## ৮ লাখ ২৩ হাজার ২৫৯ কেজি কাঁচামাল অপসারণ করে খোলাবাজারে বিক্রি করা হয়েছে
## আমদানি করা কাঁচামালে শুল্ককর ফাঁকি দিয়েছে ৩ কোটি ৩১ লাখ ৭৮ হাজার ৭৫৮ টাকা
## দুইবার পরিদর্শনে গিয়ে প্রতিষ্ঠান বন্ধ পেয়েছেন কর্মকর্তারা, কাঁচামাল দেখাতে রাজি হয়নি প্রতিষ্ঠান
শাহেদ রাসেল, বিশেষ প্রতিবেদক: বন্ড সুবিধায় দুই চালানেই আমদানি হয়েছে এক লাখ ২০ হাজার কেজি ডুপ্লেক্স বোর্ড ও এলএলডিপিই। কিন্তু সেই বোর্ডের আর হদিস নেই। আবার এলডিপিই, এলএলডিপি, ডুপ্লেক্স বোর্ড, এইচডিপিই, আর্ট কার্ড, লিনার পেপার আমদানি হয়েছে প্রায় সাত লাখ কেজি। সেই কাঁচামালেরও কোন হদিস নেই। এসব কাঁচামাল দিয়ে পণ্য তৈরি করে রপ্তানি করা হয়নি। প্রতিষ্ঠান রয়েছে বন্ধ। শুল্ককর ফাঁকি দিয়ে মোট ৮ লাখ ২৩ হাজার ২৫৯ কেজি কাঁচামাল খোলাবাজারে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। বন্ড লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গ ও বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করায় এসএম এন্টারপ্রাইজ নামের এই প্রতিষ্ঠানকে প্রায় পৌনে সাত কোটি অর্থদণ্ড দেয়া হয়েছে। হবিগঞ্জ বিসিক শিল্পনগরীর এই প্রতিষ্ঠানকে সম্প্রতি বিচারাদেশে অর্থদণ্ড দিয়েছেন সিলেট কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনার। এনবিআর সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
সূত্রমতে, হবিগঞ্জ ধুলিয়াখাল বিসিক শিল্পনগরী এলাকার প্রতিষ্ঠান মেসার্স এসএম এন্টারপ্রাইজ এর বিরুদ্ধে বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের অভিযোগ থাকায় তা খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নেয় সিলেট ভ্যাট কমিশনারেট। ভ্যাট কমিশনারেটে থাকা প্রতিষ্ঠানের বন্ড রেজিস্টার ও সিআইএস সেলের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি ২০১৯ সালের ২৪ নভেম্বর বন্ড সুবিধায় ৪৯ হাজার ৫০০ কেজি এলএলডিপিই আমদানি করা হয়েছে। এ ছাড়া ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি আমদানি করা হয়েছে ৭০ হাজার ৫০৫ কেজি ডুপ্লেক্স বোর্ড। কিন্তু দুই চালানে আমদানি করা এক লাখ ২০ হাজার ৫ কেজি কাঁচামাল বন্ড রেজিস্টারে এন্ট্রি করা হয়নি। ভ্যাট কর্মকর্তারা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে গেলেও প্রতিষ্ঠানের সত্ত্বাধিকারী বন্ডেড ওয়্যারহাউজ দেখাতে সম্মত হয়নি। এমন কি এই কাঁচামাল দিয়ে পণ্য তৈরি করে রপ্তানি করা হয়েছে কিনা-তার কোন হিসাবও প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ দেয়নি। বন্ড সুবিধার এসব কাঁচামাল প্রতিষ্ঠান শুল্ককর ফাঁকি দিতে অবৈধভাবে অপসারণ করেছে। এই কাঁচামালের শুল্কায়নযোগ্য মূল্য এক কোটি ১৯ লাখ ৮ হাজার ৫৪৩ টাকা। যাতে প্রযোজ্য শুল্ককর ৪৬ লাখ ৪৪ হাজার ৫১৫ টাকা।
সূত্র আরও জানায়, বন্ড রেজিস্টারের অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানের ওয়্যারহাউজে মজুদ রয়েছে সাত লাখ ৩ হাজার ২৫৩ কেজি বিভিন্ন ধরনের কাঁচামাল। যার মধ্যে রয়েছে-৭৪ হাজার ৮০২ কেজি এলডিপিই, ৯৯ হাজার কেজি এলএলডিপিই, ৩ লাখ ৪৮ হাজার ৬২৬ কেজি ডুপ্লেক্স বোর্ড, ৪৯ হাজার ৫০০ কেজি এইচডিপিই, এক লাখ ২২ হাজার ১৯৫ কেজি আর্ট কার্ড, ৯ হাজার ১২৯ কেজি লিনার পেপার। এসব কাঁচামাল বন্ডেড ওয়্যারহাউজে মজুদ রয়েছে কিনা-তা খতিয়ে দেখতে দুইবার প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে যায় ভ্যাট কর্মকর্তারা। কিন্তু প্রতিবারই প্রতিষ্ঠান বন্ধ দেখতে পান কর্মকর্তারা। কর্মকর্তারা