কর পরিদর্শক সাইফুল: ১৮ বছরে বৈধ আয় ৪৩ লাখ, মালিক অর্ধ-শত কোটি টাকার

** সাইফুলের বাড়ি পাবনা, কিন্তু চাকরি নিতে ময়মনসিংহের স্থায়ী ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করেছেন
** গৃহিণী স্ত্রীকে গরুর খামারি ও মৎস্য ব্যবসায়ী দেখিয়ে দুর্নীতির টাকা গোপনের চেষ্টা
** গ্রামের বাড়িতে আলিশান বাড়ি, ব্যাংকে সঞ্চয়পত্র, ধানমন্ডি ও মোহাম্মদডুরে কেনেন তিন আলিশান ফ্ল্যাট
** দুর্নীতির টাকায় পাবনায় শ্বশুরের নামে গড়েছেন বহুতল ভবন, কিনেছেন জমি
** ১ সেপ্টেম্বর এনবিআর কর পরিদর্শক থেকে অতিরিক্ত সহকারী কর কমিশনার পদে পদোন্নতির জন্য যে তালিকা প্রকাশ করেছে, তালিকায় সাইফুল রয়েছে ১৫৪ নম্বরে, টাকা দিয়ে তালিকায় নাম তুলেছেন বলে অভিযোগ

ছিলেন কর অঞ্চলের ‘উচ্চমান সহকারী’। পদোন্নতি পেয়ে প্রথমে ‘প্রধান সহকারী’, পরে হয়েছেন কর পরিদর্শক। দুটি পদে পদোন্নতির সাঁকো পার করে চাকরি করছেন ১৮ বছর। এই ১৮ বছরে সরকারি বেতন-ভাতা ও সুবিধা পেয়েছেন প্রায় ৪৩ লাখ টাকা। কিন্তু তিনি এখন প্রায় অর্ধশত কোটি টাকার মালিক। এই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা হলেন কর পরিদর্শক মো. সাইফুল ইসলাম। তিনি বর্তমানে সিলেট কর অঞ্চলে কর্মরত। বাড়ি পাবনা হলেও ময়মনসিংহের ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে চাকরি নিয়েছেন। দুর্নীতি আড়াল করতে শ্বশুরের নামে গড়েছেন বহুতল আলিশান বাড়ি, কিনেছেন জমি।

রাজধানীর ধানমন্ডিতে একটি ও মোহাম্মদপুরে দুটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট রয়েছে। নিজ এলাকায় করেছেন আলিশান বাড়ি, রয়েছে কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র। স্ত্রী গৃহিণী হলেও দুর্নীতির ঢাকতে স্ত্রীকে বানিয়েছেন গরুর খামারি, মৎস্যচাষি। এছাড়া নামে-বেনামে রয়েছে কোটি টাকার সম্পদ। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধানে এই কর্মকর্তার দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে। দুদক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

দুদকের গোপন অনুসন্ধান অনুযায়ী, কর পরিদর্শক মো. সাইফুল ইসলামের বাড়ি কায়েশ কোলা, দোগাছি, সদর, পাবনায়। বর্তমানে তিনি থাকেন বাড়ি নং-১৮, রোড-৮, ব্লক-এ, চন্দ্রিমা মডেল টাউন, মোহাম্মদপুর, ঢাকায়। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সাইফুল ইসলাম নিজ জেলা পাবনা সদরের দোগাছি গ্রামে কয়েক লাখ টাকা দিয়ে আলিশান বাড়ি নির্মাণ করেছেন। তার ব্যাংকে অর্ধ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তার শ্বশুর আফজাল মাহমুদের নামেও অবৈধ আয়ে সম্পদ গড়েছেন। কর বিভাগ থেকে দুর্নীতির টাকায় শ্বশুরের নামে পাবনা জেলা সদরে একটি বহুতল বাড়ি করেছেন। কিনেছেন ১০০ শতাংশের বেশি জমি।

