** এক্সিম ব্যাংকে ডালিয়া আহমেদ ও তার প্রতিষ্ঠানের নামে হিসাবের তথ্য চেয়ে চিঠি দেয় এনবিআর
** ব্যাংক প্রথমে জানাই কোনো হিসাব নেই, প্রমাণ দেয়ার পর দুইটি হিসাবের তথ্য দিয়েছে
** ঋণের তথ্য দিলেও এফডিআর-সঞ্চয়ের তথ্য দেয়নি, এক্সিমের তথ্য গোপন করেছেন ডালিয়া
** আয়কর আইন অনুযায়ী ব্যাংক তথ্য দিতে বাধ্য, কিছু ব্যাংক তথ্য দিতে গড়িমসি করে বলে অভিযোগ উঠেছে
ডালিয়া আহমেদ। পেশায় একজন শিক্ষক। তিনি ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের সাবেক আলোচিত ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক এএসএম বুলবুল এর স্ত্রী। তার নামে এক্সপোর্ট ইম্পোর্ট ব্যাংক অব বাংলাদেশ লিমিটেডে (এক্সিম ব্যাংক) ঋণ ও সঞ্চয় দুটোই রয়েছে। এক্সিম ব্যাংকের কাছে ডালিয়া আহমেদ ও তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের হিসাবের (একাউন্ট) তথ্য চেয়েছে এনবিআর। ব্যাংকটি জানিয়ে দেয়, তাদের প্রতিটি শাখায় খোঁজ নেয়া হয়েছে। ডালিয়া ও তার প্রতিষ্ঠানের নামে কোনো হিসাবই নেই। অথচ ব্যাংকটির হেড অফিস কর্পোরেট ব্রাঞ্চে রয়েছে দুইটি হিসাব। যার একটি ডালিয়া আহমেদ ও অপরটি তার একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে। আর এই ব্যাংক থেকেই বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়েছেন ডালিয়া আহমেদ, যা আয়কর রিটার্নে দেখাননি। আর ব্যাংক এই করদাতার তথ্য দিতে লুকোচুরি শুরু করে। অবশ্যই প্রমাণ দেয়ার পর দুইটি হিসাবের তথ্য দিতে বাধ্য হয়েছে ব্যাংক।
অপরদিকে, করফাঁকি দিতেই ডালিয়া আহমেদ রিটার্নে এই ব্যাংকের হিসাবের তথ্য দেখাননি বলে মনে করেন আয়কর বিভাগ। আর ব্যাংকে কোনো এফডিআর, সঞ্চয় না থাকলে ব্যাংক এই করদাতাকে ঋণ দিতো না। যদিও ব্যাংক বলছে, শ্রীপুর ও মৌলভীবাজারে জমি মরগেজ দিয়ে তিনি ঋণ নিয়েছেন। আয়কর বিভাগ বলছে, আয়কর আইন অনুযায়ী যেকোনো ব্যাংক যেকোনো করদাতার তথ্য দিতে বাধ্য। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ব্যাংক বিভিন্ন কারণে করদাতার তথ্য চাইলে তা গোপন করছে। আয়কর আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যাংক বা কোনো কর্মকর্তা তথ্য গোপন করলে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।
সূত্রমতে, ডালিয়া আহমেদ পেশায় শিক্ষক হলেও এক্সিম ব্যাংকে তার বিপুল পরিমাণ লেনদেনের তথ্য পায় এনবিআর। পরে তার আয়কর রিটার্ন যাচাই করা হয়। এছাড়া ওই ব্যাংক থেকে কৌশলে তথ্য নেয়া হয়। যাতে দেখা যায়, ডালিয়া আহমেদ এর নামে এক্সিম ব্যাংক হেড অফিস কর্পোরেট ব্রাঞ্চে একটি হিসাব রয়েছে। হিসাব নং-০৩৯১১১০০৩৬৬৩৯৭। এই হিসাবে বিপুল লেনদেন রয়েছে। এছাড়া তার মালিকানাধীন ফিশারম্যান ফিশারিজ এন্ড এগ্রো রয়েছে। শ্রীমঙ্গল এলাকার এই ফিশারিজ ডালিয়া আহমেদ ছয় কোটি ৫৭ লাখ ৮২ হাজার ৫০০ টাকায় কিনেছেন। আল মাসুদ ফিশারিজ এন্ড ডেইরি ফার্ম নামে একটি প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি এই ফার্ম ক্রয় করেছেন। তবে ফিশারম্যান ফিশারিজ এন্ড এগ্রো ক্রয়ে যে মূল্য দেখানো হয়েছে, বাস্তব মূল্যের চেয়ে তা অনেক বেশি বলে। এছাড়া ইস্টার্ন প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিং নামে আরো একটি হিসাব রয়েছে। হিসাব নং-০৩৯১১১০০১৩১৭৬।
