ওসমান পরিবারের সম্পদ বিক্রির হিড়িক

নারায়ণগঞ্জের ওসমান পরিবার—একদিকে সমৃদ্ধ রাজনৈতিক ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আভিজাত্যের গল্প; অন্যদিকে প্রভাব-প্রতিপত্তি, সন্ত্রাস, পেশিশক্তি ও গডফাদার তকমার সঙ্গে বিপুল সম্পদ গড়ার বিতর্ক। আলোচিত এই পরিবারের এমন দাপট ছিল যে, একসময় তাদের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে পর্যন্ত সাহস পেত না।

অথচ গত ৫ আগস্টের ক্ষমতার পালাবদলের পর ওই পরিবারটির দর্প প্রায় চূর্ণ। পরিবারের সদস্য সাবেক এমপি শামীম ওসমান, সেলিম ওসমান ও প্রয়াত নাসিম ওসমানের নাম শুনলে একদা যে শহরে ‘কাঁপন’ ধরত, সেখানে এখন রাজ্যের নীরবতা। দুই ভাই ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা সব লাপাত্তা। তাঁদের বাপ-দাদার রাজনৈতিক ঐতিহ্য ও স্মৃতিময় ঐতিহাসিক বাড়িগুলো এখন সুনসান, জীর্ণ।

তার চেয়েও বড় খবর একে একে ওসমান পরিবারের বাড়িঘর-সহায়সম্পদ সব বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে সেলিম ওসমানের প্রায় অর্ধশত কোটি টাকার দুটি বহুতলবিশিষ্ট বাড়ি বিক্রি হয়ে গেছে। আরো বিক্রির গুঞ্জন এখন শহরজুড়ে। অনুসন্ধানে এসব তথ্য জানা গেছে।

সরেজমিনে এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে পুরো নারায়ণগঞ্জে ওসমান পরিবার ঘিরে ভিন্ন এক বার্তা পাওয়া যায়। সবার মধ্যেই ফিসফাস, কানাকানি। সবারই কথা—ওসমান পরিবারের দৌরাত্ম্য শেষ হয়েছে। তাঁদের কারো টিকিটিও এখন আর দেখা যাচ্ছে না। শুধু তা-ই নয়, তাঁরা এখন সহায়সম্পদ সব গোটাচ্ছেন।

পরে খোঁজখবর নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য কানে আসে। ওসমান পরিবার বাড়িঘর বিক্রি করে চলে যাচ্ছে!
নারায়ণগঞ্জের ‘ধনকুবের’ হিসেবে পরিচিত ফকির অ্যাপারেলসের মালিক ফকির মনিরুজ্জামান এরই মধ্যে ওসমান পরিবারের সদস্য ও সাবেক এমপি সেলিম ওসমানের দুটি বাড়ি কিনে নিয়েছেন বলে জানা যায়। ফকির গ্রুপ বাড়িগুলোর দাম কত তা জানাতে অপারগতা জানালেও স্থানীয়রা জানায়, বাড়ি দুটির দাম অর্ধশত কোটি টাকার কম হবে না।

সোমবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জের উত্তর চাষাঢ়ায় রামবাবুর পুকুরপারে সরেজমিনে গিয়ে সেলিম ওসমানের মালিকানাধীন পাশাপাশি দুটি আলিশান বহুতল ভবনের প্রধান ফটকে মালিকানা পরিবর্তনের দুটি নামফলক দেখা যায়। সেখানে লেখা রয়েছে, ‘ক্রয়সূত্রে এই বাড়ির মালিক ফকির অ্যাপারেলস লিমিটেড, বিসিক।’

উপস্থিত স্থানীয় লোকজন জানায়, দুটি বাড়িতে এখন ভাড়াটিয়ারা বসবাস করছেন। গেটে প্রহরারত একজন নিরাপত্তাকর্মী জানান, গত ৫ আগস্টের পর বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা এই দুটি বাড়ি ভাঙচুর করতে এলেও বাড়ির মূল গেটে মালিকানা পরিবর্তনের নামফলক দেখে হামলা ও ভাঙচুর না করে ফিরে যায়। তবে বাড়ি দুটি ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পরে কিনেছেন বলে প্রচার থাকলেও ফকির গ্রুপ তার আগেই কেনা হয়েছে বলে স্বীকার করেছে।

