** অপারেশন এন্ড মেন্টেনেন্স ফি, ফিল্ড সার্ভিস ও ষ্পেয়ার পার্টস-এই তিন খাতে বেশি ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে
** প্রতিষ্ঠানের ব্যয় বা কেনাকাটার ক্ষেত্রেও ভ্যাট পরিশোধ না করে ফাঁকি দেয়া হয়েছে
** তিন খাতে ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে প্রায় ১১ কোটি ২৬ লাখ টাকা
রাসেল মো. শাহেদ: নিয়ম করে নেয়া হয় তিন খাতে ফি। যার উপর দেয়া হয় না ভ্যাট। এক, দুই বছর নয়-টানা পাঁচবছর ভ্যাট পরিশোধ করেনি ওয়ার্টসিলা বাংলাদেশ লিমিটেড। জ্বালানি খাতে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানটি পাঁচবছরে প্রায় সাড়ে ১১ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানের ব্যয় বা কেনাকাটার ক্ষেত্রেও বিপুল পরিমাণ ভ্যাট ফাঁকি দেয়া হয়েছে। সুদসহ ফাঁকি দাঁড়িয়েছে প্রায় ২২ কোটি টাকা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি) নিরীক্ষার মাধ্যমে ওয়ার্টসিলা বাংলাদেশ লিমিটেডের ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটন করেছে। ফাঁকি দেয়া ভ্যাট পরিশোধে প্রতিষ্ঠানকে ইতোমধ্যে ভ্যাট উত্তর কমিশনারেট থেকে কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করা হয়েছে। এনবিআর সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
সূত্রমতে, ওয়ার্টসিলা বাংলাদেশ লিমিটেডের বিরুদ্ধে ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগ উঠে। এরই প্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানটি নিরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয় এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি)। নিরীক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির দাখিল করা ব্যবসা সংক্রান্ত দলিলাদি যাচাই করা হয়। যাতে ভ্যাট ফাঁকির তথ্য উঠে আসে। সে অনুসারে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন ফি নিয়েছে, যার বিপরীতে বিপুল পরিমাণ ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি মূলত অপারেশন এন্ড মেন্টেনেন্স ফি, ফিল্ড সার্ভিস ও ষ্পেয়ার পার্টস-এই তিনটি সেবায় বেশি ভ্যাট ফাঁকি দেয়। এই তিন খাতে যথাক্রমে ১ কোটি ৪৮ লাখ ৭১ হাজার ৫৭৯ টাকা, ১ কোটি ১৮ লাখ ৫২ হাজার ৩৫৪ টাকা, ১ কোটি ৩৫ লাখ ১ হাজার ৫৪১ টাকা, ২ কোটি ৪৪ লাখ ৮ হাজার ৬৫৮ টাকা, ১ কোটি ৮৯ লাখ ৬২ হাজার ৯৪১ টাকা ও ২ কোটি ৯০ লাখ ৩৩ হাজার ৩৩৪ টাকাসহ মোট ১১ কোটি ২৬ লাখ ৩০ হাজার ৪০৬ টাকা ভ্যাট পরিশোধ করা হয়নি।
অপরদিকে, মূসক আইন, ১৯৯১ এর ধারা-৬ এবং মূসক বিধিমালা, ১৯৯১ এর বিধি-১৮ অনুযায়ী লিমিটেড প্রতিষ্ঠানের পণ্য বা সেবা গ্রহণের বিপরীতে ব্যয় বা কেনাকাটার ক্ষেত্রে উৎসে মূসক (ভ্যাট) কর্তন করে সরকারি কোষাগারে জমাদানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি কিছু কিছু ক্ষেত্রে উৎসে মূসক কর্তন করলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উৎসে মূসক কর্তন না করে ফাঁকি দিয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে-অফিস