চট্টগ্রামের অখ্যাত ব্যবসায়ী আশিকুর রহমান লস্কর বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়ে বিদেশে সাম্রাজ্য গড়েছেন। এই কাজে ব্যাংকের অনেক কর্মকর্তার সহায়তা রয়েছে, যাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছেন এবি ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মসিউর রহমান চৌধুরী। তার সরাসরি সহায়তায় আশিকুর এত বড় দুর্নীতি করতে সক্ষম হন। ব্যাংকটির অনেকেই মসিউরকে ‘কমিশনখোর’ এমডি হিসেবে চিনতেন।
অবৈধ উপার্জনের নিরাপত্তা ও কর ফাঁকি দিতে অপরাধীরা সাধারণত বিদেশে অর্থ পাচার করে। বর্তমান আইনে বিদেশে বাড়ি-গাড়ি কেনার অনুমতি নেই এবং ব্যবসায়িক কাজের জন্যও বিদেশে অর্থ পাঠাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন প্রয়োজন। তবে মসিউর কখনো বিদেশে অর্থ পাঠানোর জন্য আবেদন করেননি। ৩৪ বছরের চাকরিজীবনে এত টাকা উপার্জন করেননি তিনি। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিভিন্ন ঋণগ্রহীতা থেকে উৎকোচ নিয়েই মসিউর এই বিপুল সম্পদ তৈরি করেছেন।
২০১৭ সালের ৭ মে তিন বছরের জন্য এবি ব্যাংকের এমডি পদে নিয়োগ পান মসিউর রহমান চৌধুরী। তাঁর বেপরোয়া কমিশন-বাণিজ্যের কারণে মেয়াদ শেষের আগেই ২০১৮ সালের ১২ অক্টোবর পদ ছেড়ে অস্ট্রেলিয়া পালান। চাকরিজীবনের শুরুর দিকে অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নেন। সেই সূত্রে দেশটির সঙ্গে তাঁর সখ্য। তিনি সোনালী ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে ১৯৮৪ সালে চাকরির যাত্রা শুরু করেন। সোনালী ব্যাংক ছেড়ে ২০০৩ সালে এবি ব্যাংকের ঋণ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বিভাগে যোগ দেন। ২০১৩ সাল থেকে তিনি ছিলেন ঋণ বিভাগের প্রধান।
এবি ব্যাংকে ২০১৩ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে বেশির ভাগ জালিয়াতি ঘটনা ঘটেছে। নিয়ম-নীতির পরিপন্থী হয়ে একক গ্রাহকের ঋণসীমা অমান্য করে আশিকুর রহমান লস্করের হাতে ১ হাজার ৭২৯ কোটি টাকা তুলে দেওয়া হয়। একইভাবে, স্বাস্থ্য খাতের আলোচিত ঠিকাদার পলাতক মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর এবি ব্যাংকে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে, যার অনুমোদনও মসিউরের বিশেষ সহায়তায় করা হয়।
অস্ট্রেলিয়ায় যেভাবে সম্পদ
মসিউর রহমান চৌধুরী এবং তাঁর স্ত্রী ফারজানা চৌধুরী বিদেশে এসব সম্পত্তির আসল সুবিধাভোগী। এই অর্থ সরাসরি বাংলাদেশ থেকে অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছেনি। প্রথমে দুবাই, সিঙ্গাপুর এবং মালয়েশিয়া থেকে অর্থ নেওয়া হয়, তারপর তা একাধিক স্তর অতিক্রম করে শেষমেশ অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছায়। মূলত মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে অর্থের উৎস গোপন রাখতে এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছে, যার ফলে সম্পত্তির প্রকৃত মালিকানা শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। এ কারণেই ‘বন্ধুর পথ’ বেছে নেন মসিউর। তিনি এই চারটি বাড়ি কিনেছেন অস্ট্রেলিয়ার একটি ল ফার্মের নামে। যে কারণে এসব সম্পত্তির মালিক যে মসিউর, সাদা চোখে তা বোঝার উপায় নেই।
২০২৩ সালের জানুয়ারিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় সভার কার্যবিবরণীতে জানা যায়, মসিউরের পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনাসহ আইনি সহায়তা চেয়ে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) পাঠানো হয়েছিল, তবে সেখানে বিস্তারিত কিছু উল্লেখ করা হয়নি। এক নথি থেকে জানা যায়, অস্ট্রেলিয়ার সরকারি সংস্থা নিউ সাউথ ওয়েলসে মসিউরের চারটি বাড়ি ও একটি কোম্পানির তথ্য সরবরাহ করেছে। ২০১৫ সালের মে থেকে ২০১৭ সালের মে মাসের মধ্যে ৯ লাখ অস্ট্রেলিয়ান ডলার থেকে ৪ মিলিয়ন অস্ট্রেলিয়ান ডলারে এসব সম্পত্তি কেনা হয়েছিল।
