এটুআই প্রকল্পে দুর্নীতি, তদন্তে জয়-পলকের নাম

এসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই) প্রকল্পের আওতায় কয়েকশ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ উঠেছে, যেখানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও সাবেক তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের নাম জড়িয়েছে। সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এটুআই অফিসে অভিযান চালিয়ে গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র উদ্ধার করেছে। ৮৫৫ কোটি টাকার এই প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় অর্থ আত্মসাৎ হয়েছে কি না, তা তদন্ত করে দেখছে সংস্থাটি।

৮৫৫ কোটি টাকার এটুআই প্রকল্পে লুটপাটের অভিযোগে গত মঙ্গলবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে আইসিটি টাওয়ারে অভিযান চালায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সহকারী পরিচালক রাজু আহমেদের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি দল এই অভিযানে অংশ নেয়।

অভিযান চলাকালে দুদকের সহকারী পরিচালক রাজু আহমেদ জানান, প্রকল্পের ১৫০টিরও বেশি টেন্ডার পর্যালোচনা করে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন ও বিধিমালা (পিপিআর) লঙ্ঘনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। নির্দিষ্ট কিছু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে কাজ দেওয়া হয়েছে, যা অনিয়মের ইঙ্গিত দেয়। এছাড়া, যৌক্তিক কারণ ছাড়াই কার্যাদেশের ব্যয়ের পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে, যা ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশের আশঙ্কা তৈরি করছে।

এটুআই ২০১৯ সালে ই-পেমেন্ট সার্ভিস ‘একপে’ চালু করে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই এটি পরিচালিত হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি নিয়েও তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে দুদক।

এটুআই সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদকের এনফোর্সমেন্ট ইউনিট। এটুআই প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় ৪৮৫ কোটি ৪৫ লাখ টাকা ধরা হলেও পরবর্তী সময় এর ব্যয় দাঁড়ায় ৮৫৫ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। অভিযানকালে প্রাপ্ত অনিয়মগুলোর বিষয়ে বিস্তারিত যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে টিম সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করেছে।

এটুআই হেড অব প্রোজেক্ট ম্যানেজমেন্ট আব্দুল্লাহ আল ফাহিম বলেন, এরইমধ্যে অভ্যন্তরীণ তদন্তে অনিয়মের প্রমাণ মেলায় ১৪ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। অনিয়মের পেছনে সজীব ওয়াজেদ জয় ও জুনাইদ আহমেদ পলকের সম্পৃক্ততাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

এছাড়া অভিযোগের আওতায় রয়েছেন ইউএনডিপির নিয়োগকৃত একাধিক প্রকল্প কর্মকর্তা। তাদের মধ্যে রয়েছেন প্রকল্প পরামর্শক আনীর চৌধুরী, ই-গভর্নমেন্ট অ্যানালিস্ট ফরহাদ জাহিদ শেখ, প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট স্পেশালিস্ট মো. মাজেদুল ইসলাম, প্রজেক্ট অ্যানালিস্ট (এইচডি মিডিয়া) পূরবী মতিন, ক্যাপাসিটি ডেভেলপমেন্ট স্পেশালিস্ট মানিক মাহমুদ, রিসোর্স মোবিলাইজেশন স্পেশালিস্ট মো. নাসের মিয়া, ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস স্পেশালিস্ট তহুরুল হাসান টুটুল, সলিউশন আর্কিটেকচার স্পেশালিস্ট রেজওয়ানুল হক জামী এবং টেকনোলজি অ্যানালিস্ট মো. হাফিজুর রহমান।

দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন জানিয়েছেন, রেকর্ডপত্রগুলোর পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ শেষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

২০০৯ সালে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) অর্থায়নে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রকল্প চালু হয়। পরবর্তীতে শেখ হাসিনার নির্দেশনায় ২০১৮ সালে এটুআই প্রোগ্রামকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের অধীনে নেওয়া হয় এবং ২০২০ সালে এর নাম পরিবর্তন করে এসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই) রাখা হয়। প্রকল্পের প্রধান লক্ষ্য ছিল পাঁচটি—বাংলাদেশের এসডিজি অর্জন ত্বরান্বিত করতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা উন্নয়ন, সরকারি সেবাগুলোর ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে সময়, ব্যয় ও ভোগান্তি কমিয়ে সুশাসনে সততার পরিবেশ তৈরি, সরকারের মধ্যে তথ্য-উপাত্তভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সংস্কৃতি গড়ে তোলা এবং ডিজিটাল পেমেন্ট ইকোসিস্টেম তৈরিতে সহায়তা প্রদান।

প্রকল্পের মেয়াদ ও অর্থ
২০১৯ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রকল্পটিতে তিনজন প্রকল্প পরিচালক (পিডি) দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রকল্পটির মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রাথমিকভাবে এর মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪৮৫ কোটি ৪৫ লাখ টাকা, যেখানে সরকারের ব্যয় ছিল ৪০৩ কোটি ৬৫ লাখ এবং সহায়তা তহবিল থেকে আসার কথা ছিল ৮১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। তবে পরবর্তী সময়ে ব্যয়ের পরিমাণ সংশোধন করে প্রকল্পের মোট ব্যয় ৮৫৫ কোটি ৪৮ লাখ টাকায় উন্নীত করা হয়। এতে সরকারের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৫৫৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকা, আর সহায়তা তহবিলের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৩০১ কোটি ৮৩ লাখ টাকা।

সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ এবং এটুআই কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই) প্রকল্পের ৮৫৫ কোটি টাকা দুর্নীতির খবরটি সঠিক নয়। বুধবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। বিজ্ঞপ্তিতে সই করেন আইসিটি বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ও এটুআই প্রোগ্রামের প্রকল্প পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. মামুনুর রশিদ ভূঁইয়া।

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র আন্দোলনের ফলে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। এরপর, গত বছরের ৩১ আগস্ট তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ এটুআই প্রকল্পের অনিয়ম তদন্তে একটি কমিটি গঠন করে। তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদন দাখিলের পর, প্রকল্পে নিযুক্ত একাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। সেই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!