এস আলম: আমদানি না করেই পাচার ১৬ কোটি টাকা

এলসি কেলেঙ্কারি

চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপের বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির নামে টাকা পাচারের অভিযোগ পাওয়া গেছে। গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানির নামে এলসি খুলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রায় দেনা শোধ করা হয়েছে। কিন্তু পণ্য দেশে আনা হতো না। এভাবে দেশ থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা পাচারের ঘটনা শনাক্ত হয়েছে। পাচারের এসব ঘটনা ঘটেছে ইসলামী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার করা হয়েছে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে। এসব ঘটনা ঘটেছে ২০১৮ সালের শুরু থেকে ২০২২ সালের শেষ পর্যন্ত সময়ে। আরও তথ্য উদ্ঘাটিত হচ্ছে। পাচার করা টাকার সুবিধাভোগীদের মধ্যে তৃতীয় পক্ষও রয়েছে। একাধিক সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

সূত্রমতে, সিআইডি এস আলম গ্রুপের ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ তদন্ত করছে। তিনটি পন্থায় এস আলম গ্রুপ এসব অর্থ পাচার করেছে। পণ্যের মূল্য বেশি দেখিয়ে, এলসিতে উল্লিখিত পরিমাণের চেয়ে কম পণ্য আমদানি করে, আমদানি পণ্য দেশে না এনে এসব পাচার কবা হয়েছে।

সূত্র জানায়, এস আলম গ্রুপের টাকা পাচারের সিংহভাগই ঘটেছে আমদানির মাধ্যমে। এক্ষেত্রে টাকা পাচারের জন্য বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করা হয়েছে। আমদানির জন্য ব্যাংকে এলসি খোলা হয়েছে। কিন্তু পণ্য দেশে আসেনি। অথচ এর বিপরীতে এলসির বকেয়া দেনা পরিশোধ করা হয়েছে। এলসির পরিমাণের চেয়ে কম পণ্য দেশে এনে, আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে পণ্যের দাম বেশি দেখিয়ে টাকা পাচার করা হয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ এলসি খোলা হয়েছে অফশোর ব্যাংকিংয়ের আওতায় বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নিয়ে। এতে এস আলম গ্রুপ দেশকে বহুমুখী দায়ে আবদ্ধ করে ক্ষতিগ্রস্তকরেছেন। একদিকে চড়া সুদের বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে। এতে রিজার্ভে চাপ বাড়ছে। আমদানি পণ্য দেশে না আসায় উৎপাদন বাড়েনি। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জিডিপির প্রবৃদ্ধি। কর্মসংস্থানে পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। পণ্য দেশে না আসায় ওইসব অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। এতে দেশের সম্পদ চলে গেছে বাইরে। যা দেশের অর্থনীতিকে দুর্বল করেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭ সাল থেকেই এস আলম গ্রুপ অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ গ্রহণ শুরু করে। ইসলামী ব্যাংক থেকে গ্রুপটি ১৫০ কোটি ডলার বৈদেশিক ঋণ নিয়ে এলসি খুলেছে। ২০২২ সাল পর্যন্ত তারা ওইসব ঋণ নিয়েছে। এসব ঋণে বিভিন্ন সময় পণ্য আমদানির এলসি খোলা হয়েছে। ওইসব এলসির অর্ধেক পণ্যই দেশে আসেনি। ফলে এর মাধ্যমে ৭৫ কোটি ডলার (প্রতি ডলারের গড় দাম ১০০ টাকা হিসাবে) বা সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা গ্রুপটি দেশ থেকে পাচার করেছে। কিছু পণ্য দেশে আসলেও সেগুলো বিক্রি করে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করা হয়নি। ফলে নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংক বাধ্য হয়ে এস আলম গ্রুপের নামে ফোর্স সৃষ্টি করে বিদেশি ব্যাংকের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের কথা। কিন্তু ব্যাংক এস আলম গ্রুপের নামে ফোর্স লোন সৃষ্টি করেনি। তারা নিয়মিত ঋণ সৃষ্টি করে ওইসব দেনা শোধ করেছে। এভাবে ব্যাংকে এস আলম গ্রুপের দেনা বেড়েছে। কিন্তু সেগুলো কখনোই শোধ করা হয়নি। ইসলামী ব্যাংকে আমদানি খাতে এমন প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ এখন পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছে। এসব ঋণের একটি অংশও বিদেশে পাচার করা হয়েছে। ব্যাংকে এসব অনিয়ম করতে তাদের সহায়তা করেছে এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদের ব্যক্তিগত পিএস ও ইসলামী ব্যাংকের বরখাস্তকৃত ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর আকিজ উদ্দিনসহ তার সহযোগী অন্যান্য কর্মকর্তারা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি তদন্ত প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ন্যাশনাল ব্যাংকের চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে এস আলম গ্রুপের সহযোগী ও বেনামি প্রতিষ্ঠান নাফ ট্রেডিংয়ের নামে ৬৫০ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে দেশে কোনো পণ্য আসেনি। এলসির মাধ্যমে ওইসব টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। বেআইনিভাবে প্রভাব খাটিয়ে এসব ঋণ নেওয়া হয়েছে। ঋণের টাকা ঘোষিত ব্যবসায় বিনিয়োগ না করে নিয়মবহির্ভূতভাবে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রামের নাফ ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ আখতার ফারুককে প্রতিষ্ঠানের ঠিকানায় পায়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক দল। তদন্তের সময় সরেজমিন পরিদর্শন করে প্রতিষ্ঠানটিরও কোনো অস্তিত্বও পায়নি পরিদর্শক দল। বিভিন্ন ব্যাংকের কাগজে-কলমে প্রতিষ্ঠানটি খাদ্যপণ্য আমদানির ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে তথ্য রয়েছে।

