আয়কর, কাস্টমস ও ভ্যাট ক্যাডার কর্মকর্তাদের মতামত উপেক্ষা করে সংশোধন ছাড়াই বহুল আলোচিত রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ করেছে সরকার। যার মাধ্যমে ৫৩ বছরের জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্ত হয়ে গেলো। সোমবার (১২ মে) মধ্যরাতে এই অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। জারি করা অধ্যাদেশে শুধুমাত্র রাজস্ব নীতি বিভাগের কার্যপরিধিতে সামান্য পরিবর্তন আনা হয়েছে। আর রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রশাসনিক পদগুলোতে প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের পাশাপাশি আয়কর, কাস্টমস ও ভ্যাট ক্যাডারের কর্মকর্তাদের রাখা হয়েছে।
অধ্যাদেশ জারির পর একাধিক কর্মকর্তা বিজনেস বার্তাকে জানিয়েছেন, অধ্যাদেশ জারির আগে তা ভেটিং পর্যায়ে সংশোধন করতে বেশ কিছুদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন দুই ক্যাডারের (আয়কর, কাস্টমস ও ভ্যাট) কর্মকর্তা, নন-ক্যাডার কর্মকর্তা ও বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মচারীরা। এই নিয়ে এনবিআরে দফায় দফায় বৈঠক, অবস্থান, আলোচনা হয়েছে। আশ্বাসও দেয়া হয়েছে। ৯ মে পর্যন্ত ভেটিং স্থগিতও রাখা হয়েছে। দুই ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ‘সংশোধন’ শেষে অধ্যাদেশ জারি হবে-এমন আশ্বাস দেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত তা আলোর মুখ দেখেনি। এছাড়া স্টেকহোল্ডারদের কারো কোনো মতামত নেয়া হয়নি। অবশেষে কারো কোনো মতামত ছাড়াই ৫৩ বছরের এনবিআর বিলুপ্ত করে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন কর্মকর্তারা।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আমরা দাবি জানালেও উধ্বর্তন কর্মকর্তারা আমাদের অনেকটা অন্ধকারে রেখে আলোচনার নামে সময়ক্ষেপন করেছেন। যার ফলে আমরা কিছুই করতে পারিনি। আমাদের বিশ্বাস, সরকারের উর্ধ্বতন মহলে আমাদের কোনো আলোচনা বা আমরা যেসব সংশোধন চেয়েছি, তার কিছুই পৌঁছায়নি। বৈষম্য রেখেই অধ্যাদেশ করে ফেলা হয়েছে। আমরা ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ’ গঠন করেছি। আজ (মঙ্গলবার) বিকেল ৩টায় এনবিআরের সামনে আমাদের ‘অবস্থান কর্মসূচি’ রয়েছে। সেখানে সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী অংশ নেবেন। সেখানে আমাদের দাবি আদায়ে কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
অধ্যাদেশের খসড়া পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, রাজস্ব নীতি বিভাগ কর আইন প্রয়োগ ও কর আদায় পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ পরিবীক্ষণ করবে। আর রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগে প্রশাসনিক অনুবিভাগের বিভিন্ন পদ প্রশাসন ক্যাডার ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের মাঠপর্যায়ের কর্মরত কর্মচারীদের মাধ্যমে পূরণ করা হবে। রাজস্ব নীতি বিভাগ কর আইন প্রয়োগ এবং কর আহরণ পরিস্থিতি মূল্যায়ন করবে। অর্থাৎ ‘পরিবীক্ষণ’ শব্দের পরিবর্তে ‘মূল্যায়ন’ শব্দটি যোগ করা হয়েছে। আর রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগে প্রশাসনিক অনুবিভাগের বিভিন্ন পদ প্রশাসন ক্যাডারের পাশাপাশি আয়কর, কাস্টমস ও ভ্যাট ক্যাডারের কর্মকর্তা এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের মাঠপর্যায়ে কর্মরত কর্মচারীদের মাধ্যমে পূরণ করা হবে। নতুন অধ্যাদেশ অনুযায়ী, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের জনবল রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগে ন্যস্ত হবে। এই জনবল থেকে প্রয়োজনীয় জনবল রাজস্ব নীতি বিভাগে পদায়ন করা যাবে। এছাড়া অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি) বিলুপ্ত হয়ে তার জনবল রাজস্ব নীতি বিভাগে ন্যস্ত হবে।
