স্বৈরাচারী সরকারের শেষ সময়ে ইসলামী ব্যাংক খাতে এক আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেছিলেন আকিজ উদ্দিন। তিনি শীর্ষ ব্যাংক লুটেরা এস আলমের ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সরকারের উচ্চ মহলের নির্দেশে, পলাতক বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার তাকে ইসলামী ব্যাংকের ডিএমডি পদে নিয়োগ দেন। আকিজ উদ্দিন একমাত্র সৌভাগ্যবান ব্যক্তি ছিলেন যিনি এই পদে নিয়োগপত্র গ্রহণ করেছিলেন। এরপর, তিনি গভর্নরের বাসায় নিয়মিত আড্ডায় মেতে থাকতেন। এস আলমের দখল করা আটটি ব্যাংক থেকে বিভিন্ন কৌশলে অর্থ বের করে এস আলম ও সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের সরবরাহ করতেন, পাশাপাশি নিজেও অর্থ হাতিয়ে নিতেন। বর্তমানে আকিজ উদ্দিন ও তার বেনামি ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলোর স্থিতি ১ হাজার ২৬৬ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। এছাড়া, সন্দেহজনক লেনদেনের পরিমাণ আরো কয়েক হাজার কোটি টাকা হয়েছে, যা একটি আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
যেভাবে অনুসন্ধানের সূত্রপাত
অধ্যয়ন শুরু হয় সোনালী ব্যাংকের চট্টগ্রাম পাঁচলাইশ শাখার গ্রাহক ‘আলম ট্রেডিং এন্ড বিজনেস হাউস’ নামক প্রতিষ্ঠানের হিসাব (নং-১০১৫৭-২০০১১৫৯) থেকে, যেখানে অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়। এই হিসাবের সূত্র ধরে অনুসন্ধানে নেমে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা লক্ষ্য করেন যে, প্রতিষ্ঠানটি রড, সিমেন্ট ও সিআই শীট বিক্রেতা হিসেবে নিবন্ধিত। হিসাব খোলার সময় এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যানের পিএস এবং ইসলামী ব্যাংকের সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আকিজ উদ্দিনের সাথে পরিচয়ের মাধ্যমে এই হিসাবটি খোলা হয়, যেখানে আকিজ উদ্দিনের ফোন নম্বরও ব্যবহার করা হয়েছিল।
অনুসন্ধানে আরও বেরিয়ে আসে যে, আকিজ উদ্দিনের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন তফসিলি ব্যাংকে বেশ কিছু হিসাব পরিচালনা করছিল। এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যানের পিএস হিসেবে আকিজ উদ্দিন তার প্রভাব বিস্তার করে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে বিনিয়োগ গ্রহণ, সিএসআর অর্থ আত্মসাত এবং বিভিন্ন উপায়ে হাজার কোটি টাকা অবৈধভাবে উত্তোলন করেন। এই সবকিছুর মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, আকিজ উদ্দিন ও তার সহযোগীরা ব্যাপক আর্থিক দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
তদন্ত টিমের অনুসন্ধানে জানা গেছে, আকিজ উদ্দিনের নিজ নামে বিভিন্ন ব্যাংকে মোট ১৩টি হিসাব এবং তার স্ত্রী রোকসানা খানমের নামে তিনটি হিসাব রয়েছে। এছাড়া আকিজের মা রাবিয়া খাতুনের নামে ৬টি, বোন হোসনে আরা বেগমের স্বামী নজরুল ইসলামের নামে ৪৬টি, অপর বোন শারমিন আকতারের স্বামী নাছির উদ্দিনের নামে ২৮টি এবং তার ভাই মুহাম্মদ সাইফু উদ্দীনের নামে ৯০টি হিসাব পাওয়া গেছে। আকিজ উদ্দিনের পিএস মো: সাদ্দাম হোসেন ও তার স্ত্রী মর্জিনা আক্তারের নামে মোট ৪৩টি হিসাব রয়েছে।
