এনবিআর আন্দোলনে জুনে রাজস্ব আদায়ে বড় ধস

২০২৫ সালের জুনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তারা আন্দোলনে যাওয়ার পর রাজস্ব সংগ্রহ কার্যক্রম প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে। এর ফলে ওই মাসে রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দেয়। এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, জুন মাসে রাজস্ব আদায় আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১৯ শতাংশ কম হয়েছে। ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা, যা রেকর্ড পরিমাণ হিসেবেই ধরা হচ্ছে।

চলতি বছরের জুন মাসে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৪৩ হাজার ৯২ কোটি টাকা, যেখানে আগের অর্থবছরের একই সময়ে আদায় হয়েছিল ৫৩ হাজার ৪৬ কোটি টাকা। এ হিসেবে মাসিক লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কম রাজস্ব আদায় হয়েছে। সাধারণত অর্থবছরের শেষ দুই মাসে রাজস্ব আদায়ের গতি বাড়ে। তবে এবার এনবিআর কর্মকর্তাদের আন্দোলনের কারণে জুন মাসের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সময় আদায় কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটে। মাসের শেষদিকে পুরোপুরি শাটডাউনের কারণে আদায় আরও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান মনে করছেন, জুন মাসে রাজস্ব আদায় কম হওয়ার প্রধান কারণ কর্মকর্তাদের আন্দোলন। তাঁর মতে, এই আন্দোলন না হলে অতিরিক্ত আরও প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা আদায় সম্ভব হতো, ফলে অর্থবছরের শেষ পর্যন্ত রাজস্ব আদায় ৩.৮০ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেত। বাস্তবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মোট রাজস্ব আদায় হয়েছে প্রায় ৩.৭১ লাখ কোটি টাকা, যা আগের বছরের ৩.৬৩ লাখ কোটির তুলনায় মাত্র ২.২৩ শতাংশ বেশি। এই প্রবৃদ্ধির হার করোনা মহামারির সময়ের (২০১৯-২০ অর্থবছর) পর সবচেয়ে কম।

২০২৪-২৫ অর্থবছরে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হয়েছে ৯২ হাজার ২১৬ কোটি টাকা, যা মোট লক্ষ্যমাত্রার প্রায় এক-পঞ্চমাংশ। গত পাঁচ দশকে এত বড় ঘাটতির নজির আর নেই। ২০২৪ সালের আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অর্থনৈতিক কার্যক্রমে গতি ফিরতে শুরু করে এবং বছরের শুরুতে রাজস্ব আদায়ে ইতিবাচক প্রবণতা দেখা যায়। এপ্রিল মাসে প্রবৃদ্ধি ১৪ শতাংশ ছাড়িয়েছিল। কিন্তু জুনে এনবিআর কর্মকর্তাদের আন্দোলন এবং পরবর্তী পরিস্থিতি রাজস্ব প্রশাসনে গভীর আস্থার সংকট তৈরি করেছে। ফলে ভবিষ্যতে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়েও তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।

একটি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বাতিল করে দুটি নতুন বিভাগ গঠনের উদ্যোগ নেওয়ার পর থেকেই আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। এনবিআরের কর্মকর্তাদের অভিযোগ ছিল, এই নতুন বিভাগগুলোর নিয়ন্ত্রণ প্রশাসন ক্যাডারের হাতে তুলে দিতেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আন্দোলন তীব্র রূপ নিলে পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে যে, ২৮ ও ২৯ জুন চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে যায়।

সরকারের কড়া হস্তক্ষেপের পর এনবিআরের কর্মকর্তারা কাজে ফিরলেও পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। পরে প্রায় ২০ জন কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত বা বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। এর পাশাপাশি আরও অনেকে বিভিন্ন ধরনের শাস্তির মুখোমুখি হন। ফলে এনবিআরের মাঠপর্যায়ে গভীর অনিশ্চয়তা ও আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। এই অবস্থায় কর্মকর্তারা শুধু নিয়মিত কাজই করছেন, অতিরিক্ত উদ্যোগ নিয়ে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর ক্ষেত্রে তেমন কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না।

খাতভিত্তিক হিসাবে, ২০২৫ সালের জুন মাসে কাস্টমস থেকে রাজস্ব আদায় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে ১৯ শতাংশ। ভ্যাট আদায় কমেছে ৩০ শতাংশ এবং আয়কর আদায় কমেছে ৯ শতাংশ। পুরো অর্থবছর বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, আমদানি শুল্ক আদায়ে বৃদ্ধি ছিল মাত্র ০.৩৩ শতাংশ, ভ্যাটে ৩.০১ শতাংশ এবং আয়কর ও ভ্রমণ কর মিলে আদায় বেড়েছে ২.৮৭ শতাংশ।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!