এনবিআরের বিভিন্ন দপ্তরে নীরিক্ষায় অসহযোগিতা

সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে সরকারি সব আয়-ব্যয়ের নিরীক্ষণের সর্বোচ্চ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়কে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বিভিন্ন কার্যালয়ে নিরীক্ষার এখতিয়ার রয়েছে নিরীক্ষা কর্তৃপক্ষের। তবে এনবিআরের বিভিন্ন দপ্তরে অডিট বা নিরীক্ষা করতে মাঝেমাঝেই অসহযোগিতামূলক আচরণের শিকার হয়েছে নিরীক্ষা কর্তৃপক্ষ। এসব বিষয়ে দুই কর্তৃপক্ষের দ্বন্দ্ব বেশ পুরোনো।

এই বিরোধের জেরে চিঠি চালাচালি থেকে শুরু করে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। সর্বোচ্চ আদালতের রায়েও কমেনি এই দুই কর্তৃপক্ষের দ্বন্দ্ব। নতুন করে এ দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছেছে পাবলিক অডিট বিল-২০২৪ প্রণয়ন কেন্দ্র করে।

এনবিআরের দাবি, আয়কর, শুল্ক ও মূসক আইনে কর বা শুল্ক নির্ধারণ (অ্যাসেসমেন্ট) বিষয়ে কর কর্তৃপক্ষ ও আদালত ছাড়া কারও প্রশ্ন তোলার এখতিয়ার নেই। কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের সব আয় ও ব্যয়ের ওপর নিরীক্ষার দায়িত্ব মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়ের। অথচ এনবিআরের প্রয়োজনীয় সহযোগিতার অভাবে এসব দায়িত্ব তারা ঠিকমতো পালন করতে পারছে না।

এ বিষয়ে সাবেক মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী বলেন, কর নিরূপণ বা অ্যাসেসমেন্ট নিয়ে অডিট ও এনবিআরের মধ্যে যে মতবিরোধ রয়েছে, তা জেনেছি। অ্যাসেসমেন্ট করা তো এনবিআরের দায়িত্ব; কিন্তু সেটা আইনসংগত হয়েছে কি না, কিংবা আইনে যা রয়েছে, তার চেয়ে কম করেছে কি না, তা চেক করার অধিকার তো অডিটের রয়েছে। নইলে রাষ্ট্রের রাজস্ব ক্ষতি হবে সেটার জন্যই দরকার অ্যাসেসমেন্ট ফাইল অডিটের এখতিয়ার। অডিট করতে গেলে ফাইল সরবরাহ করবে না—এমন তো হতে পারে না। সরকারি অর্থের অডিট সিএজিকে দেওয়া হয়েছে সাংবিধানিকভাবে। কর ও শুল্ক সংক্রান্ত আইনে যাই উল্লেখ থাকুক, তা এই অধিকার খর্ব করতে পারে না।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গোপনীয় তথ্য ও বিল অব এন্ট্রিসহ নানা দলিল নিরীক্ষা দলের কাছে উপস্থাপনে দাপ্তরিক অসহযোগিতার কারণে ২০২০ সাল থেকে ২০২৪ পর্যন্ত আইসিডি কমলাপুরের কাস্টম হাউসে নিরীক্ষা করা হয়নি। সম্প্রতি কনটেইনার গায়েব সম্পর্কিত কেলেঙ্কারি সামনে আসায় আইসিডি কমলাপুরের অধীনে বিল অব এন্ট্রিসহ অন্যান্য বিল অব এন্ট্রি নিরীক্ষার লক্ষ্যে গত নভেম্বর মাসে একটি চিঠি ইস্যু করা হয়। তিন দফা নিরীক্ষা দলের উদ্যোগেও চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস তথ্য উপস্থাপনে অস্বীকৃতি জানায়। এ লক্ষ্যে নিরীক্ষা কর্তৃপক্ষ থেকে চিঠি ইস্যু করেও সাড়া পাওয়া যায়নি। পরে বিভাগীয় কমিশনারের সঙ্গে আলোচনায় সমাধান না হলে কাস্টমসের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমাধানের পরামর্শ দেওয়া হয়। কর সার্কেল ২৮৮ এর কর কমিশনার ১৪ এর সঙ্গেও একই ধরনের ঘটনা ঘটে। নিরীক্ষা দল মোংলা বন্দরে গেলে সেখানেও অসহযোগিতার সম্মুখীন হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে নিরীক্ষা কর্তৃপক্ষ ও এনবিআরের বিভিন্ন পর্যায়ের কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিরোধ প্রকাশ্যে আসে।