এই হিসাবগুলোতে জরুরি প্রয়োজনে আকিজ উদ্দিনের ফোন নম্বর (০১৯৮৫৫০৮০০০) উল্লেখ করা হয়েছে। তদন্তে আরও জানা যায় যে, কিছু ক্ষেত্রে আফিতা উদ্দিনের ব্যক্তিগত ফোন নম্বরও যোগাযোগের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। এসব হিসাবগুলোকে আকিজ উদ্দিনের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বেনামি হিসাব হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যা তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, আকিজ উদ্দিনের বেনামি অ্যাকাউন্ট নূরুল আলম, মুহাম্মদ মুশতাক মিঞা, নজরুল ইসলাম ও জিয়াউর রহমান সংশ্লিষ্ট হিসাবে জমা হয়েছে ৩৮৬ কোটি ২ লাখ টাকা, আকিজ উদ্দিন ও তার স্ত্রী রোকসানা খানম সংশ্লিষ্ট হিসাবে স্থিতি রয়েছে ৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা। আকিজ উদ্দিনের পিএস সাদ্দাম হোসেন ও তার স্ত্রী মর্জিনা বেগম সংশ্লিষ্ট হিসেবে স্থিতি রয়েছে ১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা , আলমাস আলী ও বেদারুল ইসলাম সংশ্লিষ্ট হিসেবে স্থিতি রয়েছে ৮০০ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। সাইফু উদ্দিন, গোলামুর রহমান ও রাবেয়া খাতুন সংশ্লিষ্ট হিসাবগুলোতে স্থিতি রয়েছে ৭৫ কোটি ৫৮ লাখ টাকা।
জানা গেছে, এসব অ্যাকাউন্টগুলোতে জরুরি প্রয়োজনে যোগাযোগ করতে মোবাইল নম্বর দেয়া হয়েছে আকিজ উদ্দিনের ব্যাক্তিগত মোবাইল নম্বার। ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, স্যোসাল ইসলামী ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নানা কৌশলে অর্থ বের করে এস আলমকে সরবরাহ করা হয়। একই সাথে পতিত সরকারের বিভিন্ন মহলসহ শীর্ষ মহলকে সরবরাহ করার পাশাপাশি নিজেও কিছু অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। আর এতেই তার ব্যাংক হিসাবে কয়েক হাজার কোটি টাকার অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।
তদন্তে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে নিবন্ধিত ‘আলম ট্রেডিং এন্ড বিজনেস হাউস’ নামক প্রতিষ্ঠানটির মালিক নুরুল আলম। প্রতিষ্ঠানটি রড, সিমেন্ট এবং সি.আই শিট বিক্রি করে এবং এর ঠিকানা গোলসেন পার্ক, রাজা মহাজন লেন, চট্টগ্রামে অবস্থিত। সোনালী ব্যাংক পিএলসির পাঁচলাইশ শাখার ওই প্রতিষ্ঠানের নামে খোলা হিসাবের ফরমে যোগাযোগের জন্য আকিজ উদ্দিনের ফোন নম্বর (০১৯৮৫৫০৮০০০) উল্লেখ করা হয়েছে, যা প্রমাণিত করে যে এটি আকিজ উদ্দিনের বেনামি প্রতিষ্ঠান।
এছাড়া, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে নিবন্ধিত ‘নজরুল এন্টারপ্রাইজ’ নামক প্রতিষ্ঠানটি মো: নজরুল ইসলামের মালিকানাধীন, যিনি আকিজ উদ্দিনের বোন হোসনে আরা বেগমের স্বামী। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসা ঠিকানা পুরানা পল্টন, শাওন টাওয়ার, ঢাকা হলেও চট্টগ্রামের বিভিন্ন ব্যাংক শাখায় হিসাব খুলে লেনদেন পরিচালনা করেছে, যা অস্বাভাবিক বলে প্রতীয়মান হয়েছে। রূপালী ব্যাংকের শাখায় খোলা হিসাবের ফরমে যোগাযোগের জন্য উল্লেখ করা ফোন নম্বরটি আকিজ উদ্দিনের ব্যক্তিগত ফোন নম্বর (০১৮৩৫২৬৬১৫৫), যা প্রতিষ্ঠানের নামসর্বস্ব প্রকৃতির কথা নির্দেশ করে।
এ বিষয়ে আকিজ উদ্দিনের বক্তব্য জানতে মোবাইল নম্বারে (০১৯৮৫৫০৮০০০) যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু কয়েকবার রিং হলেও তা কেউ রিসিভ করেননি।
** সূত্র নয়া দিগন্ত