কসমেটিকস আমদানিতে জালিয়াতি, চলছে রাজস্ব ফাঁকি

বেনাপোল কাস্টম হাউস

** দুই বছরে বেনাপোলে কসমেটিকস আমদানিতে প্রায় শত কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ
** বন্দরের ৩০ নাম্বার শেডে অন্য পণ্যের সঙ্গে লুকিয়ে কসমেটিকস পণ্য ডেলিভারির অভিযোগ
** বন্দর ও কাস্টমসের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে ঘুস দিয়ে ওজন কম দেখিয়ে খালাস নেয়া হচ্ছে

ঢাকার আমদানিকারক আরগাস মেটাল প্রাইভেট লিমিটেড। ৬ ফেব্রুয়ারি ভারত থেকে ৬১১ প্যাকেজ কসমেটিকসসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানি করেছে। প্রতিষ্ঠানের আমদানি করা পণ্যের প্যাকিংলিস্টে ৭০০ কেজি পণ্য বেশি ছিলো। কিন্তু ইনভয়েসে ৭০০ কেজি কম দেখানো হয়েছে। আবার গ্রস ওয়েট ৩০০ কেজি বেশি দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি জালিয়াতি করে প্যাকিংলিস্ট তৈরি করেছে। একই আমদানিকারক ১ মার্চ ২৩৪ প্যাকেজ কসমেটিকস পণ্য আমদানি করেছে। যার প্যাকিংলিস্টে ৪০ কেজি পণ্য বেশি, কিন্তু ইনভয়েসে ৪০ কেজি কম দেখানো হয়েছে। আবার গ্রস ওয়েট ৮৬৬ কেজি পণ্য বেশি দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ এই চালানেও ভুয়া প্যাকিংলিস্ট বা ইনভয়েস তৈরি করে পণ্য খালাস নেয়া হয়েছে।

শুধু এই আরগাস মেটাল নয়, বহু প্রতিষ্ঠান প্যাকিংলিস্ট বা ইনভয়েস জালিয়াতির মাধ্যমে বেনাপোল কাস্টম হাউস দিয়ে ভারত থেকে কসমেটিকস পণ্য আমদানি করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। গত দুই বছরে কেবল কসমেটিকস আমদানিতে আমদানিকারক ও সিএন্ডএফ এজেন্টের যোগসাজসে প্রায় শত কোটি টাকার শুল্ককর ফাঁকি দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), কাস্টমস গোয়েন্দাসহ বিভিন্ন জায়গায় কয়েকটি লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়েছে। অভিযোগের সঙ্গে জালিয়াতি করা বিল অব এন্ট্রিসহ জালিয়াতির প্রমাণাদি দেয়া হয়েছে। এনবিআর সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

সূত্রমতে, কসমেটিকস পণ্য আমদানিতে বিশেষ করে ক্রিম আমদানিতে মোট শুল্ককর ১৫৭ দশমিক ৩০ শতাংশ, ফ্রেশওয়াস, সাবান এর মোট শুল্ককর ১২৭ দশমিক ৭২ শতাংশ, শ্যাম্পু, হেয়ার কালার ১৮৩ দশমিক ৪০ শতাংশ, বডি স্প্রে, শেভিং ক্রিম ১৩১ দশমিক ২০ শতাংশ। কসমেটিকস পণ্য আমদানিতে শুল্ককর বেশি হওয়ায় কিছু আমদানিকারক ও সিএন্ডএফ এজেন্ট যোজসাজস করে শুল্ককর ফাঁকি দিয়ে আসছে। এতে কাস্টমসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা সহযোগিতা করে আসছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কখনো এক পণ্য অন্য এইচএস কোডে দেখিয়ে, আবার কখনো পণ্যের ওজন কম দেখিয়ে, কখনো প্যাকিংলিস্ট বা ইনভয়েস জালিয়াতির মাধ্যমে পণ্য খালাস নেয়া হচ্ছে। বেনাপোল কাস্টম হাউস দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে জালিয়াতির মাধ্যমে কসমেটিকস পণ্য খালাস নেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