জানা গেছে, সম্প্রতি পাবলিক অডিট বিল-২০২৪ এর খসড়ায় সরকারের সংযুক্ত তহবিলে প্রাপ্ত অর্থ নির্ধারণের পদ্ধতি সঠিক কিনা, তা যাচাই-বাছাই করতে নিরীক্ষা অধিদপ্তরকে অধিকার দিতে নারাজ এনবিআর। বরং অর্থ প্রাপ্তি যেভাবেই হোক, প্রাপ্ত অর্থ সঠিকভাবে জমা ও হিসাবভুক্ত হয়েছে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন করার অধিকার নিরীক্ষাকে দিতে রাজি নয় সংস্থাটি। সাংবিধানিক ক্ষমতাপ্রাপ্ত নিরীক্ষা কর্তৃপক্ষকে রাষ্ট্রের সব আয়-ব্যয়ের এখতিয়া দেওয়া হলেও আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ও কাস্টমস আইনের ওপর নিরীক্ষা কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা নেই বলে এনবিআর যুক্তি উপস্থাপন করেছে বিলের খসড়ায়।

মতামতের জন্য উপস্থাপিত খসড়া বিল মতে, যে সব রাজস্ব সংযুক্ত তহবিলে প্রাপ্য তা সঠিকভাবে নির্ধারণ, জমা ও হিসাবভুক্ত হয়েছে কিনা, রাজস্ব নিরূপণ বা অ্যাসেসমেন্ট আইনসম্মত হয়েছে কিনা, তা যাচাই করতে পারবে নিরীক্ষা কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এনবিআর নিরূপণ পদ্ধতিতে নিরীক্ষার আপত্তি জানিয়েছে। এনবিআরের এসব দাবি ও আইনি ব্যাখ্যা যে যুক্তিহীন, তা সংশোধনী প্রস্তাবের আইনি ব্যাখ্যায় উঠে এসেছে।

জানা গেছে, এনবিআরের দাবি ২০২৩ সালে প্রণীত আয়কর আইন ও কাস্টমস আইনের ৩ ধারা ও মূল্য সংযোজন কর ২০১২ এর ৩ ধারায় উল্লিখিত বিষয় দেশের সব আইনের চেয়ে বেশি প্রাধান্য পাবে। কিন্তু আইনজ্ঞদের অভিমত, কোনো আইনই সংবিধানের ঊর্ধ্বে নয়। কারণ সংবিধানের ১২৮ (১) অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে মহা হিসাবনিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক সরকারের আয় ও ব্যয় নিরীক্ষা করে এবং যথাযথভাবে সরকারি বিধিবিধান অনুসরণপূর্বক হিসাবভুক্ত করা হয়েছে কিনা—এ বিষয়ে মতামত প্রদান করে। সিএজি (অ্যাডিশনাল ফাংশন) অ্যাক্ট-১৯৭৪ এর ৫ (১) ধারায় প্রদত্ত সিএজি ক্ষমতাবলে বিধিবদ্ধ সরকারি প্রতিষ্ঠান, পাবলিক এন্টারপ্রাইজ এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষসমূহ অডিট করে। সংবিধান সিএনজিকে অডিটের পরিধি এবং ব্যাপ্তি নির্ধারণের পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে।

এনবিআরের যুক্তিতে বলা হয়েছে, আয়কর আইন ২০২৩ এর ১৯৬ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, এই আইন বা বাংলাদেশ বলবৎ অন্য আইনে যাই থাকুক না কেন আয়কর কর্তৃপক্ষ, আপিল ট্রাইবুন্যাল ও সুপ্রিম কোর্ট ছাড়া অন্য কেউ কর নির্ধারণ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবে না। কাস্টমস আইন ২০২৩ এ উল্লেখ আছে, কাস্টমস দলিল কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ও আদালত ব্যতীত অন্য কারও নিকট সরবরাহ দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুরূপ, মূসক আইনে উল্লেখ করা হয়েছে, মূসক কর্মকর্তা ব্যতীত অন্য কেউ কর নির্ধারণ ও অডিট করতে পারবে না।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!