এস আলম : ২ এলসিতেই পাচার ১০ হাজার কোটি টাকা

২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে এস আলম গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এসএস পাওয়ার লিমিটেড বাংলাদেশ থেকে ৮১৫ দশমিক ৭৮ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে; খালি করেছে দেশের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। দুটি এলসি, ১৮৪টি ভুয়া চালান। ব্যস, পাচার হয়ে গেল টাকা। এভাবেই ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে এস আলম গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এসএস পাওয়ার লিমিটেড বাংলাদেশ থেকে ৮১৫ দশমিক ৭৮ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে; খালি করেছে দেশের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।

এসএস পাওয়ার চট্টগ্রামে তাদের এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি করতে এলসিগুলো খুলেছিল। কিন্তু, এসব এলসির বিপরীতে একটি পণ্যও বাংলাদেশে আসেনি। তারপরও টাকা চলে গেছে দেশের বাইরে। এস আলম গ্রুপের দুর্নীতি দ্য ডেইলি স্টারের এক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, দুটি এলসিই খোলা হয়েছিল রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের মতিঝিল শাখা থেকে। রূপালী ব্যাংকের দেওয়া ভুয়া চালানসহ বিভিন্ন নথির বিপরীতেই এসএস পাওয়ারের চীনা অংশীদার সেপকোর কাছে অর্থ স্থানান্তর করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

S Alam LCC

গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে বড় আকারে অর্থপাচারের বিষয়ে প্রতিবেদন হয়েছে। তবে এই প্রথমবারের মতো পেপার ট্রেইল অনুসরণ করে অর্থপাচারের জন্য কীভাবে এলসি ব্যবহার করা হয়েছে, তার প্রামাণ্য নথি সংগ্রহ করেছে দ্য ডেইলি স্টার।

এসব নথি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এসএস পাওয়ার অর্থপাচারের ঘটনা আড়াল করতে অন্য কোম্পানির আমদানি চালান, ভুয়া নথি, ২০২৫ সালের তারিখের আমদানি চালান, সংশ্লিষ্ট নয় এমন আমদানি অনুমতিপত্র (আইপি), এমনকি আমদানির জায়গায় রপ্তানি চালান দেখিয়েছে। এসএস পাওয়ারের চিফ ফাইন্যান্সিয়াল অফিসার এবাদত হোসেন ভূঁইয়া এই দুটি এলসির বিপরীতে অর্থপাচারের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।

S Alam

গত ২৩ সেপ্টেম্বর টেলিফোনে তিনি বলেন, ‘আমাদের চীনা অংশীদারের (সেপকো) কাছ থেকে নেওয়া ঋণের মাধ্যমে এই আমদানির অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে। এসব পণ্য ঋণ চুক্তির আওতায় আনা হয়েছে, যার বিপরীতে কোনো অর্থ বাংলাদেশ থেকে পরিশোধ করতে হয়নি।’ এর পাশাপাশি এ বিষয়ে কথা বলতে রূপালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন তিনি।

রূপালী ব্যাংকের মতিঝিল শাখার মহাব্যবস্থাপক আবু নাসের মোহাম্মদ মাসুদ নিশ্চিত করেছেন, কোনো দেশি বা বিদেশি ঋণ চুক্তির আওতায় এই আমদানির অর্থ পরিশোধ করা হয়নি। তিনি বলেন, ‘দুটি এলসির মোট মূল্য ছিল প্রায় ৯১৪ মিলিয়ন ডলার। যার মধ্যে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৮১৫ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়েছে।’ পণ্য না এলেও চলে গেছে ৮১৫ মিলিয়ন ডলার

২০১৬ সালে চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার এসএস পাওয়ার লিমিটেডের বিদ্যুৎকেন্দ্রটি যৌথভাবে উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। এসএস পাওয়ার ও সেপকোর যৌথ উদ্যোগে স্থাপিত এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ৭৫ শতাংশ বা দুই দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার ঋণ হিসেবে দিয়েছে বেইজিং। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ২০২৩ সালে উৎপাদন শুরু করে।

