতে পারে। আন্তর্জাতিক মান অনুসারে এতে সর্বোচ্চ শূন্য দশমিক ২০ থেকে শূন্য দশমিক ৩০ শতাংশ গ্যাস অপচয় হতে পারে। অথচ দেশে সঞ্চালন ও বিতরণ—দুই লাইনেই গ্যাসের অপচয় হচ্ছে।

পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, কারিগরি ক্ষতি কমাতে এলাকা ভাগ করে কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বিতরণ কোম্পানির কাছ থেকে মাসওয়ারি ক্ষতি কমানোর লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। অবৈধ ব্যবহার রোধে অভিযান জোরদার করা হয়েছে।

বাখরাবাদ ও তিতাসের গ্যাস অপচয় বেশি

গ্যাসক্ষেত্র ও এলএনজি টার্মিনাল থেকে বিতরণ সংস্থাকে গ্যাস সরবরাহ করে গ্যাস ট্রান্সমিশন পিএলসি লিমিটেড (জিটিসিএল)। ২০২০-২১ অর্থবছরে তাদের কারিগরি ক্ষতি ছিল ১ শতাংশের কম। ২০২১-২২ অর্থবছরে ক্ষতি প্রথমবারের মতো ১ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। পরের বছর থেকে অপচয় ৩ শতাংশের বেশি। বিতরণ খাতের কারিগরি ক্ষতির একটা অংশ তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে দাবি করেন জিটিসিএল কর্মকর্তারা।

গ্রাহকের কাছে গ্যাস সরবরাহ করে ছয়টি বিতরণ সংস্থা। এর মধ্যে খুলনা-বরিশাল এলাকার সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি ও সিরাজগঞ্জ-বগুড়া অঞ্চলের পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানির কারিগরি ক্ষতি নেই। সিলেটের জালালাবাদ গ্যাস কোম্পানির কারিগরি ক্ষতি ১ শতাংশের নিচে।

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী গ্যাস কোম্পানির কারিগরি ক্ষতি গত বছর ৩.২১ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩.৮৫ শতাংশ হয়েছে। কুমিল্লা অঞ্চলের বাখরাবাদ গ্যাস কোম্পানির ক্ষতি গত বছর ১০ শতাংশের বেশি ছিল, এবছরও তা অব্যাহত রয়েছে। রাজধানী, গাজীপুর, ময়মনসিংহ ও নারায়ণগঞ্জে গ্যাস সরবরাহকারী তিতাস গ্যাস কোম্পানির ক্ষতি গত বছর ছিল ৭.৬৭ শতাংশ, এবার বেড়ে হয়েছে ১০.২১ শতাংশ। ছয়টি বিতরণ সংস্থা বলছে, অবৈধ সংযোগ, পুরোনো পাইপলাইন এবং নির্মাণকাজের সময় পাইপলাইনে ছিদ্র হওয়ার কারণে গ্যাস অপচয় হচ্ছে। অবৈধ সংযোগ বন্ধ করতে তিতাসের অভিযান চালানো সত্ত্বেও অপচয় কমানো যাচ্ছে না।

এ বিষয়ে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহনেওয়াজ পারভেজ বলেন, পুরোনো পাইপলাইনে ছিদ্র আছে। সরবরাহ বাড়লে অপচয়ও বাড়ে। আবার অবৈধ ব্যবহার হচ্ছে, শিল্পেও এটি হচ্ছে। অবৈধ সংযোগের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করা হয়েছে, এটি নিয়মিত চলছে। শিগগিরই গ্যাসের অপচয় কমবে।

প্রকৃত অপচয় আরও বেশি

তিতাস সূত্র বলছে, প্রতি মাসে গড়ে ৭০০–এর বেশি অভিযোগ আসে। এর মধ্যে পাঁচ শতাধিক গ্যাস লিকেজের অভিযোগ। গত অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ৯ হাজার ১৯১টি অভিযোগ এসেছে, যার মধ্যে গ্যাস লিকেজের অভিযোগ ৫ হাজার ৭৯৬টি।জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ বলছে, ছিদ্র শনাক্ত করার কাজটি চট্টগ্রামে শুরু হয়েছে। ধাপে ধাপে অন্য বিতরণ কোম্পানিও করবে। বিশেষ করে কর্ণফুলী, তিতাস ও জালালাবাদ কোম্পানি বেশ পুরোনো পাইপলাইন দিয়ে গ্যাস বিতরণ করছে।

গৃহস্থালি রান্নায় ব্যবহৃত দুই চুলায় একজন গ্রাহক মাসে গড়ে সর্বোচ্চ ৫০ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহার করেন। কিন্তু গ্রাহককে ৭৮ ঘনমিটার ধরে ৯৭৫ টাকা বিল দিতে হয়। অর্থাৎ, প্রতি গ্রাহক থেকে ২৮ ঘনমিটার গ্যাসের দাম বাড়তি নেয় বিতরণ কোম্পানি। প্রায় ৪০ লাখ গ্রাহকের কাছ থেকে এভাবে বাড়তি বিল নেওয়া হচ্ছে। এই বাড়তি আয়ের টাকা কারিগরি ক্ষতির সঙ্গে সমন্বয় করা হয়। একইসাথে, শিল্পমালিকরা অভিযোগ করছেন যে, ইলেকট্রনিক ভলিউম ক্যারেক্টার (ইভিসি) মিটার বসালে শিল্পে গ্যাস বিল কমে যাবে। কিন্তু বিতরণ কোম্পানি ইভিসি মিটার সরবরাহ করছে না, কারণ এটি কারিগরি অপচয়ের সংখ্যা কমিয়ে দেবে এবং অপচয় চাপা দেওয়ার সুযোগ থাকবে না। পেট্রোবাংলা অপচয় কমাতে না পেরে শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেন, গ্যাসের প্রকৃত অপচয় আরও বেশি। আবাসিক গ্রাহকেরা মিটারের আওতায় এলে এটি বেড়ে যাবে। কারিগরি ক্ষতির দায় ভোক্তার ওপর চাপানো অন্যায় ও জ্বালানি সুবিচারের পরিপন্থী।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!