পরে এলাকাবাসীর সঙ্গে এ নিয়ে কথা বললে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা জানায়, ‘গত ৫ আগস্টের পর ওসমান বংশের তিন প্রভাবশালী ভাইয়ের পরিবার একযোগে নারায়ণগঞ্জ ছেড়ে পালিয়ে গেছে। তাই সঠিক তথ্য দেওয়া সম্ভব না। তবে আমরা যেটুকু শুনতেছি, তাতে ওসমান পরিবারের সবাই পালানোর আগেই তাঁদের সহায়সম্পদ বিক্রি করে গেছেন। বলতে পারেন, ওসমান পরিবারের সম্পদ বিক্রির হিড়িক পড়ে গেছে। যা নিয়ে শহরের বিভিন্ন মহলে এখন ব্যাপক গুঞ্জন চলছে।’

চাষাঢ়া এলাকায় যার সঙ্গেই কথা হয়েছে, তাদের প্রায় প্রত্যেকেই ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের আগেই ওসমান পরিবার ‘পরিণতি’ আঁচ করতে পেরে আগেভাগেই সহায়সম্পদ বিক্রি শুরু করেছে বলে জানিয়েছে। সাবেক সাংসদ সেলিম ওসমানও চাষাঢ়ার দুটি বিলাসবহুল বাড়ি বিক্রি করে গেছেন বলে স্থানীয় লোকজন নিশ্চিত করে।

এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবির বলেন, ‘ওসমান পরিবারের সম্পদ বিক্রির যে হিড়িক পড়েছে, সেটি এখন আমরাও নানা সূত্রে খবর পাচ্ছি। তবে শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত উত্তর চাষাঢ়ায় সেলিম ওসমানের দুটি বিলাসবহুল বহুতলবিশিষ্ট অট্টালিকা ৫ আগস্টের আগেই বিক্রি হয় বলে জেনেছি। যার বর্তমান বাজার মূল্য ৪০ থেকে ৫০ কোটি টাকা হবে।’সাবেক এমপি শামীম ওসমানেরও সম্পদ বিক্রির তথ্য জানা যায়। তবে কী পরিমাণ সম্পদ বা বাড়ি তিনি বিক্রি করেছেন তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারেনি।

নারায়ণগঞ্জের উত্তর চাষাঢ়ার অভিজাত আবাসিক এলাকায় ওসমান পরিবারের সম্পত্তি বিক্রি নিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেন দুই প্রতিবেদক। সেখানেই ‘রাম বাবুর’ পুকুরপারের পাশে চোখে পড়ে শামীম ওসমানের বাবা, প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও সাবেক সংসদ সদস্য এ কে এম শামসুজ্জোহার ঐতিহ্যবাহী বাসভবন ‘হিরা মহল’। একসময় জৌলুসপূর্ণ এই বাড়িটি এখন জনশূন্য ও ভূতুড়ে চেহারা নিয়েছে। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার হামলা ও ভাঙচুরের ক্ষতচিহ্ন এখনো বহন করছে ঐতিহাসিক এই স্থাপনা।

প্রায় একই দৃশ্য দেখা যায় আনুমানিক ১০০ মিটার দক্ষিণে অবস্থিত ৯ শতাংশ জায়গার ওপর নির্মিত কালো কাচে ঘেরা সাবেক প্রভাবশালী সাংসদ সেলিম ওসমানের মালিকানাধীন তিনতলাবিশিষ্ট বাড়িটিতে। সেখানেও ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয় এবং পরে আগুন দেওয়া হয়।সরেজমিনে গিয়ে শহরের জামতলার ধোপাপট্টিতে অবস্থিত নারায়ণগঞ্জের সবচেয়ে সমালোচিত সাবেক প্রভাবশালী সাংসদ শামীম ওসমানের মালিকানাধীন নান্দনিক একটি বহুতল ভবনেরও একই চিত্র দেখা যায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক প্রতিবেশী জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সেটিতে ব্যাপক ভাঙচুর চালায় ও আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। বিধ্বস্ত এই বাড়িটি নাকি এখন নেশাখোরদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে।এদিকে স্থানীয় নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, রপ্তানিমুখী বিশাল নিট গার্মেন্টস উইসডম অ্যাটেয়ার্স লিমিটেডসহ মোট পাঁচটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও কথিত ‘ভাড়ার চুক্তি’তে কৌশলে একটি রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতার নামে হস্তান্তর করেছেন সেলিম ওসমান।