২০১৫ সালের ৩০ অক্টোবর মসিউর দম্পতির নামে ‘ফার্মোশ ট্রেডিং পিটিওয়াই লিমিটেড’ নামে একটি কোম্পানি নিবন্ধন করা হয়, যা অস্ট্রেলিয়ান সিকিউরিটিজ অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টস কমিশনের তথ্য অনুযায়ী রেজিস্টার করা হয়েছিল। এর আগে, ২০১৫ সালের ২২ জুন, ব্যাংকটির আরেক সাবেক এমডি মো. ফজলুর রহমানসহ চারজনের নামে ‘ইনস্টার ইনভেস্টমেন্ট হোল্ডিংস পিটিওয়াই লিমিটেড’ নামে একটি কোম্পানি নিবন্ধিত হয়েছিল। ওই চারজনের মধ্যে ছিলেন স্বাস্থ্য খাতের আলোচিত ঠিকাদার মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু, তাঁর ভাই মোহাম্মদ মোকসেদুল ইসলাম, এবং ভাগনে বেনজির আহমেদ। পরবর্তীতে ২০১৬ সালের ২ মার্চ মসিউরের স্ত্রীর নামে ‘ভাইব টেক অস্ট্রেলিয়া প্রাইভেট লিমিটেড’ কোম্পানি নিবন্ধন করা হয়, যা এ কে এম ফজলুল হক ও নাশরাফ নিজামুদ্দীনের নামে ছিল। যদিও কোম্পানিগুলোর নাম ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির নামে নিবন্ধিত ছিল, কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার কর্তৃপক্ষ জানায় যে এসব কোম্পানির অ্যাকাউন্টে জমা হওয়া সব অর্থের মূল সুবিধাভোগী মসিউরই। ২০১৯ সালে ‘ফার্মোশ ট্রেডিং’ ও ‘ইনস্টার ইনভেস্টমেন্ট’ কোম্পানিগুলো বন্ধ করা হয়, তবে বর্তমানে শুধুমাত্র ‘ভাইব টেক’ কোম্পানিটি সচল রয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার সরকারি সংস্থার তথ্য ও অনলাইনে দেওয়া বিজ্ঞাপন অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি খরচ করে ১৮৮ লাকেম্বা স্ট্রিটের বাড়িটি কেনেন মসিউর। ২২ বেডরুম, ৮ বাথরুম ও ২৪টি গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে এই বাড়িতে। ২০১৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর ৪৩ লাখ অস্ট্রেলিয়ান ডলারে বাণিজ্যিক স্থাপনা হিসেবে এটি কেনা হয়। পরে দেশটির সরকারি পরিকল্পনা বিভাগ থেকে আবাসিক ও বাণিজ্যিক ব্যবহারের অনুমোদন নেওয়া হয়। দেশটির সম্পত্তি বেচাকেনার নির্ভরযোগ্য অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ‘রিয়েল এস্টেট ডটকম ডট এইউ’তে এই বাড়ি বিক্রির জন্য দাম চাওয়া হয়েছে ৫৫ লাখ অস্ট্রেলিয়ান ডলার বা ৪৩ কোটি টাকা।
অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশি অধ্যুষিত লাকেম্বার বুলেভার্ডে পরপর তিনটি বাড়ির মালিক তিনি। গুগল ম্যাপের তথ্য অনুযায়ী, লাকেম্বা স্টেশন থেকে এসব বাড়ির হাঁটা দূরত্ব মাত্র এক মিনিটের। বিজ্ঞাপনের তথ্য অনুযায়ী, সর্বপ্রথম ২০১৫ সালের ১ মে ৬৪ বুলেভার্ডের বাড়িটি কেনেন তিনি। পাঁচ বেডরুম ও দুই বাথরুমের এই বাড়ি ১৪ লাখ ২০ হাজার অস্ট্রেলিয়ান ডলারে বিক্রির জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। আর বুলেভার্ডের আট বেডরুম, চার বাথরুম, দুই পার্কিং স্পেসসহ ৬৬ নম্বর বাড়িটি কিনেছেন ২০১৭ সালে। এখন যা ৩১ লাখ ৪৭ হাজার অস্ট্রেলিয়ান ডলারে বিক্রি করা হবে। সর্বশেষ ২০১৭ সালের ৩০ মে কিনেছেন ৬৫ নম্বর বাড়িটি। তিন বেডরুম, এক বাথরুম, একটি পার্কিংসহ এই বাড়ি বিক্রির দর চাওয়া হয়েছে ১২ লাখ ৪ হাজার ডলার। প্রতিটি বাড়ি বিক্রির এজেন্ট হিসেবে নাম রয়েছে অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত সৈয়দ হাসান নামে এক ব্যক্তির।
বাড়ি বিক্রির এজেন্ট হিসেবে নাম থাকা সৈয়দ হাসান হোয়াটসঅ্যাপ বার্তায় জানান, কোম্পানির নামেই এসব বাড়ি, সে কোম্পানি পরিচালিত হয় অস্ট্রেলিয়ার আইনজীবীর মাধ্যমে। যে কারণে প্রকৃত মালিক কে, তা তাঁর জানা নেই। তিনি কেবল এসব বাড়ি বিক্রির এজেন্ট হিসেবে কাজ করছেন। বিএফআইইউর এক কর্মকর্তা বলেন, অর্থ পাচারকারীরা আইনি সুরক্ষা পেতে কয়েক স্তর পেরিয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে বিদেশে সম্পদ কেনে। এ কারণে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা জটিল।