সরকারি খাতের জনতা ব্যাংকের মাধ্যমেও এস আলম গ্রুপের আমদানি বাণিজ্য পরিচালিত হয়েছে। এ ব্যাংকে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা আমদানি বাবদ নেওয়া হয়েছে। এসব এলসির মধ্যে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার পণ্য দেশে আসেনি। ব্যাংকে তাদের মোট ঋণের স্থিতি ৯ হাজার ৮২২ কোটি টাকা। এসব ঋণের একটি বড় অংশই পাচার করে দেওয়া হয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। এস আলম গ্রুপ এক্সিম ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি খুলেও গ্রুপটি প্রায় ২০০ কোটি টাকার পণ্য দেশে আনেনি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। রূপালী ব্যাংকের মাধ্যমেও প্রায় শতকোটি টাকার পণ্য দেশে না আসার অভিযোগ রয়েছে।

অপরদিকে, এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদসহ তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাবের তথ্য তলব করেছে বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইইউনিট (বিএফআইইউ)। সেসব তথ্য ইতোমধ্যে চলে এসেছে। এখন সেগুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। পাশাপাশি এস আলম গ্রুপের বিভিন্ন স্বনামি ও বেনামি কোম্পানির ব্যাংক হিসাবের লেনদেনের তথ্য পর্যালোচনা করা হচ্ছে।

একাধিক সূত্রমতে, এস আলম গ্রুপের বিভিন্ন ব্যাংক ও ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোতে ঋণের পরিমাণ ১ লাখ কোটি টাকার বেশি। এসব ঋণের বড় অংশই তিনি বিদেশে পাচার করেছেন। পাচার করা অর্থে সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সাইপ্রাসে বিনিয়োগ করেছেন। এস আলম ও তার পরিবারের সদস্যরা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বাদ দিয়ে সাইপ্রাসের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন। সে দেশের নাগরিকত্ব পেতে হলে কমপক্ষে ২৫ লাখ ইউরো বা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রতি ইউরো ১৩০ টাকা হিসাবে ৩২ কোটি ৫০ লাখ ডলার বিনিয়োগ করতে হতো। এক্ষেত্রে তারা কোনো প্রশ্ন করত না। ফলে দুর্নীতিবাজদের অর্থ পাচারের স্বার্গরাজ্য হয়ে ওঠে দেশটি। এস আলম গ্রুপও সেই সুযোগে ওই পরিমাণ বা তারচেয়ে বেশি অর্থ বিনিয়োগ করে প্রথমে দেশটির নাগরিকত্ব নিয়েছেন। পরবর্তীতে তিনি দেশটিতে আরও বেশি বিনিয়োগ করেছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে দেশটি ২০১৩ সালে এই নিয়ম চালু করেছিল। ২০২০ সালে এ নিয়ে তীব্র সমালোচনার সুখে পড়ে আইনটি বাতিল করে দেয়। দেশ থেকে পাচার করা অর্থে সাইফুল ইসলাম মাসুদ সিঙ্গাপুরে একাধিক বিলাসবহুল হোটেল ব্যবসা পরিচালনা করছেন। এছাড়া তার কয়েকটি বাড়িও রয়েছে দেশটিতে।

***

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!