অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাব পড়েছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ২১.৫২ শতাংশ, যা ছয় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এ সময়ে ব্যয় হয়েছে ৫৯,৮৭৭ কোটি টাকা। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আইএমইডি প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
আইএমইডির প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এডিপির বরাদ্দ রয়েছে ২ লাখ ৭৮ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা। অর্থবছরের সাত মাসে ব্যয় হয়েছে ৫৯ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে ব্যয় হয়েছিল ৭৪ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৪ হাজার ৫৮৮ কোটি টাকা কম খরচ হয়েছে। তার মানে আগেরবার প্রকল্পের মাধ্যমে যত টাকা খরচ করা হয়েছে, এবার তা-ও ব্যয় করা সম্ভব হচ্ছে না। এর আগে জুলাই-জানুয়ারি হিসাবে কোভিডের বছরে (২০২০-২১ অর্থবছর) ৬১ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছিল। পরের দুই বছরে প্রায় ৭২ হাজার কোটি টাকা করে খরচ হয়েছিল।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, আগের আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নেওয়া চলমান সব প্রকল্পই অন্তর্বর্তী সরকার পর্যালোচনা করেছে। অ-গুরুত্বপূর্ণ ও রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া অনেক প্রকল্প বা স্কিম বাদ যাচ্ছে। এর প্রভাবও বাস্তবায়নে পড়েছে।
আবার জুলাই-অভ্যুত্থানের পরে অনেক উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক চলে গেছে। অনেক প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ফলে এডিপি বাস্তবায়ন হারও কমে গেছে। অনেক দেশীয় ঠিকাদারও প্রকল্প এলাকায় এখনও ফিরে আসেনি। একইভাবে বৈদেশিক অর্থায়নের বেশকিছু প্রকল্পে বিদেশি ঠিকাদার অনুপস্থিত রয়েছে। এতে প্রকল্প বাস্তবায়নেও গতি কমেছে বলে জানা যায়।
আইএমইডি তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শুধু জানুয়ারিতে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছিল ৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ। যা টাকার অঙ্কে ব্যয় হয়েছিল ১২ হাজার ৭২৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে এখন সবচেয়ে পিছিয়ে আছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এই মন্ত্রণালয়ের সাতটি প্রকল্পে ১৪৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। পাকিস্তান, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, ভুটান, ব্রুনেই ও সৌদি আরবে সাতটি চ্যান্সারি কমপ্লেক্স তৈরির জন্য আলাদাভাবে এসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সাত মাসে ৪৭ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। বাস্তবায়নের হার মাত্র দশমিক ৩৩ শতাংশ।
শুধু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নয়, ১১টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ গত সাত মাসে তাদের বরাদ্দের মাত্র ১০ শতাংশ খরচ করতে পেরেছে। এসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগ হলো: স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ; প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়; জননিরাপত্তা বিভাগ; মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়; সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়; অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ; বাণিজ্য মন্ত্রণালয়; ভূমি মন্ত্রণালয় ও জাতীয় সংসদ সচিবালয়।
এ বিষয়ে বিশ্লেষকদের মতে, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থারের পর পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক হয়নি, যার প্রভাব এডিপি বাস্তবায়নেও পড়ছে। পাশাপাশি, রাজস্ব আহরণ চ্যালেঞ্জের মুখে থাকায় সরকার এডিপিতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দিতে পারছে না। মহার্ঘ ভাতার অতিরিক্ত ব্যয়ও এডিপি বাস্তবায়নে প্রভাব ফেলছে। বৈদেশিক ঋণ ব্যবহারের জন্য সরকারি তহবিল থেকে একটা অংশ ব্যয় করতে হয়। এ কারণে বৈদেশিক অর্থায়নও আসছে না। উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থছাড়ও কমে গেছে। তবে বরাদ্দ কমলেও এখনও ২ লাখ কোটি টাকার ওপরে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই বরাদ্দও ব্যয় করা যাবে কি না তা নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে।