এলটিইউ’র ১১০ প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট সফটওয়্যার নিয়ে ‘তামাশা’

## ৫৪টি প্রতিষ্ঠান এনবিআরের তালিকাভুক্ত সফটওয়্যার কিনেছে, কিন্তু ব্যবহার করে না
## ৩৬টি প্রতিষ্ঠান নিজস্ব সফটওয়্যার ব্যবহার করে, কিন্তু এলটিইউকে একসেস দেয় না
## ছয়টি প্রতিষ্ঠান অনুমোদিত সফটওয়্যার ব্যবহার করলেও এলটিইউকে একসেস দেয় না

রাসেল মো. শাহেদ: গ্রুপ অব কোম্পানি বা বহুজাতিক কোম্পানি মানেই লেনদেন বেশি, ভ্যাট ফাঁকিও বেশি। আবার একগাদা হিসাবপত্র সংরক্ষণ করতে হয়। এসব কোম্পানির ফাঁকি রোধ ও হিসাবে স্বচ্ছতা আনতে উদ্যোগ নেয় এনবিআর। যাতে বছরে পাঁচ কোটি টাকার বেশি লেনদেনকারী কোম্পানিকে ভ্যাটের বিশেষ সফটওয়্যার ব্যবহারের নির্দেশ দেয়া হয়। কোম্পানির নিজস্ব সফটওয়্যার বা এনবিআরের তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান থেকে সফটওয়্যার নিতে বলা হয়। নির্দেশনা অনুযায়ী বেশিরভাগ বড় কোম্পানি সফটওয়্যার নিলেও ব্যবহার করে না। কিছু প্রতিষ্ঠান নিজস্ব তৈরি ও এনবিআরের তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান থেকে সফটওয়্যার নিলেও ভ্যাট কর্তৃপক্ষকে কোন একসেস দেয় না। ফলে এসব কোম্পানি ফাঁকি দিচ্ছে কিনা-তা খতিয়ে দেখার সুযোগ নেই। বড় কোম্পানিগুলোর ভাড়ামির কারণে সফটওয়্যার ব্যবহারের উদ্যোগ সফল হচ্ছে না মনে করে সংশ্লিষ্টরা। তবে এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, বড় কোম্পানিগুলোর হিসাবে স্বচ্ছতা এলে বছরে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত ভ্যাট আদায় সম্ভব।

এনবিআর সূত্রমতে, ২০১৮ সালে এনবিআর বড় কোম্পানিগুলোর হিসাবে স্বচ্ছতা আনা ও ভ্যাট ফাঁকি রোধে সফটওয়্যার ব্যবহারের উদ্যোগ নেয়। পাঁচ কোটি টাকার বেশি লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠানে এনবিআর অনুমোদিত বা পরীক্ষিত সফটওয়্যার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে ২০১৯ সালের ৩০ জুন এ-সংক্রান্ত আদেশ জারি করে এনবিআর। কোনো প্রতিষ্ঠান এ আদেশ অমান্য করলে নতুন ভ্যাট আইনের ৮৫ ধারা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে আদেশে বলা হয়। কিন্তু দুই বছরেও কোন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নজির নেই। দেশের বড় গ্রুপ অব কোম্পানি ও বহুজাতিক কোম্পানির বেশিরভাগই বৃহৎ করদাতা ইউনিটে (এলটিইউ) নিবন্ধিত। বর্তমানে এলটিইউতে ১১০টি ভ্যাট নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক লেনদেন ৫ কোটি টাকার উপরে। এনবিআরের নির্দেশনা অনুযায়ী, ১১০টি প্রতিষ্ঠানেরই ভ্যাট সফটওয়্যার ব্যবহার বাধ্যতামূলক। তবে বাস্তব চিত্র একেবারেই ভিন্ন। নামি ও স্বনামধন্য এসব প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগই সফটওয়্যার ক্রয় করলেও ব্যবহার করে না। আবার কিছু প্রতিষ্ঠান নিজস্ব সফটওয়্যার ব্যবহার করছে। কিন্তু এলটিইউকে একসেস দেয় না। সম্প্রতি এলটিইউ’র এক প্রতিবেদনে বড় ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর সফটওয়্যার নিয়ে ভাড়ামির চিত্র উঠে এসেছে।

