দেশে ওষুধের কাঁচামাল তৈরির শিল্প দেড় দশকেরও বেশি সময়েও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এ খাতের জন্য বরাদ্দ জমি এখনো ফাঁকা পড়ে রয়েছে। দেশে উৎপাদিত ওষুধের ৯৫ শতাংশ চাহিদা মেটানো সম্ভব হলেও এর কাঁচামালের প্রায় পুরো অংশই আমদানির ওপর নির্ভরশীল। ১৭ বছর আগে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় এই শিল্প গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে সরকার জমি বরাদ্দ দেয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠান কাঁচামাল উৎপাদন শুরু করেছে, আরও দুটি প্রতিষ্ঠান প্রাথমিক কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তবে বরাদ্দ পাওয়া ২৩টি প্রতিষ্ঠানের জমি এখনো অনিষ্পন্ন অবস্থায় রয়েছে।
সাধারণত ওষুধে দুটি প্রধান উপাদান থাকে। প্রথমটি হলো মূল কার্যকর কাঁচামাল, যা অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্ট (এপিআই) নামে পরিচিত। দ্বিতীয়টি হলো নিষ্ক্রিয় সহযোগী উপাদান, এক্সিপিয়েন্ট। উদাহরণস্বরূপ, প্যারাসিটামল বড়ির এপিআই হলো ‘প্যারাএসাইটাল অ্যামাইনোফেনাল’, যা রোগ নিরাময়ে কার্যকর ভূমিকা রাখে। তবে এই বড়িতে সেলুলোজ ও ট্যাল্কের মতো এক্সিপিয়েন্টও থাকে, যা ওষুধকে নির্দিষ্ট আকার দিতে ও শরীরে দ্রুত দ্রবীভূত হতে সহায়তা করে। এক্সিপিয়েন্ট ওষুধের কার্যকারিতা বাড়ালেও শরীরে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না।
ওষুধশিল্প-সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো বছরে অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকার এপিআই আমদানি করে। ২০২৬ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে গেলে এপিআই আমদানির খরচ যেমন বাড়বে, তেমনি দেশে উৎপাদনের ব্যয়ও বৃদ্ধি পাবে। সম্ভাবনা থাকলেও বাংলাদেশ এখনো এ সুযোগ যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারেনি। ওষুধ কোম্পানিগুলোর আগ্রহ কম ছিল, পাশাপাশি সরকারের মনোযোগও পর্যাপ্ত ছিল না। তবে ওষুধ শিল্পের পরনির্ভরতা কমাতে দেশে এপিআই উৎপাদনের কোনো বিকল্প নেই। অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের এপিআই উৎপাদনে গুরুত্ব দেওয়া হবে, পাশাপাশি এ শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ও প্রণোদনাও নিশ্চিত করা হবে।
বাংলাদেশের ওষুধশিল্পের অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে দেশে ব্যবহৃত ৯৫ শতাংশ ওষুধ দেশেই উৎপাদিত হয়, মাত্র ৫ শতাংশ আমদানি করতে হয়। পাশাপাশি বাংলাদেশ ওষুধ রপ্তানিও করছে। তবে এখানেও একটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে—দেশের ওষুধশিল্পের ৯০ শতাংশ কাঁচামাল (এপিআই) এখনো বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়, যার বড় অংশ আসে চীন ও ভারত থেকে। দেশে উৎপাদিত এপিআইয়ের পরিমাণ মাত্র ১০ শতাংশ। সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের মতে, যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে ওষুধের কাঁচামাল আমদানির ওপর নির্ভরতা অনেকটাই কমানো সম্ভব।
বর্তমান পরিস্থিতি
১৯৮৮ সালে গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালস দেশে প্রথমবারের মতো এপিআই উৎপাদন শুরু করে, যার মধ্যে এমোক্সিসিলিন ছিল প্রথম। এটি একটি অ্যান্টিবায়োটিক। এরপর প্রতিষ্ঠানটি আরও দুটি এপিআই তৈরি করলেও পরবর্তীতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। দেশের ছোট-বড় ওষুধ কোম্পানিগুলো এক বা দুই ধরনের এপিআই উৎপাদন করলেও প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা ও আর্থিক প্রণোদনার অভাবে এ খাত কাঙ্ক্ষিত বিকাশ লাভ করতে পারেনি। এপিআই প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ এপিআই অ্যান্ড ইন্টারমিডিয়ারিস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএআইএমএ) জানিয়েছে, গত আট বছরে স্থানীয় ওষুধ কোম্পানিগুলো ৪০টির বেশি এপিআই উৎপাদন করেছে।
কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান নিজে এপিআই তৈরি করে নিজের ওষুধ কোম্পানিতে তা কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান এপিআই তৈরি করে দেশের মধ্যে অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে। দেশি কোম্পানিগুলো আর্থিক নিরাপত্তা ও প্রণোদনা পেলে দেশের প্রয়োজনের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ এপিআই দেশেই তৈরি সম্ভব।
বিআইএমএর সভাপতি এস এম সাইফুর রহমান বলেন, ‘ভারত, চীন, সিঙ্গাপুর—প্রতিটি দেশ এই শিল্পকে নিরাপত্তা দিয়েছে, ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা দিয়েছে। আমাদের তা দিতে হবে। পাশাপাশি নমুনা পরীক্ষা ও অনুমোদনপ্রক্রিয়া সহজ করতে হবে। ওষুধশিল্পের যে অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের আছে, তা এই শিল্পকে দৃঢ় ভিত্তি দিতে সহায়তা করবে।’
পড়ে আছে জমি
২০০৮ সালে সরকার বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) মাধ্যমে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় ২০০ একর জমি বরাদ্দ দেয় এপিআই শিল্প গড়ে তোলার জন্য। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে বাউসিয়া এলাকায় এই প্রকল্পের নাম রাখা হয় ‘এপিআই শিল্পপার্ক’। স্থানীয় বিসিক কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, জমিটি ৪২টি প্লটে ভাগ করে ২৭টি ওষুধ কোম্পানির মধ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিছু কোম্পানি একাধিক প্লট পেয়েছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় ওষুধ কোম্পানিগুলোরও এখানে প্লট রয়েছে।
১১ ফেব্রুয়ারি এপিআই শিল্পপার্কে গিয়ে দেখা যায়, শিল্প গড়ে ওঠার কোনো লক্ষণ নেই। সিংহভাগ জমি পড়ে আছে। ঝোপঝাড়ে ভরা। চারটি প্রতিষ্ঠান অবকাঠামো গড়ে তুলেছে। এগুলো হলো হেলথকেয়ার কেমিক্যালস, এক্মি, ইউনিমেড ইউনিহেলথ ও ইবনে সিনা। এর মধ্যে হেলথকেয়ার কেমিক্যালস ও এক্মি এপিআই তৈরি করছে। ইউনিমেড ইউনিহেলথ ও ইবনে সিনা খুব শিগগির এপিআই তৈরি শুরু করবে।
ইবনে সিনার জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক ও এপিআই প্ল্যান্টের প্রধান মো. শামসুল আলম জানিয়েছেন, এপিআই শিল্পপার্কে প্লট নেওয়া ব্যবসায়ীরা তিনটি বড় সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। প্রথমত, এপিআই উৎপাদনের জন্য ২৪ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রয়োজন, কিন্তু শিল্পপার্ক এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ অনিয়মিত, ভোল্টেজও কম থাকে। দ্বিতীয়ত, পার্ক এলাকায় এখনো গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়নি। তৃতীয়ত, ছাড়পত্রের জটিলতা বড় বাধা। একটি এপিআই কারখানার জন্য ১৮ থেকে ২০ ধরনের ছাড়পত্র লাগে, যা পেতে বিভিন্ন দপ্তরে মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হয়।
বিশিষ্ট ওষুধবিজ্ঞানী ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান বলেছেন, বর্তমান সরকার সর্বক্ষেত্রে স্বাবলম্বিতা অর্জনে গুরুত্ব দিচ্ছে এবং পরনির্ভরতা কমানোকে অগ্রাধিকারের তালিকায় রেখেছে। ওষুধ খাতে স্বনির্ভরতা বাড়াতে দেশে এপিআই উৎপাদনের কোনো বিকল্প নেই। বিশেষ করে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের এপিআই তৈরিতে গুরুত্ব দেওয়া হবে। এ জন্য শিল্পের নিরাপত্তা ও প্রয়োজনীয় প্রণোদনা দেওয়া হবে।