জানা যায়, এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার ওসমান পরিবারের পলাতক সদস্যদের ব্যাংক হিসাবও জব্দ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। এ নিয়েও স্থানীয় গণমাধ্যমে বিস্তর লেখালেখি হচ্ছে।

সেলিম ওসমান ২০১৪ সালে তাঁর বড় ভাই নাসিম ওসমানের মৃত্যুর পর নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের উপনির্বাচনে জাতীয় পার্টির মনোনয়নে সংসদ সদস্য বাগিয়ে নেন। এরপর ২০১৮ সালের একাদশ ও ২০২৪ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি এমপির চেয়ারটি দখলে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।

এদিকে সংসদ নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামায় সেলিম ওসমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে আরো অনেক সম্পদ থাকার তথ্য সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামার তথ্য অনুযায়ী, সেলিম ওসমানের মালিকানাধীন পাঁচটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে তিনটি চলমান বলে হলফনামায় উল্লেখ করা হয়।এ ছাড়া তাঁর বার্ষিক আয় এক কোটি ৬৭ লাখ টাকা এবং তাঁর ওপর নির্ভরশীল স্ত্রী ও কন্যার আয় এক কোটি ৫৩ লাখ টাকা উল্লেখ করা হয়।

সেলিম ওসমানের নগদ ও ব্যাংকে জমা রাখা টাকাসহ অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ সাত কোটি ৮৭ লাখ ২৯ হাজার ৮০২ টাকা উল্লেখ করা হয়। স্ত্রী ও কন্যার নামে একই খাতে সম্পদের পরিমাণ চার কোটি ৩২ লাখ ২৭ হাজার ৮০৭ টাকার কথা উল্লেখ রয়েছে।তাঁর স্থাবর সম্পদের পরিমাণ রয়েছে ১০৮ শতাংশ জমি এবং ৯ শতাংশ জমির ওপর এক কোটি ২৪ লাখ ৯০ হাজার টাকা মূল্যের তিনতলা বাড়ি।

এ ছাড়া ঢাকার ইনার সার্কুলার রোডে ১৭ লাখ ৮৩ হাজার টাকা মূল্যের একটি ফ্ল্যাট এবং ফাইভ স্টার ফার্ম হাউসে পাঁচ কোটি টাকা বিনিয়োগের কথা উল্লেখ আছে। তাঁর স্ত্রী ও কন্যার নামে জমি রয়েছে দুই হাজার ৬১৩ শতাংশ। এর মধ্যে খুলনার ফুলতলা উপজেলাতেই রয়েছে দুই হাজার ৪৩৪ শতাংশ কৃষি জমি।

সেলিম ওসমানের স্থাবর সম্পদের মধ্যে তাঁর স্ত্রীর নামে ধানমণ্ডিতে ৩৯ লাখ টাকা মূল্যের ৪,২৮৬ বর্গফুটের ফ্ল্যাটসহ থ্রি স্টার ফার্ম হাউস ও উইজডম অ্যাটেয়ার্সে প্রায় ১১ কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। এছাড়া, ধানমণ্ডিতে তাঁর তিন মেয়ের নামে তিন কোটি ১১ লাখ টাকার তিনটি ফ্ল্যাটও রয়েছে। তবে, সেলিম ওসমান, তাঁর স্ত্রী ও কন্যাদের নামে দেনা ও ঋণের পরিমাণ প্রায় ১১ কোটি টাকা। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বিএফআইইউ সেলিম ওসমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করে।

ওসমান পরিবারের প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক সাংসদ শামীম ওসমান, তাঁর বড় ভাই জাতীয় পার্টির সাবেক সাংসদ সেলিম ওসমান এবং মরহুম নাসিম ওসমানের পুত্র আজমীর ওসমানসহ পরিবারের একাধিক সদস্যের বিরুদ্ধে হত্যা মামলাসহ নানা অভিযোগে মামলা রয়েছে। নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) প্রত্যুষ কুমার মজুমদার গত মঙ্গলবার জানান, ওসমান পরিবারের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ৩০টিরও বেশি হত্যা মামলাসহ একাধিক মামলা রয়েছে, সবই তদন্তাধীন। তদন্ত শেষে যথাসময়ে চার্জশিট দেওয়া হবে।

সূত্র-কালের কণ্ঠ

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!