বিভিন্ন পণ্য সরবরাহ ব্যয়, যোগাযোগ ব্যয়, প্রশাসনিক ব্যয়, নিরীক্ষা ব্যয়, নিরাপত্তা সামগ্রী ক্রয়, সভা ব্যয়, যানবাহন ভাড়া, প্রশিক্ষণ ব্যয়, প্রফেশনাল ফি, ভ্রমণ ব্যয়, অফিস ও গেস্টহাউস ব্যয়, তথ্য ব্যবস্থাপনা ব্যয়, বিনোদন ব্যয় ইত্যাদি। এ ছাড়া কস্ট অব সেলস এর মধ্যে রয়েছে-স্পেয়ার পার্টস অ্যান্ড কেমিক্যালস, এক্সটার্নাল সার্ভিস, জেনারেটিং এক্সপেন্স, ফিল্ড সার্ভিস অ্যান্ড প্রোজেক্ট। ২০১৫ সালের জানুয়ারি হতে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ১৬ লাখ ৫ হাজার ৫৪৭ টাকা উৎসে ভ্যাট পরিশোধ না করে ফাঁকি দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটি তিনটি মোট ১১ কোটি ২৬ লাখ ৩০ হাজার ৪০৬ টাকা ভ্যাট পরিশোধ করেনি। এ ছাড়া উৎসে ভ্যাট হিসেবে ১৬ লাখ ৫ হাজার ৫৪৭ টাকা পরিশোধ করেনি। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি পাঁচ বছরে মোট ১১ কোটি ৪২ লাখ ৩৫ হাজার ৯৫৩ টাকার ভ্যাট পরিশোধ না করে ফাঁকি দিয়েছে। মূসক আইন অনুযায়ী, ফাঁকি দেয়া ভ্যাটের উপর ২ শতাংশ হারে প্রযোজ্য সুদ ১০ কোটি ৮৮ লাখ ৪৬ হাজার ৯৪ টাকা। সুদসহ মোট ফাঁকি ২২ কোটি ৩০ লাখ ৮২ হাজার ৪৭ টাকা।
এনবিআর সূত্রমতে, ফাঁকি দেয়া এই ভ্যাট আদায় ও প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি ভ্যাট উত্তর কমিশনারেটকে মামলার প্রতিবেদন দেয় সিআইসি। সে প্রতিবেদন অনুযায়ী সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর দাবিনামা সংবলিত কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হয়েছে। কোন বক্তব্য বা জবাব থাকলে ১৫ দিনের মধ্যে জানাতে সময় দেয়া হয়। জবাব না দিলে দাবিনামা চূড়ান্তকরণসহ পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে নোটিশে বলা হয়েছে।
ওয়ার্টসিলা বাংলাদেশ লিমিটেডের ভ্যাট ফাঁকির বিষয়ে এনবিআরের একজন কর্মকর্তা বলেন, জ্বালানি খাতে স্বনামধন্য এমন প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট ফাঁকিতে অবাক হতে হয়। অভিযোগের ভিত্তিতে সিআইসি নিরীক্ষা করে ভ্যাট ফাঁকি পেয়েছে। ভ্যাট কমিশনারেট যাচাই করলে আরো বেশি ফাঁকি পাবে। ভ্যাট ফাঁকি দেয়ায় প্রতিষ্ঠানটিকে কমিশনারেট নজরদারিতে রাখবে।
এই বিষয়ে বক্তব্য জানতে গত কয়েকদিন ধরে ওয়ার্টসিলা বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিল্লুর রহিম এর ব্যক্তিগত নাম্বারে ফোন দেয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। খুদে বার্তা দেয়া হলেও জবাব দেননি। তার ব্যক্তিগত নাম্বারের হোয়াইটস অ্যাপে বক্তব্যের বিস্তারিত লিখে দেয়া হলে তিনি সিন করেন। তবে কোন জবাব দেননি। একটি কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠান থেকে বক্তব্য দেয়ার কথা বলা হলেও পরে আর দেয়া হয়নি। প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা রাউকিফ রেজাকে ফোন দেয়া হলে বক্তব্যের বিষয় জেনে নেন। পরে ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
###