অনুসন্ধানে আরও দেখা গেছে, এই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার মোহাম্মদপুরে একাধিক ফ্ল্যাট থাকার অভিযোগ রয়েছে। এরই মধ্যে দুদকের গোয়েন্দা অনুসন্ধানে মোহাম্মদপুরে চন্দ্রিমা মডেল টাউনে ব্লক-এ, রোড নং-৮ ও বাড়ি নং-১৮-এ মো. সাইফুল ইসলাম ও তার স্ত্রীর নামে দুটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট থাকার সত্যতা পাওয়া গেছে। এছাড়া ধানমন্ডি এলাকার (৩/৪০ সুলতানগঞ্জে, পশ্চিম ধানমন্ডি) ফ্ল্যাটের মালিকানা রয়েছে সাইফুলের।

তথ্যমতে, কর পরিদর্শক মো. সাইফুল ইসলামের পাবনায় বাড়ি হওয়া সত্ত্বেও মিথ্যা তথ্য দিয়ে ময়মনসিংহে স্থায়ী ঠিকানা দেখিয়ে চাকরি নিয়েছেন। এই চাকরি নিতে খরচ করেছেন কয়েক লাখ টাকা। অর্থাৎ চাকরিতে প্রবেশের সময় অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে চাকরি নিয়েছেন। চাকরি নেয়ার পর থেকে দুর্নীতিতে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন সাইফুল।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, সর্বশেষ ঢাকার কর অঞ্চল-৫-এর সার্কেল-৮৯-এর কর পরিদর্শক হিসেবে ছিলেন সাইফুল। বর্তমানে তিনি সিলেটে কর্মরত। তিনি ২০০৭ সালে উচ্চমান সহকারী পদে আয়কর বিভাগে যোগ দেন। পরবর্তীকালে পদোন্নতি পেয়ে কর পরিদর্শক হয়েছেন। তার স্ত্রী আল্লিকা মাহমুদ একসময় বেসরকারি চাকরি করলেও বর্তমানে গৃহিণী। অথচ সাইফুল ইসলাম স্ত্রীকে ব্যবসায়ী সাজিয়ে লাখ লাখ টাকা আয় দেখিয়েছেন। আল্লিকা মাহমুদ তার আয়কর ফাইলে গরু মোটাতাজাকরণ ও মৎস্য ব্যবসায়ী দেখিয়ে বছরে লাখ লাখ টাকা আয় দেখিয়েছেন। বাস্তবে ওই ব্যবসার পক্ষে যথেষ্ট নথিপত্র দেখা পারেননি ওই দম্পতি। এছাড়া ব্যাংকে অস্বাভাবিক নগদ অর্থ, সঞ্চয়পত্র ও স্থায়ী আমানত রয়েছে। অর্থাৎ মাত্র ১৮ বছরে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন এই কর্মকর্তা।

সূত্রমতে, ২০০৬ সালের ৩ ডিসেম্বর উচ্চমান সহকারী হিসেবে যোগ দেন সাইফুল। ২০০৬ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১২ সালের ৩১ মে পর্যন্ত সাইফুল ইসলাম ‘উচ্চমান সহকারী’ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। অর্থাৎ ছয় বছর ছয় মাস তিনি এ পদে কর্মরত ছিলেন। জাতীয় বেতন স্কেল, ২০০৫ অনুযায়ী উচ্চমান সহকারী প্রতিমাসে পেতেন মোট ছয় হাজার ৭৪৫ টাকা। সে হিসেবে ২০০৬ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০০৯ সালের জুন পর্যন্ত তিন বছরে বেতন-ভাতা ও সুবিধা পেয়েছেন দুই লাখ ৪২ হাজার ৮২০ টাকা।