অভিযোগে বলা হয়েছে, ঢাকার আমদানিকারক ইয়াফি এন্টারপ্রাইজ। ২০২২ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারত থেকে ১৮১ প্যাকেজ কসমেটিকস পণ্য আমদানি করেছে। এই চালানে প্যাকিংলিস্টে ১ হাজার ১৭০ কেজি বেশি দেখানো আছে। কিন্তু প্যাকিংলিস্টে ১ হাজার ১৭০ কেজি কম দেখানো হয়েছে। একই আমদানিকারক ১৮১ প্যাকেজ কসমেটিকস পণ্য আমদানি করেছে। যাতে এক হাজার ১৫০ কেজি প্যাকিংলিস্টে গ্রস ওয়েট বেশি দেখানো হয়েছে। কিন্তু প্যাকিংলিস্ট যোগ করলে এক হাজার ১৫০ কেজি কম হবে। একইভাবে ঢাকার আমদানিকারক এ আর ট্রেডিং ২১১ প্যাকেজ কসমেটিকস পণ্য আমদানি করেছে। প্রতিষ্ঠানটি প্যাকিংলিস্টে ৭৮০ কেজি বেশি দেখালেও, কিন্তু ইনভয়েসে ৭৮০ কেজি কম দেখিয়েছে। আমদানিকারক মেসার্স আরএম এন্টারপ্রাইজ। প্রতিষ্ঠানটি ভারত থেকে ৭৭৮ প্যাকেজ বিভিন্ন কসমেটিকস পণ্য আমদানি করেছে। ইনভয়েসে ২০০ কেজি ফ্রেশওয়াস ও ২০০ কেজি হেয়ার কালার কম দেখিয়েছে। গ্রস ওয়েট ১ হাজার ১০০ কেজি বেশি দেখানো হলেও প্যাকিংলিস্টে যোগ করলে ১ হাজার ১০০ কেজি কম হবে। আমদানিকারক হাজী এন্টারপ্রাইজ। প্রতিষ্ঠানটি ভারত থেকে ১৮৯ প্যাকেজ কসমেটিকস আমদানি করেছে। প্যাকিংলিস্টে গ্রস ওয়েট ৭৪৬ কেজি বেশি দেখানো হলেও প্যাকিংলিস্ট যোগ করলে ৭৪৬ কেজি কসমেটিকস কম হবে। আমদানিকারক এইচ কে ইন্টারন্যাশনাল। প্রতিষ্ঠানটি ১৬৮ প্যাকেজ কসমেটিকস আমদানি করেছে। প্যাকিংলিস্টে গ্রস ওয়েট ৯২৫ কেজি বেশি দেখানো হয়েছে। কিন্তু প্যাকিংলিস্ট যোগ করলে ৯২৫ কেজি কম হবে। আমদানিকারক মেসার্স আর এম এন্টারপ্রাইজ। ১৭৯ প্যাকেজ কসমেটিকস পণ্য আমদানি করেছে। যাতে প্যাকিংলিস্টে ১ হাজার ৯৫ কেজি বেশি দেখানো হলেও প্যাকিংলিস্ট যোগ করলে ১ হাজার ৯৫ কেজি কম হবে। আমদানিকারক মেসার্স রাইসা ট্রেডার্স। প্রতিষ্ঠানটি ২৪৪ প্যাকেজ কসমেটিকস পণ্য আমদানি করেছে। প্যাকিংলিস্টে গ্রস ওয়েট ৪৮৫ কেজি বেশি দেখানো হলেও প্যাকিংলিস্ট যোগ করলে ৪৮৫ কেজি পণ্য কম হবে।

আরো অভিযোগ করা হয়েছে, খুলনার পুরবী ট্রেডিং, ঢাকার আরগাস মেটাল প্রাইভেট লিমিটেড ও এম জেড ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিমিটেড। তিনটি প্রতিষ্ঠান ২২২ প্যাকেজ, ২২৯ প্যাকেজ ও ১৯৩ প্যাকেজ কসমেটিকস পণ্য আমদানি করেছে। প্যাকিংলিস্টে গ্রস ওয়েট যোগ করলে ১৪ হাজার ২৩০ কেজি, ১৩ হাজার ৬৮৪ কেজি ও ১০ হাজার ৮৩৬ কেজি দেখানো হয়েছে। কিন্তু প্যাকিংলিস্ট যোগ করলে পাওয়া যায় ১৩ হাজার ১০৫ কেজি, ১২ হাজার ৫৮৪ কেজি ও ৯ হাজার ৭৩৬ কেজি। অর্থাৎ প্যাকিংলিস্টে ১ হাজার ১২৫ কেজি, ১ হাজার ১০০ কেজি ও ১ হাজার ১০০ কেজি পণ্য বেশি দেখানো হয়েছে। ওয়েস্ট স্কেলে ওয়েট করে গ্রস ওয়েট ১৪ হাজার ৩০০ কেজি, ১৩ হাজার ৮০০ কেজি ও ১০ হাজার ৯০০ কেজি পাওয়া যায়। অর্থাৎ প্যাকিংলিস্টে যোগফল অনুযায়ী ৩ হাজার ৩২৫ কেজি পণ্য বেশি দেখানো হয়েছে। মূলত প্যাকিংলিস্ট বা ইনভয়েস জালিয়াতির মাধ্যমে এই পণ্য কম বেশি দেখিয়ে খালাস নেয়া হয়েছে। আমদানিকারক সিএন্ডএফ এজেন্টের সহায়তায় গত দুই বছর ধরে কসমেটিকস পণ্য খালাস নিয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। যাতে প্রায় ১০০ কোটি টাকার শুল্ককর ফাঁকি হয়েছে। অভিযোগে আরো বলা হয়, শুধু কসমেটিকস নয় প্যাকিংলিস্ট বা ইনভয়েস জালিয়াতি করে আমদানিকারক অন্যান্য পণ্যও ডেলিভারি নিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে কলম, স্টাফলারের পিন।