এলটিইউ এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এলটিইউ এর আওতাধীন ১১০টি দেশি-বিদেশি কোম্পানি, গ্রুপ অব কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে সফটওয়্যার ব্যবহারকারী প্রতিষ্ঠান ৯০টি। আবার ৯০টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৫৪টি প্রতিষ্ঠান এনবিআরের তালিকাভুক্ত সফওয়্যার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান হতে সফটওয়্যার গ্রহণ করেছে বা কিনতে চুক্তিবন্ধ হয়েছে। ৫৪টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২০টি প্রতিষ্ঠান সফটওয়্যার ব্যবহার সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করেছে। যার মধ্যে ৬টি প্রতিষ্ঠান এলটিইউকে ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড দিয়েছে। ১৪টি প্রতিষ্ঠানের ইউজার আইডি নেই। ৩৪টি প্রতিষ্ঠান সুষ্ঠভাবে সফটওয়্যার ব্যবহার সম্পন্ন করেনি। ৩৬টি প্রতিষ্ঠান নিজস্ব সফটওয়্যার ব্যবহার করে। অবশিষ্ট ২০টি প্রতিষ্ঠান ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে দলিলাদি ও হিসাবপত্র সংরক্ষণ করে। ৩৬টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৭টি ব্যাংক, ৫টি হোটেল, ৪টি মোবাইল অপারেটর রয়েছে। বর্তমানে এনবিআরের তালিকাভুক্ত ৪০টি সফটওয়্যার নির্মাণ কোম্পানি রয়েছে। এলটিইউ সূত্র জানিয়েছে, প্রতিবেদন অনুযায়ী যেসব প্রতিষ্ঠান আদেশ অমান্য করে সফটওয়্যার ব্যবহার করছে না বা ব্যবহার করলেও একসেস দেয় না-তাদের বিরুদ্ধে অনিয়মের মামলা করছে এলটিইউ। একসেস দিতে এলটিইউ থেকে আদেশ জারি করা হবে।

তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান হতে সফটওয়্যার গ্রহণ বা চুক্তিকারী ৫৪টি প্রতিষ্ঠান হলো-এশিয়াটিক মাইন্ডশেয়ার, ট্রান্সকম বেভারেজ, নাবিস্কো বিস্কুট অ্যান্ড ব্রেড, অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ, সিয়াম সিটি সিমেন্ট, সেভেল সার্কেল বাংলাদেশ, হাইডেলবার্গ সিমেন্ট, ইউনিক সিমেন্ট, আকিজ সিমেন্ট, এটিআই সিরামিকস, বিএটিবি, ইউনাইটেড ঢাকা টোব্যাকো, ম্যারিকো বাংলাদেশ, এসিআই ফরমুলেশন, কোহিনুর কেমিক্যাল, ডেনিশ কনডেন্স মিল্ক, নিউজিল্যান্ড মিল্ক প্রোডাক্টস, নেসলে বাংলাদেশ, শবনম ভেজিটেবল অয়েল, বাংলাদেশ এডিবল ওয়েল, সিঙ্গার বাংলাদেশ, বাটা, সিলেট গ্যাসফিল্ড, রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস, রিলায়েন্স ইন্সুরেন্স, গ্রীন ডেল্টা ইন্সুরেন্স, পাইওনিয়ার ইন্সুরেন্স, বেক্সিমকো ফার্মা, সানোফি বাংলাদেশ, হেলথকেয়ার ফার্মা, স্কয়ার ফার্মা (দুইটি), একমি ল্যাবরেটরিজ, ইবনে সিনা ফার্মা, রেনাটা, এসকেএফ, ইনসেপ্টা ফার্মা. এসিআই লি., এরিস্টো ফার্মা, জেনারেল ফার্মা, ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল, নাভানা ফার্মা, প্যাসিফিক ফার্মা, নূভিস্তা ফার্মা, বম্বে সুইটস, আরবার পলিপ্যাক, বার্জার পেইন্টস, বসুন্ধরা পেপার মিলস (টিস্যু), জি-৪, এল এম এরিকসন, ইউনিলিভার, ওয়াসা, বিএটিবি (সাভার) ও পারটেক্স বেভারেজ লি.।

প্রতিবেদন অনুযায়ী ৫৪টি কোম্পানি এনবিআরের তালিকাভুক্ত যে সব কোম্পানি থেকে সফটওয়্যার গ্রহণ করেছে সেসব কোম্পানি হলো-এশিয়াটিক মাইন্ডশেয়ার ধ্রুপদী, ট্রান্সকম বেভারেজ ডিভাইন আইটি, পারটেক্স বেভারেজ ইউওয়াই সিস্টেম, নাবিস্কো বিস্কুট অ্যান্ড ব্রেড ফ্যাক্টরি ধ্রুপদী, বিএটিবি ইউওয়াই, ম্যারিকো সিম্ফনি সফটটেক, কোহিনুর কেমিক্যাল সিম্ফনি সফটটেক, ডেনিশ কনডেন্স মিল্ক ইউওয়াই, নিউজিল্যান্ড মিল্ক প্রোডাক্টস সিসনোভা ইনফরমেশন, শবনম ভেজিটেবল অয়েল সিম্ফনি সফটটেক, বাংলাদেশ এডিবল ওয়েল অ্যালাইড ইনফরমেশন টেকনোলজি, সিঙ্গার বাংলাদেশ ডিভাইন, বাটা সিম্ফনি সফটটেক, রিলায়েন্স ইন্সুরেন্স অ্যালাইড ইনফরমেশন, সানোফি ইউওয়াই সিস্টেম, হেলথকেয়ার ফার্মা ইউওয়াই, একমি ল্যাবরেটরিজ ধ্রুপদী, ইবনে সিনা ফার্মা ডব্লিউিইবিএনএস, রেনাটা এআরআরএ টেকনোলজি, এসকেএফ ইউওয়াই সিস্টেম, জেনারেল ফার্মা ধ্রুপদী, এবং মেরিকো, কোহিনূর কেমিক্যাল, শবনম ভেজিটেবল অয়েল, বাটা, বম্বে সুইটস, বার্জার পেইন্টস, গ্রীণ ডেল্টা ইন্সুরেন্স সিম্ফনি সফটটেক থেকে সফটওয়্যার ক্রয় করলেও ব্যবহার করে না।

প্রতিবেদন অনুযায়ী যেসব প্রতিষ্ঠান তালিকাভুক্ত সফটওয়্যার ব্যবহার করে সে সব প্রতিষ্ঠান হলো-অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ, সেভেল সার্কেল বাংলাদেশ, ইউনিক সিমেন্ট, আকিজ সিমেন্ট, এটিআই সিরামিক, ইউনাইটেড ঢাকা টোব্যাকো, এসিআই ফরমুলেশন, নেসলে বাংলাদেশ, রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোং, বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস, স্কয়ার ফার্মা, ইনসেপ্টা ফার্মা, এসিআই লি., এ্যারিস্টো ফার্মা, আরবার পলিপ্যাক। এসব কোম্পানি এনবিআরের তালিকাভুক্ত যুবসফট ইনফরমেশন, সিম্ফনি সফটটেক, বেস্ট বিজনেস বন্ড, আইবস, এটিআই, ধ্রুপদী, এনোভিয়া টেকনোলজিস, ইউওয়াই সিস্টেম থেকে সফটওয়্যার ক্রয় করে ব্যবহার করছে। তবে এসব সফটওয়্যারে এলটিইউকে একসেস দেওয়া হয় না।

প্রতিবেদন বলা হয়েছে, এলটিইউ এর তালিকাভুক্ত ২০টি প্রতিষ্ঠান ভ্যাট সফটওয়্যার ব্যবহার না করে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে হিসাব সংরক্ষণ করে। এর মধ্যে ১০টি সরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো-ওরিয়ন ফার্মা, এসেনসিয়াল ড্রাগস, রবিন প্রিন্টিং, বসুন্ধরা পেপার মিলস (নিউজপ্রিন্ট), বিটিসিএল, ইমপ্রেস টেলিফিল্ম (চ্যানেল আই), এএসটি বেভারেজ, বিটিআরসি, শাহ সিমেন্ট, এমআই সিমেন্ট, মদিনা সিমেন্ট, চায়না বাংলা সিরামিক, মীর সিরামিক, আরইবি, ডিপিডিসি, বিপিডিসি, ডেসকো, বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড, পেট্রোবাংলা ও সাধারণ বীমা করপোরেশন।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৩৬টি প্রতিষ্ঠান নিজস্ব সফটওয়্যার ব্যবহার করে। তবে এসব সফটওয়্যারে এলটিইউকে একসেস দেয়া হয় না। ৩৬টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৫টি প্রতিষ্ঠান নিজস্ব সফটওয়্যার ব্যবহার করার অনুমতি চেয়ে এনবিআরে আবেদন করেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো-ব্যাংক এশিয়া, সাউথ ইস্ট ব্যাংক, ডাচ বাংলা ব্যাংক, আরএকে সিরামিক ও প্রিমিয়ার সিমেন্ট। বাকি ৩১টি প্রতিষ্ঠান হলো-লিনডে বাংলাদেশ, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, অগ্রণী ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, এবি ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, ডাচ বাংলা ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, পূর্বালী ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, এইচএসবিসি, সাউথইস্ট ব্যাংক, আকিজ ফুড, প্রিমিয়ার সিমেন্ট, আরএকে সিরামিক, বাপেক্স, বেঙ্গল গ্লাস ওয়ার্কস, প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেল, ইন্টারকন্টিনেন্টাল, রেডিসন ব্লু, ঢাকা রিজেন্সি, ইউনিক হোটেল, রূপালী ইন্সুরেন্স, প্রগতি ইন্সুরেন্স, বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ, গ্রামীণফোন, রবি, বাংলালিংক ও টেলিটক।

এনবিআরের একাধিক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এনবিআরের তালিকাভুক্ত সফটওয়্যার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৪৪টি। এসব প্রতিষ্ঠান ছাড়াও বহু প্রতিষ্ঠান এনবিআরের অনুমতি নিয়ে সফটওয়্যার ব্যবহার করছে। এ পর্যন্ত প্রায় আট শতাধিক প্রতিষ্ঠান এই ৪৪টি প্রতিষ্ঠান থেকে এনবিআরের তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান থেকে সফটওয়্যার ক্রয় ও নিজস্ব সফটওয়্যার ব্যবহার করছে। আরো চার শতাধিক প্রতিষ্ঠান সফটওয়্যার নেয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
###

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!