প্রশ্নবিদ্ধ এলসি দুটি এই প্রকল্পের জন্য জেনারেটর, ট্রান্সফরমার, স্টিল স্ট্রাকচার, রি-হিটার সিস্টেম ইত্যাদির মতো গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি ‘আমদানি’র জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধার আওতায় খোলা হয়েছিল। কিন্তু নথি থেকে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার হাতিয়ে নিয়ে তা অন্য দেশে পাচার করতেই এই এলসি দুটি ব্যবহার করা হয়েছে। ১২১ দশমিক ৯৫ মিলিয়ন ডলার মূল্যের প্রথম এলসি ২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারি মতিঝিলে রূপালী ব্যাংকের লোকাল শাখায় খোলা হয়েছিল, যার নম্বর ০০০০০২৬৩১৯১৫০০০৫।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভারে থাকা রেকর্ড অনুযায়ী, এই এলসির বিপরীতে প্রথমে ২০১৯ সালের ২৭ মে তিন লাখ ৭১ হাজার ৮৭৩ ডলার দেওয়া হয়, যার চালান নম্বর ৮৭৩৬৭০ এবং ২০২৩ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি সর্বশেষ পাঁচ লাখ ৭৬ হাজার ৫৬৯ ডলার পরিশোধ করা হয়, যার চালান নম্বর ২৩০২৬১। বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নথি অনুযায়ী, এই সময়ের মধ্যে এসএস পাওয়ারের চীনা অংশীদার সেপকো ইলেকট্রিক পাওয়ার কনস্ট্রাকশন করপোরেশনের অ্যাকাউন্টে আরও ১২ কোটি চার লাখ ৯৮ হাজার ৪৩০ ডলার পাঠানো হয়েছে।

S Alam LC

দ্বিতীয় এলসি খোলা হয় ২০২১ সালের ৩০ মে। ৭৯২ দশমিক ৪০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের এই এলসিটিও খোলা হয়েছিল মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য। ০০০০০২৬৩২১১৫০০৩৮ নম্বরের এই এলসিটিও রূপালী ব্যাংকের একই শাখায় খোলা হয়েছে। ২০২১ সালের ১৫ জুন থেকে ২০২২ সালের ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে ভুয়া বিল অব এন্ট্রি ব্যবহার করে এই এলসির বিপরীতে ৬৯৮ দশমিক ৩৩ মিলিয়ন ডলার দেশ থেকে বের করে নেওয়া হয়েছে। নথি থেকে দেখা যায়, দুটি এলসির ৯১৪ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে প্রায় ৯৯ মিলিয়ন ডলার এখনো ব্যয় করা হয়নি।

এ বিষয়ে সেপকোর মন্তব্য জানতে চেয়ে ইমেইল করলেও তার জবাব দেয়নি প্রতিষ্ঠানটি। বাংলাদেশে কোম্পানিটির দুই প্রতিনিধির মোবাইল নম্বর গত তিন দিনে বন্ধ পাওয়া গেছে। এই ৮১৫ মিলিয়ন ডলার পাচারের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভারে মোট ১৮৪টি ভুয়া চালান (বিল অব এন্ট্রি) আপলোড করা হয়েছে—প্রথম এলসির জন্য ৫৯টি এবং দ্বিতীয় এলসির জন্য ১২৫টি।

এই চালানগুলোর প্রতিটি এনবিআরের সার্ভারের তথ্যের সঙ্গে মিলিয়েছে। দেখা গেছে, সেগুলো মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য এসএস পাওয়ারের খোলা এলসি দুটির সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। গত ২৯ আগস্ট চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস কমিশনার মোহাম্মদ ফয়জুর রহমান বলেন, ‘এই এলসি দুটির বিপরীতে আমাদের সার্ভারে কোনো আমদানি তথ্য নেই।’ ফয়জুর রহমান বর্তমানে ঢাকা (দক্ষিণ) কাস্টমস এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট কমিশনারেটের কমিশনার। টাকা পাচারে রূপালী ব্যাংকের ভূমিকা। তাহলে দেশের টাকা কীভাবে গেল বাইরে? এর উত্তর পাওয়া সম্ভব রূপালী ব্যাংকের কাছে।