অভিযোগে বলা হয়েছে, কসমেটিকস পণ্যগুলো বন্দরের ৩০ নাম্বার শেডে রাখা হয়। অন্য পণ্যের সঙ্গে কসমেটিকস পণ্য লুকিয়ে রাখা হয়। অন্য পণ্যগুলো ডেলিভারির সময় কসমেটিকস এর কার্টুনগুলো লুকিয়ে ডেলিভারি করে নেয়া হয়। এতে বন্দর ও কাস্টমস এর কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে পণ্য লুকিয়ে বের করে নেয়া হয়। ইনভয়েস, প্যাকিংলিস্ট, বিল অব এন্ট্রি এবং ওয়েট স্লিপ যাচাই করলে একদিকে জালিয়াতি বের হয়ে আসছে। অন্যদিকে অন্য পণ্যের সঙ্গে কসমেটিকস পণ্য লুকিয়ে ডেলিভারি নেয়ার বিষয়টি ধরা পড়বে।

প্যাকিংলিস্ট ও ইনভয়েস জালিয়াতির বিষয়ে আমদানিকারক আরগাস মেটাল প্রাইভেট লিমিটেডের কর্মকর্তা কাকন বিশ্বাস বলেন, বাংলাদেশ অংশে ও ভারতের অংশে যাচাই হয়। ফলে জালিয়াতির সুযোগ নেই। ওজনে কম বেশি আমরা করতে পারি না। শেড থেকে পণ্য বের করে নেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত আমরা এ ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হইনি। আমরা এই বিজনেস নতুন শুরু করেছি। মাত্র তিনটি কসমেটিকস এর চালান আমদানি করেছি। আমরা ঘোষণার অতিরিক্ত পণ্য খালাস করিনি।

প্যাকিংলিষ্ট ও ইনভয়েস জালিয়াতির বিষয়টি অস্বীকার করেন বেনাপোল কাস্টম হাউসের কমিশনার মো. আবদুল হাকিম। তিনি বলেন, পাকিংলিস্ট ও ইনভয়েস জালিয়াতির বিষয় জানা নেই। তবে এইচএস কোড মিসডিক্লারেশন আমরা কায়িক পরীক্ষা করে ট্যাক্স ফাঁকি পেয়েছি। এই নিয়ে আমাদের সকলের কাজ করা উচিত। এই ধরনের অভিযোগ থাকলে শুল্ক গোয়েন্দা, সিআইসি বা যেকোনো গোয়েন্দা সংস্থা খতিয়ে দেখতে পারে। তবে কারো কাছে এই ধরনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এবং এর সত্যতা থাকলে আমাদের দিয়ে সহযোগিতা করার আহ্বান জানান তিনি।

বেনাপোল কাস্টম হাউসের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, শুল্ককর ফাঁকি রোধে অবিরাম চেষ্টা করছে কাস্টম হাউস। শুল্ক ফাঁকির অভিযোগে অনেক প্রতিষ্ঠানের সিঅ্যান্ডএফ লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। মিথ্যা ঘোষণায় যেসব পণ্য আমদানি করা হচ্ছে তাদের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের লাইসেন্স সাময়িক বাতিল ও পণ্যগুলো বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে। রাজস্ব ফাঁকি রোধে জিরো টলারেন্স ভূমিকা গ্রহণ করেছে। বন্দরে রাতে কাস্টমসের একাধিক মোবাইল টিম কাজ করছে। অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ অব্যাহত রয়েছে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!