এক হিসাবেই ৬৫১ কোটি পাচার করেছেন জাবেদ

নিজ প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তাকে আমদানিকারক পরিচয় দিয়ে খোলা হয় ‘ক্ল্যাসিক ট্রেডিং’ নামের একটি নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব ব্যবহার করেই বিদেশে পাচার করা হয় ৬৫১ কোটি টাকা। সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ ওই অর্থ পাচার করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এসব অর্থ এসেছে ব্যাংক ঋণ ও ঘুষ থেকে। আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এ তথ্য জানিয়েছেন জাবেদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান আরামিট পিএলসির সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) জাহাঙ্গীর আলম। তাঁকেই আমদানিকারক সাজিয়ে ‘ক্ল্যাসিক ট্রেডিং’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। বৃহস্পতিবার (২৫ সেপ্টেম্বর) বিকেলে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ইব্রাহীম খলিলের আদালতে তিনি জবানবন্দি দেন।

গত বুধবার নগরের কালুরঘাট এলাকা থেকে দুদক জাহাঙ্গীর আলমকে গ্রেপ্তার করে। পরদিন দুপুরে তাঁকে আদালতে তোলা হয়। দুদকের আইনজীবী মোকাররম হোসাইন জানান, জবানবন্দিতে জাহাঙ্গীর আলম সাবেক মন্ত্রী জাবেদের বিদেশে হাজার কোটি টাকা পাচারের বিস্তারিত তথ্য দিয়েছেন। তিনি বলেন, জাহাঙ্গীরের নামে খোলা ‘ক্ল্যাসিক ট্রেডিং’ প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব ব্যবহার করে জাবেদ ৬৫১ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেন। ব্যাংক থেকে অর্থ উত্তোলনের পর হুন্ডির মাধ্যমে তা বিদেশে পাঠানো হয়। ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ২৭ জুলাই পর্যন্ত এই অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটে।

দুদকের আইনজীবী মোকাররম হোসাইন জানান, জবানবন্দিতে আসামি জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, ২০১৮ সালের ১৪ জানুয়ারি তাঁকে আমদানিকারক সাজিয়ে ক্ল্যাসিক ট্রেডিংয়ের নামে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স নেন সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ। এরপর জাবেদের পরিবারের নিয়ন্ত্রণে থাকা ইউসিবিএল ব্যাংকের স্টেশন রোড শাখায় ক্ল্যাসিক ট্রেডিংয়ের নামে হিসাব খোলা হয়। হিসাবে নমিনি হিসেবে রাখা হয় জাহাঙ্গীরের স্ত্রীকে। ওই হিসাবের নামে ব্যাংক থেকে পাঁচ থেকে ছয়টি চেক বই (প্রতিটিতে ৫০ পাতা) নেন জাবেদের সহযোগী আবদুল আজিজ (বর্তমানে গ্রেপ্তার)। কমপক্ষে ৩০০টি খালি চেকে জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে সই নেওয়া হয়।
Jabed Moneylondaring
ইসলামী ব্যাংক চট্টগ্রামের জুবিলি রোড শাখা ও ইউসিবিএল ব্যাংকের বিভিন্ন শাখা থেকে জাবেদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান আরামিট সিমেন্ট, আরামিট থাই অ্যালুমিনিয়াম ও আরামিট স্টিল পাইপস লিমিটেডের নামে শত কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়। শুধু ইসলামী ব্যাংকের জুবিলি রোড শাখা থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছে পাঁচ শ কোটি টাকা। জাহাঙ্গীর জবানবন্দিতে জানিয়েছেন, এসব ঋণের টাকা প্রথমে ক্ল্যাসিক ট্রেডিংয়ের নামের হিসাবটিতে স্থানান্তর করা হয়। পরে তাঁর সই করা খালি চেক ব্যবহার করে ধাপে ধাপে টাকা জাবেদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের হিসাবে স্থানান্তর করা হতো। এরপর প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী ইয়াসিনুর রহমান, মো. হোসাইনসহ কয়েকজন টাকাগুলো ব্যাংক হিসাব থেকে তুলে নিতেন। পরে হুন্ডির মাধ্যমে এসব টাকা জাবেদের নির্দেশনা অনুযায়ী বিদেশে পাচার করা হতো। জাবেদের হয়ে এসব কাজের দেখভাল করতেন প্রতিষ্ঠানের দুই কর্মকর্তা মো. আবদুল আজিজ ও উৎপল পাল। তাঁরা গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন।