এনবিআর সার্ভারে যখনই কোনো আমদানি-রপ্তানি তথ্য আপলোড করা হয়, সেটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভারে আপলোড হয়ে যায়। কিন্তু এসএস পাওয়ারের ক্ষেত্রে এনবিআর কোনো আমদানি তথ্য আপলোড না করলেও ১৮৪টি চালান বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভারে আপলোড হয়ে গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ অপারেশন শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সাধারণত, কাস্টমস কর্মকর্তারা এনবিআর সার্ভারে আমদানি তথ্য আপলোড করেন। তবে, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো আমদানিকারকের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করার পরেও এই তথ্য আপলোড করতে পারে।’ গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার অনুমতি না থাকায় নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই কর্মকর্তা জানান, এ ক্ষেত্রে রূপালী ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে এসব চালানের তথ্য আপলোড করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততা ছাড়া এই কাজ করা সম্ভব না।’ প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, আমদানিকারকের ব্যাংক থেকে আমদানি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়া এবং স্থানীয় মুদ্রায় ব্যাংকে আমদানি মূল্য জমা হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক এলসি পেমেন্ট ক্লিয়ার করে। এটি অনলাইনে করা সম্ভব।

নথিপত্রে দেখা যায়, চীনা কোম্পানিকে ডলার পরিশোধের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রয়োজনীয় তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভারে আপলোড করেছিল রূপালী ব্যাংক। এর মধ্যে রয়েছে ১৮৪টি ভুয়া চালান। এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, ১৮৪টির মধ্যে ৮৮টি চালান এসএস পাওয়ার ও সেপকোর এই যৌথ উদ্যোগের সঙ্গে সম্পর্কিত নয় এমন ৫০টি কোম্পানির। এসব চালানের বিপরীতে এনবিআর সার্ভারের রেকর্ডে থাকা এলসি নম্বর, আমদানির তারিখ ও রপ্তানিকারক সংস্থাও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভারে আপলোড করা সংশ্লিষ্ট ডেটার সঙ্গে মেলে না। এমনকি এর মধ্যে অন্তত একটি চালানে তারিখ দেওয়া হয়েছে ২০২৫ সালের। অন্তত ৩০টি চালান আমদানি নয়, বরং রপ্তানি সংশ্লিষ্ট। এগুলো এমন কোম্পানির চালান যার সঙ্গে এসএস পাওয়ারের কোনো সম্পর্ক নেই। অবশিষ্ট ৯৬টি চালান এসএস পাওয়ারের সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু এই পণ্যগুলো আগের অন্তত সাতটি ভিন্ন আমদানি অনুমতি (আইপি) ব্যবহার করে আমদানি করা হয়েছে এবং সেগুলোর সঙ্গে এই দুটি এলসির কোনো সম্পর্ক নেই। সাধারণত, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বৈদেশিক ঋণ চুক্তি বা ব্যাক-টু-ব্যাক এলসির বিপরীতে আমদানির জন্য আইপি দেয়। এই সাতটি আইপির মধ্যে দুটির কপি রয়েছে, যেখানে চারটি শর্তে দেওয়া হয়েছে।

প্রথম শর্তে বলা হয়েছে, ‘এই আমদানিতে বাংলাদেশের উৎস হতে কোন বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করা যাবে না।’ এর অর্থ হলো, যে সাতটি আইপি ব্যবহার করে এই ৯৬টি চালান দেখানো হয়েছে সেই চালানগুলো আসল হলেও আইপি শর্ত লঙ্ঘন করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখাকে এ সম্পর্কিত কিছু নথি পাঠিয়েছে দ্য ডেইলি স্টার। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা এসব তথ্য যাচাই করব এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলব। তারপর এ নিয়ে মন্তব্য জানাতে পারব।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!