দুই ক্যাডারের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পৃথিবীর সব দেশের নিজস্ব রাজস্ব আদায়কারী সংস্থা রয়েছে। অথচ আমাদের কোনো ধরনের সমীক্ষা ছাড়াই এনবিআর বিলুপ্ত করতে অধ্যাদেশ চূড়ান্ত করা হচ্ছে। এ সিদ্ধান্তের ফলে অংশীজন বা ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়বে তা নিয়ে কোনো আলোচনাই করা হয়নি। একটি বিশেষ ক্যাডার নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে একতরফাভাবে খসড়া অধ্যাদেশ তৈরি করেছে। এক্ষেত্রে আয়কর, কাস্টমস ও ভ্যাট ক্যাডার কর্মকর্তাদের মতামত তো দূরের কথা, অর্থনৈতিক পরিস্থিতিবিষয়ক শ্বেতপত্র কমিটি বা এনবিআর সংস্কারবিষয়ক পরামর্শক কমিটির সুপারিশ আমলে নেওয়া হয়নি। খসড়া অধ্যাদেশে নানা রকমের অসঙ্গতি আছে। এসব ত্রুটি-বিচ্যুতি চিহ্নিত না করে এবং সমীক্ষা ছাড়া এনবিআর বিলুপ্ত করলে রাজস্ব আদায় কার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হবে। এতে দেশের অর্থনীতি ধসে পড়তে পারে।
অপরদিকে, এর আগে দুই ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশন থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ’র খসড়ায় কর্মকর্তাদের মতামত প্রতিফলিত হয়নি। বিভাগ দুটিতে আয়কর, কাস্টমস ও ভ্যাট ক্যাডারের জন্য পদ সংরক্ষিত না রেখে রাজস্বের কাজে অভিজ্ঞতা নেই-এমন কর্মকর্তা পদায়নের সুযোগ রাখা হয়েছে। এতে একদিকে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা কাজে অভিজ্ঞ নয় এমন কর্মকর্তা পদায়নের মাধ্যমে রাজস্ব প্রশাসনের দক্ষতা, গতিশীলতা এবং কার্যকারিতা বিঘ্নিত হবে, অন্যদিকে এনবিআরে কর্মরত দুটি ক্যাডারের কাজের ক্ষেত্র ও পদোন্নতির সুযোগ মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হবে।
অন্যদিকে, সোমবার সকাল থেকে কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়কর বিভাগের ক্যাডার, নন-ক্যাডার ও কর্মচারীরা অবস্থান নেন। ধাপে ধাপে প্রায় নয় ঘণ্টা বৈঠক শেষে এ ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বৈঠকে অংশীজনের মতামত ছাড়া অধ্যাদেশের খসড়া পাস করায় নিন্দা জানানো হয়েছে। অধ্যাদেশে কি উল্লেখ করা হয়েছে-তা জনসম্মুখে প্রকাশ না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এর আগে অস্তিত্ব সংকট উপলব্ধি করে দুই সংগঠনের অ্যাসোসিয়েশন বিশেষ জরুরি সভার (ইজিএম) আয়োজন করেছে। সেখান থেকে অবিলম্বে এই খসড়া বাতিল ও এনবিআর বিলুপ্ত না করার দাবি জানানো হয়েছে। অংশীজন হিসেবে সংবাদ সম্মেলনে একই দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ ট্যাক্স লইয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন ও ঢাকা ট্যাক্সেস বার অ্যাসোসিয়েশন। রাজস্ব আদায়ের বড় চ্যালেঞ্জ থাকলেও খসড়া অধ্যাদেশের অনুমোদনের পর থেকে রাজস্ব আদায় মুখ থুবড়ে পড়েছে। কাজে মনোযোগ নেই রাজস্ব আদায়কারী কর্মকর্তাদের।