সূত্র আরও জানায়, এনবিআর থেকে ২৩ অক্টোবর ডালিয়া আহমেদ এর হিসাবের তথ্য চেয়ে এক্সিম ব্যাংকে চিঠি দেয়া হয়। ১৬ নভেম্বর চিঠির জবাব দেয় ব্যাংক। যাতে সই করেন এক্সিম ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাকসুদা খানম। চিঠিতে বলা হয়, আয়কর আইন, ২০২৩ এর ধারা ২০০(১) অনুযায়ী হিসাব বিবরণী সরবরাহ করতে ২৩ অক্টোবর চিঠি দেয়া হয়েছে। সেই চিঠির প্রেক্ষিতে বিষয়টি জানিয়ে সার্কুলারের মাধ্যমে আমাদের শাখাসমূহে প্রেরণ করা হয়। সেই সার্কুলারের প্রেক্ষিতে শাখাসমূহ হতে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ওই করদাতার ও তার একক বা যৌথ নামে অথবা তার মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে কোনো ধরনের হিসাব আমাদের ব্যাংকের কোনো শাখায় বিদ্যমান নেই।
সূত্রমতে, ব্যাংক থেকে জবাব দেয়ার পর ব্যাংককে ডালিয়া আহমেদ এর হিসাব থাকার কিছু প্রমাণ দেয়া হয়। এরপরই ব্যাংক থেকে দুইটি হিসাবে তথ্য এনবিআরকে দেয়া হয়। যাতে দেখা গেছে, তিনি প্রথমবার ৩২ কোটি ও পরে সাড়ে ৩৯ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। তিনি শ্রীপুর ও মৌলভীবাজারের কিছু জমি মরগেজ দেখিয়েছেন। দুইটি ঋণের বর্তমান স্থিতি প্রায় ৩৮ কোটি টাকা। তথ্য বলছে, মরগেজ দেয়া জমির কয়েকগুণ বেশি তিনি ঋণ নিয়েছেন। তবে এই ব্যাংকে তার নামে এফডিআর বা সঞ্চয় থাকতে পারেন, যার বিপরীতে তাকে ঋণ দেয়া হয়েছে-এমনটা ধারণা করছে এনবিআর।
সূত্র আরও জানায়, ডালিয়া আহমেদ কর অঞ্চল-১১, সার্কেল-২২৯ এর করদাতা। তার ২০২০-২১ কর বছরের আয়কর রিটার্ন যাচাইয়ে দেখা গেছে, তিনি সরকারি তিতুমীর কলেজের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। ওই করবর্ষে তিনি সোনালী ব্যাংক ধানমন্ডি করপোরেট শাখা, ন্যাশনাল ব্যাংক ধানমন্ডি এক্সটেনশন শাখা ও যমুনা ব্যাংক ধানমন্ডি শাখা-এই তিনটি ব্যাংকে তার লেনদেন রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। ওই করবর্ষে তিনি সঞ্চয়পত্র, ব্যাংক সুদ ও ব্যবসা (কৃষি খাতে) থেকে আয় দেখিয়েছেন। অ্যাসেসমেন্ট এরপর ডালিয়া আহমেদ এর ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধি কর অফিসকে জানিয়েছেন, করদাতা ডালিয়া আহমেদ এর দাখিল করা এই তিনটি ব্যাংক ছাড়া অন্য কোনো ব্যাংক হিসাব নেই। কিন্তু এক্সিম ব্যাংক করপোরেট শাখায় হিসাব, তাতে লেনদেন, এফডিআর ও ঋণ নেয়ার কোনো কিছুই তিনি আয়কর রিটার্নে উল্লেখ করেননি।
এনবিআরের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিজনেস বার্তাকে বলেন, ভুল তথ্য বা তথ্য গোপন করলে বা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তথ্য না দিলে আয়কর আইন অনুযায়ী যে প্রতিষ্ঠানের কাছে তথ্য চাওয়া হয়েছে ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায়। আইনের ২৬৬ ধারা অনুযায়ী এককালীন ৫০ হাজার টাকা ও প্রতিদিনের জন্য ৫০০ হাজার হারে জরিমানা আরোপ করার বিধান