প্রতিষ্ঠানের সত্বাধিকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রতিষ্ঠান খুলে কাঁচামাল দেখানোর অনুরোধ জানায়। কিন্তু কর্মকর্তাদের দেখাতে সম্মত হয়নি তিনি। কর্মকর্তাদের ধারণা, প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ এসব কাঁচামাল অবৈধ অপসারণ করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। এই কাঁচামালের শুল্কায়নযোগ্য মূল্য ৬ কোটি ৭৪ লাখ ২৬ হাজার ৫৬৮ টাকা। যাতে প্রযোজ্য শুল্ককর দুই কোটি ৮৫ লাখ ৩৪ হাজার ২৪৩ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি সর্বমোট ৮ লাখ ২৩ হাজার ২৫৯ কেজি কাঁচামাল অবৈধভাবে অপসারণ করেছে। যার শুল্কায়নযোগ্য মূল্য সাত কোটি ৯৩ লাখ ৩৫ হাজার ১১২ টাকা। যাতে প্রযোজ্য শুল্ককর ৩ কোটি ৩১ লাখ ৭৮ হাজার ৭৫৮ টাকা। এই শুল্ককর পরিশোধ না করে প্রতিষ্ঠান ফাঁকি দিয়েছে। বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করায় প্রতিষ্ঠানকে দাবিনামা সংবলিত কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হয়।
প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ ২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর লিখিত জবাবে জানায়, ৪৯ হাজার ৫০০ কেজি এলএলডিপিই এবং ৭০ হাজার ৫০৫ কেজি ডুপ্লেক্স বোর্ড এর ডিও (বিএল) ব্যাংক থেকে নিতে না পারায় এসব কাঁচামাল কাস্টম হাউসে রয়েছে। প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব গুদামে আনা সম্ভব হয়নি বিধায় বন্ড রেজিস্টারে এন্ট্রি করা সম্ভব হয়নি। অন্য কাঁচামাল বিষয়ে জবাবে কিছু বলা হয়নি। তবে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ শুনানিতে অংশগ্রহণের অনুরোধ জানায়। সে অনুযায়ী চলতি বছরের ১১ জানুয়ারি শুনানির দিন ধার্য করা হয়। ওই দিন প্রতিষ্ঠানের কেউ শুনানিতে অংশ নেয়নি। পরে ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানকে সময় দেয়া হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের কেউ আবারো হাজির হয়নি। এভাবে চারবার সময় দেয়ার পরও শুনানিতে প্রতিষ্ঠানের কেউ অংশ নেয়নি। পরে প্রতিষ্ঠানের দলিলাদি ও বন্ড রেজিস্টারে প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা করে ২৫ মে সিলেট ভ্যাট কমিশনার বিচারাদেশ দেয়। যাতে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার প্রমাণিত হওয়ায় প্রতিষ্ঠানকে ৬ কোটি ৬৩ লাখ ৫৭ হাজার ৫১৮ টাকা অর্থদণ্ড দেয়া হয়েছে। অর্থদণ্ড ও শুল্ককরসহ মোট ৯ কোটি ৯৫ লাখ ৩৬ হাজার ২৭৭ টাকা পরিশোধে প্রতিষ্ঠানকে ১৫ দিনের সময় দেয়া হয়।
কাঁচামাল বিক্রির বিষয়টি অস্বীকার করেন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা এস হোসেন। তিনি বলেন, আমরা ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ। করোনার আগে আমরা কাঁচামাল আমদানি করেছি। এখনো আমাদের কাঁচামাল বন্দরে আটকে আছে। আমরা কোন কাঁচামাল বাইরে বিক্রি করিনি। তাহলে ভ্যাট কর্মকর্তাদের বন্ডেড ওয়্যারহাউজ দেখাননি কেন এবং কাঁচামালের হিসাব দেননি কেন-এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। আমি অসুস্থ ছিলাম। কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হলেও জবাব দেয়া হয়নি। চারবার শুনানিতে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হলেও কেন অংশগ্রহণ করেননি-এ বিষয়ে তিনি বলেন, আমি অসুস্থ ছিলাম। আমরা ইতোমধ্যে ভ্যাট কমিশনারেটের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। আমরা উচ্চ আদালতে রিট করবো।
###