আবার জাতীয় বেতন স্কেল, ২০০৯ অনুযায়ী এ পদের মূল বেতন ছিল পাঁচ হাজার ২০০ টাকা। সে হিসেবে ২০০৯ সালের জুলাই থেকে ২০১২ মে পর্যন্ত তিন বছরে পেয়েছেন প্রায় তিন লাখ ৫৫ হাজার ৬৮০ টাকা। ২০১২ সালের ৩১ মে তিনি ‘উচ্চমান সহকারী’ থেকে ‘প্রধান সহকারী’ হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন। ২০১৭ সালের ২২ মার্চ পর্যন্ত (পাঁচ বছর বা ৬০ মাস) তিনি প্রধান সহকারী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। প্রধান সহকারী ৬০ মাসে পেয়েছেন ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৬০০ টাকা। ২০১৭ সালের ২২ মার্চ তিনি ‘কর পরিদর্শক’ হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন। কর পরিদর্শকদের প্রতিমাসে ২৭ হাজার ১০০ টাকা হিসেবে ২০১৭ সালের এপ্রিল থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত (সাড়ে আট বছর বা ১০২ মাস) পেয়েছেন ২৭ লাখ ৬৪ হাজার ২০০ টাকা।

হিসাব অনুযায়ী, চাকরিতে যোগ দেয়ার মাস থেকে অর্থাৎ ২০০৬ সালের ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত (প্রায় ১৮ বছর) হিসাব করলে তিনি সরকারি বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা পেয়েছেন প্রায় ৪২ লাখ ৯৯ হাজার টাকা। কিন্তু এই কর্মকর্তার শুধু ধানমন্ডির ফ্ল্যাটেরই দাম কয়েক কোটি টাকা।

এনবিআর সূত্রমতে, কর পরিদর্শক থেকে অতিরিক্ত সহকারী কর কমিশনার হিসেবে পদায়নের জন্য গত ১ সেপ্টেম্বর ৮০৬ জন কর পরিদর্শকের জ্যেষ্ঠতার তালিকা প্রকাশ করে এনবিআর। তালিকায় ১৫৪ নম্বরে মো. সাইফুল ইসলামের নাম রয়েছে। ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে চাকরি নিয়েছেন এই কর্মকর্তা। এছাড়া দুদক এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির সত্যতা পেয়েছে। দুর্নীতি ও অনিয়ম করলেও পদোন্নতির জন্য এই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে তালিকার মোটামুটি শীর্ষে রাখা হয়েছে। তবে অনিয়ম ও লেনদেনের মাধ্যমে তিনি তালিকায় স্থান পেয়েছেন কি না, তা খতিয়ে দেখার অনুরোধ জানিয়েছেন একাধিক কর কর্মকর্তা।

অন্যদিকে কর পরিদর্শক মো. সাইফুল ইসলাম বর্তমানে সিলেট কর অঞ্চলে কর্মরত। দুর্নীতি ও অনিয়ম করে টাকা আয় এবং অবৈধ সম্পদের বিষয়ে জানতে তাকে একাধিকবার ফোন করা হয়েছে। বক্তব্যের বিষয় জানিয়ে মোবাইল ফোনে খুদে বার্তা পাঠানো হয়েছে। তিনি রিসিভ করলেও খুদে বার্তার জবাব দেননি। গতকাল সোমবার একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে তিনি ফোন বন্ধ করে দেন।

এ বিষয়ে দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অনুসন্ধান পর্যায়ে বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর, পুঁজিবাজার, রাজউক, সিটি করপোরেশন, ভূমি অফিস ও সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের নথিপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে।

যতটুকু যাচাই করা সম্ভব হয়েছে, তাতে অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। এছাড়া সাইফুল ইসলাম ও তার স্ত্রীর নামে থাকা সম্পদের যে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে তা সন্তোষজনক নয়। ছোট একটি চাকরি করে ঢাকায় তিনটি ফ্ল্যাটের মালিক হওয়া অসম্ভব। ঢাকার বাইরে রয়েছে অঢেল সম্পদ। এর বাইরে ব্যাংকে অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য রয়েছে। অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। তবে আপাতত মামলা করার মতো যথেষ্ট প্রমাণ দুদকের হাতে রয়েছে বলে জানিয়েছেন এই কর্মকর্তা।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!