ঘুষের টাকাও অভিনব কৌশলে জাবেদ পাচার করতেন বলে জবানবন্দিতে জানিয়েছেন জাহাঙ্গীর আলম। তিনি জানিয়েছেন, সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ ইউসিবিএলের চেয়ারম্যান ছিলেন। মন্ত্রী হওয়ার পর তিনি পদত্যাগ করে স্ত্রী রুকমিলা জামানকে চেয়ারম্যান করেন। তবে রুকমিলা নামমাত্র চেয়ারম্যান হলেও দায়িত্ব ছিল মন্ত্রী সাইফুজ্জামানের কাছে। এই ব্যাংক থেকে শিল্পপতিদের ঋণ দেওয়ার বিনিময়ে ঘুষ নেওয়া হতো। এসব ঘুষের টাকা নিজের প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের নামে খোলা ভুয়া ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে রেখে বিদেশে পাচার করা হতো। চট্টগ্রামে সীতাকুণ্ডের একটি জাহাজভাঙা প্রতিষ্ঠান এবং কালুর ঘাটের একটি তৈরি পোশাক কারখানা থেকে ঋণ দেওয়া বাবদ ৭৫ কোটি টাকা ঘুষ নেওয়ার পর বিদেশে পাচারের তথ্য জবানবন্দিতে দেন জাহাঙ্গীর।

১৭ সেপ্টেম্বর দুদক জাবেদের প্রতিষ্ঠানের দুই কর্মকর্তা মো. আবদুল আজিজ ও উৎপল পালকে গ্রেপ্তার করে। পরে ২২ সেপ্টেম্বর তাঁরা আদালতে জবানবন্দি দেন। সেখানে জাবেদের নির্দেশে যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে ২৫ কোটি টাকা পাচারের কথা স্বীকার করেন। জানা যায়, ইউসিবিএল ব্যাংক থেকে ২৫ কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুর হওয়ার পর তা একই ব্যাংকের চারটি নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। পরবর্তীতে সেসব অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়। জালিয়াতি ও আত্মসাতের এ ঘটনা ঘটে ২০১৯–২০ সালে, যখন জাবেদ ভূমিমন্ত্রী ছিলেন। দুদকের চট্টগ্রাম কার্যালয়ের উপপরিচালক সুবেল আহমেদ জানান, জাবেদ তাঁর সহযোগী আবদুল আজিজ, উৎপল পাল ও সৈয়দ কামরুজ্জামানকে সঙ্গে নিয়ে বিদেশে হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন। এখন পর্যন্ত তাঁর প্রতিষ্ঠানের তিন কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আদালতে দেওয়া তাঁদের জবানবন্দি থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। অন্যদের গ্রেপ্তারের পর বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

গত বছরের ৭ অক্টোবর আদালত জাবেদ ও তাঁর স্ত্রীকে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন। এরপরও তাঁরা বিদেশে পালিয়ে যান। দুদকের তথ্য অনুযায়ী, জাবেদের ৯টি দেশে বিপুল সম্পদ রয়েছে। এর মধ্যে যুক্তরাজ্যে ৩৪৩টি, দুবাইতে ২২৮টি, যুক্তরাষ্ট্রে ১০টি বাড়ি রয়েছে। এ ছাড়া থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভারত, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়ায়ও সম্পদ রয়েছে।

** জাবেদের চেক দিয়ে ১.৭৫ কোটি টাকা উত্তোলন, আটক
** জাবেদের অবৈধ সম্পদের ২৩ বস্তা রেকর্ডপত্র জব্দ
** কাদির মোল্লার থেকে ৫২ কোটি ঘুস নেন জাবেদ
** ১২০০ কোটি পাচার: স্ত্রীসহ জাবেদের বিরুদ্ধে মামলা
** ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামানের ৩৯ ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ
** যুক্তরাজ্যে সাইফুজ্জামানের সম্পদ বিক্রি হচ্ছে
** ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামানের যুক্তরাজ্যের সম্পত্তি জব্দ
** সাইফুজ্জামানের বিশ্বে ৭৫০০ কোটি টাকার সম্পদ
** সাইফুজ্জামান চৌধুরীর জন্য কর্ণফুলী টানেল!
** সাবেক ভূমিমন্ত্রীর ১০২ কোটি টাকার শেয়ার অবরুদ্ধ
** যুক্তরাজ্যেই ৩৬০টি বাড়ির মালিক সাবেক ভূমিমন্ত্রীর
** বাংলাদেশি রাজনীতিকের বৈশ্বিক সম্পত্তির সাম্রাজ্য

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!