এলসি খোলায় বিধিনিষেধ থাকছে না

পণ্য আমদানিতে ঋণপত্র (এলসি) খোলার সময় ন্যূনতম দর বা নগদ মার্জিন আর প্রযোজ্য থাকবে না। এটি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও)-এর বিধিবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্য না থাকার কারণে পুরোপুরি বাতিল করা হচ্ছে। এর ফলে যেকোনো আমদানিকারক যেকোনো পরিমাণ পণ্য আমদানি করতে এলসি খোলার সুযোগ পাবেন। নতুন তিন বছরের (২০২৫-২০২৮) আমদানি নীতি আদেশে এই নির্দেশনা অন্তর্ভুক্ত থাকবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে নীতির খসড়া প্রস্তুত করেছে এবং খসড়া তৈরির আগে বিভিন্ন চেম্বার ও অ্যাসোসিয়েশনের মতামত নেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, আগামী সপ্তাহের শুরুতে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের কাছে খসড়াটির মূল বিষয়গুলো উপস্থাপন করবেন। এরপর উপদেষ্টার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী সংশোধন করে আমদানি নীতির খসড়া চূড়ান্ত করা হবে। বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর সম্প্রতি জানান, খসড়া অনুমোদনের জন্য উপদেষ্টা পরিষদে পাঠানো হবে এবং এলসির পরিমাণ ও ন্যূনতম দর সম্পর্কিত বাধ্যবাধকতা আর থাকবে না—এ বিষয়ও নীতি আদেশে নির্দেশিত হবে।

বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের জন্য মাত্র ১৪ মাস বাকি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, তিন বছরের জন্য প্রস্তুত করা নতুন আমদানি নীতি আদেশে এই বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা হচ্ছে। বর্তমান আমদানি নীতি আদেশের (২০২১-২৪) মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২৪ সালের জুনে। নতুন আদেশ জারি না হওয়া পর্যন্ত বিদ্যমান আদেশই কার্যকর থাকবে। নতুন আদেশ জারি করার প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলছে। উল্লেখ্য, বিদ্যমান নীতি আদেশও তৈরি করা হয়েছিল পূর্ববর্তী (২০১৫-১৮) আদেশের নিয়মিত মেয়াদ শেষ হওয়ার প্রায় সাড়ে চার বছর পর, অর্থাৎ ২০২২ সালের মে মাসে।

নতুন নীতি আদেশের খসড়ায় হাইড্রোলিক হর্ন নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব রয়েছে। পাশাপাশি শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য হর্নের মাত্রা কমানোর কথাও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ অনুযায়ী, খসড়া আমদানি নীতি আদেশে হর্নের মাত্রা ১০০ ডেসিবেলের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, আমদানি করা খাদ্যদ্রব্যের ছাড়পত্র দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার অনুমোদিত গবেষণাগারের একটি তালিকা প্রযোজ্য হবে এবং মনুষ্য খাদ্যের মান যাচাইয়ের জন্য অভিন্ন মানদণ্ড নির্ধারণ করা হবে। নতুন নীতি খসড়ায় প্রথমবারের মতো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে পেট্রোকেমিক্যাল শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল ইথাইলিন ও প্রোপাইলিন। তবে এ ধরনের পণ্য আমদানির জন্য বিস্ফোরক পরিদপ্তর ও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক রাখা হয়েছে।

আমদানিনিষিদ্ধ পণ্য মিথাইল ব্রোমাইডের কারণে অস্ট্রেলিয়ায় চাল ও মসলা রপ্তানিতে সমস্যা দেখা দিয়েছে। গ্যাস সিলিন্ডার আমদানিতে আলাদা এইচএস কোড ব্যবহার, পরিবেশবান্ধবভাবে ব্যাটারি রিসাইক্লিং নিশ্চিত করার বিষয় এবং পুরোনো ব্যাটারি আমদানির অনুমতির প্রক্রিয়া নিয়েও জটিলতা রয়েছে। সূত্রগুলো জানায়, এসব সমস্যার সমাধান এবারের আমদানি নীতির মাধ্যমে আনা হবে। পাশাপাশি, পাম অলিন আমদানির ক্ষেত্রে বিএসটিআই থেকে মান উত্তীর্ণের প্রত্যয়নপত্র নেওয়ার বাধ্যবাধকতাও তুলে দেওয়া হতে পারে।

