করোনা-ডেঙ্গুর ভিড়ে চিকুনগুনিয়ার হুমকি

বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আবারও বাড়তে শুরু করেছে। একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশেও—নতুন উপধরনে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। এরমধ্যে গত ২১ জুন একদিনেই দেশে করোনায় পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে, যা চলতি সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ। একই সঙ্গে ডেঙ্গুর প্রকোপও বাড়ছে—চলতি বছর এ পর্যন্ত ৩৮ জনের মৃত্যু হয়েছে, যার বেশির ভাগই রাজধানীর বাইরের, বিশেষ করে বরিশাল বিভাগে। এ অবস্থায় মশাবাহিত আরেক রোগ, চিকুনগুনিয়ার ফিরে আসার সম্ভাবনায় উদ্বেগ প্রকাশ করছেন জনস্বাস্থ্যবিদ ও বিজ্ঞানীরা। আইসিডিডিআরবির তথ্য অনুযায়ী, চলতি মাসে সংগৃহীত রক্তের নমুনার মধ্যে ৮২ শতাংশেই চিকুনগুনিয়ার উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে।

বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টদের মতে, করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার সংক্রমণ একসঙ্গে বাড়তে থাকলে তা গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে। এই সম্ভাব্য সংকট মোকাবিলায় এখনই হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। বিশেষ করে কমিউনিটি ক্লিনিক ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে করোনা ও ডেঙ্গু শনাক্তে পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি, প্রয়োজন হলে সব স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আলাদা অবজারভেশন ওয়ার্ড চালুর তাগিদও দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনগুলোকে ‘সততার সঙ্গে’ মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। সেইসঙ্গে এ বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়ানো জরুরি। তারা আরও বলেন, গত ৫ জুন দেড় বছরের বেশি সময় পর দেশে কোভিড-১৯–এ একজনের মৃত্যু জনমনে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে। এই মৃত্যু বর্তমান করোনা পরিস্থিতি নিয়ে নাগরিকদের ভাবিয়ে তুলেছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২৬ জুন পর্যন্ত দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৫১৮ জন এবং মারা গেছেন ১৯ জন। অধিদপ্তর জানিয়েছে, এবার দেশে করোনাভাইরাসের কয়েকটি নতুন ধরন শনাক্ত হয়েছে। একই সঙ্গে থাইল্যান্ড, চীন ও পার্শ্ববর্তী ভারতেও নতুন ভ্যারিয়েন্ট দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে বলে খবর মিলেছে।

এমন অবস্থায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা অনুরোধ করেছে, জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ভারতসহ ভাইরাসপ্রবণ দেশগুলোতে ভ্রমণ এড়িয়ে চলতে। একই সঙ্গে সব স্থল ও বিমানবন্দরে হেলথ স্ক্রিনিং ও নজরদারি জোরদারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, গত ২৫ জুন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দেশে আরও দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। চলতি বছর এ রোগে মোট ৩৮ জনের মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে জুন মাসেই মারা গেছেন ১৫ জন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) প্রকাশিত বুলেটিনে জানানো হয়েছে, চলতি বছর দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ৯ হাজার ৬৫ জন। তবে যারা হাসপাতালে যাননি বা পরীক্ষাই করাননি, তারা এই পরিসংখ্যানে অন্তর্ভুক্ত নন। এর মধ্যেই মশাবাহিত আরেক রোগ চিকুনগুনিয়ার ফিরে আসার আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞানী ও জনস্বাস্থ্যবিদরা। সাধারণত বর্ষা শেষের দিকে এই রোগের বিস্তার বাড়ে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যেকোনো মহামারি প্রতিরোধে যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি জরুরি। বর্তমানে করোনা ও ডেঙ্গুর সম্ভাব্য মহামারির প্রেক্ষাপটে এখনই কঠোর প্রস্তুতি নেওয়ার সময়—এখনই এর বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, যেকোনো মহামারি মোকাবিলায় প্রয়োজন যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি ও সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ। তিনি মনে করেন, করোনা ও ডেঙ্গুর বিস্তার যে হারে বাড়ছে, তা মহামারিতে রূপ নিতে পারে—তাই এখনই কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। তার মতে, মশা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই ডেঙ্গুর পাশাপাশি চিকুনগুনিয়ার বিস্তারও রোধ করা সম্ভব। তিনি বলেন, স্থানীয় সরকার, পৌরসভা এবং সিটি করপোরেশনগুলোকে মশা নিধনের কার্যক্রম যথাযথভাবে ও সততার সঙ্গে পরিচালনা করতে হবে। মশার বংশবিস্তার ঠেকাতে সবচেয়ে জরুরি হলো—কোথাও তিন দিনের বেশি পানি জমে থাকতে না দেওয়া। পাশাপাশি সপ্তাহে অন্তত দুই দিন চিহ্নিত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় ফগিং চালাতে হবে, যাতে সময়মতো নিয়ন্ত্রণে আনা যায়।

করোনা সংক্রমণ রোধে মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন ডা. নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ভাইরাসটি নাক ও মুখ দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে, তাই বারবার হাত ধোয়া এবং মাস্ক পরা অত্যন্ত জরুরি।’ তার মতে, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে আগ্রহী হলেও প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে এ বিষয়ে উদাসীনতা দেখা যায়, যা বদলাতে হবে । হাসপাতালগুলোর প্রস্তুতির বিষয়ে তিনি বলেন, প্রতিটি হাসপাতালে আলাদা পর্যবেক্ষণ (অবজারভেশন) ওয়ার্ড থাকা উচিত। যেখানে রোগীর অবস্থার অবনতি হলে চিকিৎসা সুবিধা দেওয়া হবে, আর ভালো থাকলে নির্দিষ্ট সময় পর তাকে বাসায় পাঠানো যাবে। তিনি মনে করেন, কোভিড ও ডেঙ্গু উভয় ক্ষেত্রেই এই ব্যবস্থা কার্যকর। তিনি আরও বলেন, ‘কোভিড মোকাবিলার পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতাগুলো কাজে লাগাতে হবে। কারণ এটি কেবল একটি রোগ নয়, এটি জীবন-মৃত্যুর বিষয়।’

আইসিডিডিআরবি জানিয়েছে, চলতি বছরে করোনার সংক্রমণ বাড়ার মূল কারণ হলো নতুন দুটি সাব-ভ্যারিয়েন্ট এক্সএফজি ও এক্সএফসি, যা ওমিক্রন জেএন.১-এর উপ-শাখা। এই ভ্যারিয়েন্টগুলো সংক্রমণ ক্ষমতায় বেশি শক্তিশালী। তাই স্বাস্থ্যবিধি না মানলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!