জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেছেন, ব্যক্তি কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে কর ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা রয়েছে। তবে এখন থেকে করফাঁকি দিয়ে কেউই রেহাই পাবে না। তিনি বলেন, সরকারি কর্মচারী বিশেষ করে আমলারা গত ১৫-২০ বছরে অবৈধভাবে বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছেন। এ রকম শত শত লোক রয়েছে। আগের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে এনবিআর ও সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি) এদের বিষয়ে ব্যাপক কাজ করেছিল। এবারও আমরা সে বিষয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ।
গতকাল সোমবার আগারগাঁওয়ে এনবিআরে ই-রিটার্ন (ইলেক্ট্রনিক ট্যাক্স রিটার্ন) সার্ভিস সেন্টার উদ্বোধন করার সময়ে তিনি এসব কথা বলেন। পাবলিক ফাইন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামের আওতায় বাংলাদেশে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সহায়তায় নাগরিকদের জন্য কর জমা দেওয়ার প্রক্রিয়া সহজ করতে এনবিআরের বৃহত্তর লক্ষ্যের অংশ হিসেবে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ইইউ এর হেড অব কোঅপারেশন মিশেল ক্রেজা উপস্থিত ছিলেন।
এক প্রশ্নের জবাবে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, এনবিআর হাতগুটিয়ে নেই। সময় তো সবে মাত্র শুরু। শুরু করতে কিছু সময় লাগে, যেটা বাইরে থেকে দেখা যায় না। নিশ্চয়ই বৈষম্যহীন ও দুর্নীতিমুক্ত যে বাংলাদেশ গড়তে চাই, সবাইকে নিয়ে আমরা সেই কাজটি করতে চাই। এটা করতে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ। এ জন্য সময় লাগবে। গ্রুপ কোম্পানির কর ফাঁকির তদন্তের কাজ শুরু হয়েছে। এগুলো বৃহৎ করদাতা ইউনিট তদন্ত করছে। সিআইসির সক্ষমতা অনুযায়ী করা হচ্ছে। এবং পর্যায়ক্রমে এগুলো শেষ করা হবে। সব কাজ এক সঙ্গে কাজ শুরু করলে এর কোনোটাই শেষ করা যাবে না। যেসব করদাতা সম্পর্কে গণমাধ্যমে আলোচনা আছে বা গোয়েন্দাদের মাধ্যমে আমরা তথ্য পাচ্ছি তদন্তের ক্ষেত্রে আমরা সেগুলো অগ্রাধিকার দিচ্ছি। কর্পোরেট করদাতাদের ক্ষেত্রে আমরা একই পদ্ধতি অনুসরণ করছি।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে আবদুর রহমান খান বলেন, কালো টাকা সাদা করার আইন বাতিল করা হয়েছে। এই আইন বাতিল করার আগে কোনো ব্যক্তি কালো টাকা সাদা করার সুযোগ নিয়ে থাকলে সেটা আইনের বলেই নিয়েছে সেটা বৈধ। তার কোনো সমস্যা নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত আইনটি বহাল ছিল ততক্ষণ পর্যন্ত সেটা লিগ্যাল। সরকারি কর্মকর্তারা যখন আয়কর রিটার্ন দেয় সেগুলো অডিট করা হয় তারপর সেগুলো অ্যাসেসমেন্ট করা করা হচ্ছে। সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এটা নিয়ে কাজ করে। সক্ষমতা অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে করা হয়।