রয়েছে। আইনের ধারা ২০০ অনুযায়ী অর্থদণ্ড ও কারাদণ্ড আরোপের লক্ষ্যে ফৌজদারি কার্যক্রম গ্রহণ করার বিধান রয়েছে। এক্সিম ব্যাংক তথ্য নিয়ে লুকোচুরি করতে পারে না। তাদেরকে তো চিঠি দেয়া হয়েছে। বলেছে হিসাব নেই। পরে প্রমাণ দিলে হিসাবের তথ্য দিয়েছে। এর অর্থ হলো ব্যাংক ইচ্ছে করে অথবা চাপে পড়ে তথ্য দেয়নি। এটা শুধু এক্সিম নয়, কোনো ব্যাংকের কাছে কাম্য নয়। ডালিয়া আহমেদ রিটার্নে যে সম্পদ ও অর্থ দেখিয়েছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি সম্পদ তার থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এই বিষয়ে বক্তব্য জানতে এক্সিম ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ ফিরোজ হোসেন এর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। এনবিআর আপনাদের কাছে কোনো করদাতার তথ্য চাইলে আয়কর আইন অনুযায়ী আপনারা দেন কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এনবিআর চাইলে আইন অনুযায়ী আমরা দিতে বাধ্য।’ ডালিয়া আহমেদ নামে একজন করদাতার তথ্য আপনাদের কাছে চেয়েছে, আপনাদের ব্যাংক থেকে বলা হয়েছে তার নামে কোনো হিসাব নেই। অথচ তার নামে আপনাদের ব্যাংকে দুইটি হিসাব রয়েছে-এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি একটি মিটিংয়ে আছি। পরে কথা বলেন।’
এই বিষয়ে বক্তব্য জানতে বিজনেস বার্তার পক্ষ থেকে ডালিয়া আহমেদ এর ব্যক্তিগত নাম্বারে যোগাযোগ করা হয়। এক্সিম ব্যাংকে কোনো একাউন্ট, এফডিআর ও লোন রয়েছে কিনা-এমন প্রশ্ন করা হলে ডালিয়া আহমেদ প্রশ্ন করেন, রিপোর্টার বলে কোনো পদ আছে কিনা আমি শুনি নাই। প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই তিনি ফোন কেটে দেন। এরপর ফোন দেয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। বক্তব্যের বিষয় লিখে খুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি কোনো জবাব দেননি।
অপরদিকে, ডালিয়া আহমেদ এর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করছে দুদক। ২০২২ সালের ২৬ জানুয়ারি তথ্য চেয়ে দুদকের সহকারী পরিচালক মো. সাইদুজ্জামান কর অঞ্চল-১১, ঢাকার কমিশনারকে চিঠি দিয়েছে। যাতে বলা হয়েছে, ডালিয়া আহমেদ, অধ্যাপক সরকারি তিতুমীর কলেজ ঢাকা। স্বামী এ এস এম বুলবুল। ৫৯, টিবি হাসপাতাল রোড, মৌলভীবাজার। দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানপূর্বক প্রতিবেদন দাখিলের জন্য অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে। ডালিয়া আহমেদ এর আয়কর নথি (ই-টিআইএন) খোলা হতে বর্তমান সময় পর্যন্ত দাখিলকৃত আয়কর রিটার্নসমূহ, তথ্যাদি বা রেকর্ডপত্রের সত্যায়িত কপি প্রদানের অনুরোধ করা হয়। শুধু ডালিয়া আহমেদ নয়, তার স্বামী ন্যাশনাল ব্যাংকের সাবেক আলোচিত ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এস এম বুলবুল এই পদে থাকাকালে কোনো অনিয়ম করেছেন কি না, সেটির তদন্ত করছে দুদক। তদন্তের অংশ হিসেবে ব্যাংকটির কাছে দুদক এই এমডির সময়ে দেওয়া নিয়োগ, শেয়ার ক্রয় ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিষয়ে তথ্য চেয়েছে।