ধুঁকছে এবি
ব্যাংক খাত-সংশ্লিষ্টরা জানান, একসময় দেশের অন্যতম সেরা ব্যাংক হিসেবে পরিচিতি ছিল ‘এবি’র। কয়েক বছর ধরে ধুঁকছে প্রতিষ্ঠানটি। এখন এবি ব্যাংকের ৩২ হাজার কোটি টাকা ঋণের প্রায় অর্ধেকই খেলাপি। দীর্ঘদিন ধরে বড় অঙ্কের লোকসান ও মূলধন ঘাটতিতে চলছে এই ব্যাংক। বিধিবদ্ধ তারল্য সংরক্ষণের মতো অবস্থাও নেই। ব্যাংকটির অন্যতম উদ্যোক্তা সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খান দীর্ঘদিন ধরে চেয়ারম্যান ছিলেন। তাঁর ছেলে ফয়সাল মোরশেদ খানও চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। বিগত সরকারের সময় সরাসরি তারা পরিচালনায় না থাকলেও তাদের মনোনীত পরিচালকরাই ব্যাংক চালিয়েছেন। ২০০৮ সালের জুলাই থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত টানা ৯ বছর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন এম ওয়াহিদুল হক। তিনি ছিলেন মোরশেদ খানের চা বাগানের ব্যবস্থাপক।
শুধু অর্থ পাচার নয়, জাল কার্যাদেশ এবং অবৈধ ব্যাংক গ্যারান্টি দিয়ে ১৭৬ কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগে ২০২১ সালের ৮ জুন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলা করে সাবেক তিন এমডি মসিউর, শামীম আহমেদ চৌধুরী, ফজলুর রহমানসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে। সর্বশেষ ২০১৯ সালের জুলাই থেকে প্রায় ছয় বছর এমডির দায়িত্বে থাকা আফজালও কানাডায় পালিয়ে গেছেন। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে সেখান থেকে পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন। ২০১২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় ছিলেন চার এমডি, যাদের সবাই বিভিন্ন অনিয়মে জড়িত ছিলেন। এবি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান এম ওয়াহিদুল হক বলেন, মাহিন ট্রেডার্স ছিল দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জাহাজভাঙা ব্যবসায়ী, তবে আমি কখনো তার কাছ থেকে কোনো সুবিধা নেননি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বলেন, এমডি হিসেবে তাঁর দায়িত্ব ছিল সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ব্যাংকটি এগিয়ে নেওয়া। তা না করে তিনি যদি বিভিন্ন অনিয়মে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন, অর্থ পাচারে সম্পৃক্ত থাকেন– এটি দুঃখজনক। বিধি অনুযায়ী, তাঁর বিরুদ্ধে বিএফআইইউ ব্যবস্থা নেবে।
মসিউর বক্তব্য
পলাতক মসিউর রহমান চৌধুরী দেশটিতে অবৈধ উপায়ে অস্ট্রেলিয়ায় অর্থ নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, এবি ব্যাংকে থাকা অবস্থায় ২০১২ সালে আমি অস্ট্রেলিয়ায় পিআরের (স্থায়ী বাস) জন্য আবেদন করেছিলাম। দেশটির শর্ত মেনে আমাকে কিছু অর্থ দেখাতে বলা হয়। যে কারণে একটি কোম্পানি খুলতে হয়েছিল। একই কারণে স্ত্রীর নামে ভাইব টেক খোলা হয়। তবে ইনস্টার ইনভেস্টমেন্টের সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা কেউ খুঁজে পাবে না। প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে দেশটিতে কেনা চারটি বাড়ির সুনির্দিষ্ট ঠিকানা উল্লেখ করে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এসব বাড়ির কোথাও আমার নাম নেই।’ ২০১৮ সালে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে অস্ট্রেলিয়ায় বাস করছেন কীভাবে– এমন প্রশ্নে বলেন, ‘আমার ছেলে এখানে চাকরি করে। তার কাছে আছি।’ তিনি বলেন, ‘তিনটি ঋণে সই করতে রাজি না হওয়ায় আমাকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। ভাই, এমনিতেই বিপদে আছি। এসব নিয়ে আর লিখেন না।’