এনবিআরের মাঠ পর্যায় থেকে ট্যাক্স অডিট ফাইল পাঠানো নিষেধ করা হয়েছে-এটা কেনো-সাংবাদিকদের এমন এক প্রশ্নের জবাবে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, আমাদের একটা ইমেজ সংকট রয়েছে, ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে ফাইলগুলো ঠিক করি, এগুলো সঠিক হয় না। এ বিষয়ে করদাতাদের কাছে থেকে অভিযোগ আমরা পেয়ে থাকি। এ জন্য আমরা ডিজিটাল পদ্ধতিতে অডিট সিলেকশন করতে চাই। যাতে করদাতাদের মনে সন্দেহ তৈরি না হয়। সে লক্ষ্যে আমরা কাজ শুরু করেছি। তিনি বলেন, যারা কর ফাঁকি দিয়েছে তাদের বের করব এবং আইনানুগ ব্যবস্থা নেব। আয়করের করমুক্ত সীমা বৃদ্ধি করলে করদাতারা বাইরে পড়ে যায় উল্লেখ করে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, আর্থিক সক্ষমতা, মূল্যষ্ফীতি ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিবেচনা করে করমুক্ত আয়সীমা নির্ধারণ করা হয়। যাতে যাদের কম সক্ষমতা কম, তারা কম কর দেবেন। আর যাদের সক্ষমতা বেশি তারা বেশি কর দেবেন। সবাই জাতি গঠনে ভূমিকা রাখবেন।
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, মামলা জটিলতার কারণে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আটকে আছে। এই মামলা জটিলতা দূর করতে কাজ করা হচ্ছে। হাইকোর্টে ভিন্ন বেঞ্চ হয়েছে, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) কাজ করছে। উভয় পক্ষের জেতার মানসিকতার কারণে মানুষ এডিআরে যেতে চাচ্ছে না। রাজস্ব বিরোধ মীমাংসা ক্ষেত্রে এডিআর ভালো ক্ষেত্র। কিন্তু উভয় পক্ষের আমারটা চাই-এর মানসিকার কারণে এটা কার্যকর হচ্ছে।
অপরদিকে, বাংলাদেশে অনলাইন ট্যাক্স রিটার্ন দাখিলের সংখ্যা চলতি অর্থবছরে ১৫ লাখে উন্নীত হবে বলে আশা করছেন ইইউর হেড অব কোঅপারেশন মিশেল ক্রেজা, যা গত বছর ৫ লাখ ছিল। ই-রিটার্ন সেবা কেন্দ্রের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ক্রেজা বলেন, ‘আমরা আশা করি, এই সেবাকেন্দ্র ব্যবহারকারী এবং ইলেকট্রনিক ট্যাক্স রিটার্ন দাখিলের সংখ্যা দ্রুত বাড়বে।’ ক্রেজা বলেন, গত বছর মাত্র ৫ লাখ মানুষ ই-রিটার্ন দাখিল করেছিলেন। এবার সংখ্যাটি ১০ থেকে ১৫ লাখ ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এটি হলে ‘অসাধারণ’ হবে। বাংলাদেশের আর্থিক সংস্কারে দীর্ঘদিনের অংশীদার ইইউ এবং এই সহযোগিতা দেশের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে চাবিকাঠি।
এনবিআর চেয়ারম্যানের দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গির প্রশংসা করে তিনি বলেন, ‘এখন আমরা সংস্কারের সুযোগের ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ পথ দেখতে পাচ্ছি। এই সংস্কার বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ভবিষ্যতের অগ্রগতির অর্থায়নের জন্য প্রয়োজনীয় রাজস্ব সুরক্ষিত করতে এনবিআরই প্রধান মাধ্যম। দুই থেকে তিন বছর ধরে চলমান এই সেবাকেন্দ্র সম্প্রতি এনবিআর ভবনে স্থানান্তরিত হয়েছে। এই কেন্দ্রে ই-রিটার্ন সিস্টেম ব্যবহার করে করদাতাদের সরাসরি সহায়তা দেওয়া হয় যাতে কর জমা দেওয়ার প্রক্রিয়াটি সহজ এবং আরও সফলভাবে সম্পন্ন হয়। ইইউ ও এনবিআরের মধ্যে সহযোগিতার প্রশংসা করে ক্রেজা বলেন, ‘নতুন জায়গায় কেন্দ্রের পরিচালনা করা এখন অনেক সহজ। সুতরাং, এই ইতিবাচক সহযোগিতা চলমান থাকুক।’
***