যেসব পন্য নিষিদ্ধ হতে পারে

নতুন আমদানি নীতির খসড়ায় সব ধরনের বর্জ্য পদার্থ আমদানি-নিষিদ্ধ করার কথা রয়েছে। এ তালিকায় আরও রয়েছে চিংড়ি, জীবিত শূকর ও শূকরজাত সব ধরনের পণ্য; পপি বীজ, পোস্তদানা, ঘাস, ঘন চিনি, কৃত্রিম শর্ষের তেল, রিকন্ডিশন্ড অফিস ইকুইপমেন্ট অর্থাৎ ফটোকপিয়ার, টাইপরাইটার, টেলেক্স, ফোন, ফ্যাক্স, পুরোনো কম্পিউটার, কম্পিউটারসামগ্রী ও পুরোনো ইলেকট্রনিকস সামগ্রী। নিষিদ্ধ পণ্যের তালিকায় আরও রয়েছে হাইড্রোলিক হর্নসহ ৭৫ ডেসিবেলের ঊর্ধ্ব মাত্রার সব হর্ন; বিভিন্ন রাসায়নিক কীটনাশক ও শিল্পজাত দ্রব্য অর্থাৎ এলড্রিন, ক্লোরডেন, ডিডিটি, ডাই-এলড্রিন, এনড্রিন, হেপ্টাক্লোর, মিরেক্স, টক্সফেন, হেক্সক্লোরোবেনজিন, পলিক্লোরিনেটেড বাই-ফিনাইল; পলি প্রোপাইলিন ও পলিথিন ব্যাগ; দুই স্ট্রোক ইঞ্জিন ও চেসিসবিশিষ্ট থ্রি-হুইলার যানবাহন অর্থাৎ টেম্পো, অটোরিকশা ইত্যাদি।

বাংলাদেশের সীমারেখা দেখানো হয়নি এমন মানচিত্র, চার্ট, ভৌগোলিক গ্লোব, হরর কমিকস, অশ্লীল বা নাশকতামূলক সাহিত্যপুস্তিকা, সংবাদ সাময়িকী, পোস্টার, ফটো, ফিল্ম, কাগজপত্র, অডিও-ভিডিও টেপ ইত্যাদি পণ্য আমদানি করা যাবে না। শর্ত সাপেক্ষে আমদানির সুযোগ মিলতে পারে সাড়ে ৪ সেন্টিমিটারের কম ব্যাস বা দৈর্ঘ্যের মাছ ধরার কারেন্ট জাল, পাঁচ বছরের বেশি পুরোনো গাড়ি, তিন বছরের বেশি পুরোনো এবং ১৬৫ সিসির ঊর্ধ্বে সব ধরনের মোটরসাইকেল, পাশাপাশি এলএনজি। সব ধরনের খেলনা ও বিনোদনমূলক পণ্য আমদানি করার ক্ষেত্রে শিশুর বয়স অনুযায়ী প্রযোজ্যতা উল্লেখ থাকতে হবে এবং প্লাস্টিকের খেলনার ক্ষেত্রে রপ্তানিকারক দেশের যথাযথ কর্তৃপক্ষের “স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়” সনদ থাকা বাধ্যতামূলক। এছাড়া, বেসামরিক বিমান বা হেলিকপ্টারও শর্ত সাপেক্ষে আমদানি করা যাবে।

পুরোনো জাহাজ আমদানির ক্ষেত্রে খসড়ায় উল্লেখ রয়েছে, যে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের প্রত্যয়নপত্র এবং আমদানিকারকের ঘোষণাপত্র থাকতে হবে, যাতে নিশ্চিত হয় কোনো বিষাক্ত বা বিপজ্জনক বর্জ্য পরিবহন করা হচ্ছে না। তবে সব ধরনের যুদ্ধজাহাজ কেবল প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় অনুমোদিত হতে পারবে এবং তরবারি, বেয়নেটসহ অন্যান্য পণ্য কেবল সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্রের ভিত্তিতে আমদানির সুযোগ থাকবে। চলচ্চিত্র আমদানির ক্ষেত্রে, বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথ প্রযোজনার সিনেমা ছাড়া উপমহাদেশীয় ভাষায় নির্মিত কোনো চলচ্চিত্র আমদানি করা যাবে না। তবে বাংলাদেশে নির্মিত চলচ্চিত্র, সাফটাভুক্ত দেশগুলোতে রপ্তানি করার বিপরীতে, তথ্য মন্ত্রণালয়ের অনাপত্তি সাপেক্ষে সমসংখ্যক চলচ্চিত্র আমদানির সুযোগ থাকবে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!