** অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান, ৭৬ কনটেইনার রেডিমেড পোশাক নামমাত্র মূল্যে রপ্তানি করা হয়েছে
** শুল্কায়নের সময় যেসব কর্মকর্তা দায়িত্বে ছিলো—তাদেরও শাস্তির আওতায় আনতে হবে
** ইএক্সপি ইস্যু করার সময় ব্যাংক দেখেনি, অনুমোদনকারী কর্মকর্তাকে শাস্তির আওতায় আনা উচিত
মাত্র এক ডলারে ৯ কেজি ব্রান্ডের পোশাক শুল্কায়ন করে রপ্তানি হয়েছে। হিসেব করলে এক কেজি শার্ট বা প্যান্ট রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৯-১০ টাকায়। ৯ টাকা হিসেবে প্রতি পিস রপ্তানি হয়েছে প্রায় ১ টাকা ২৮ পয়সায়। আর ১০ টাকা হিসেবে প্রতি পিস ১ টাকা ৪২ পয়সায়। মাত্র এক ডলারে ৯ কেজি পণ্য কিভাবে শুল্কায়ন করেছে কাস্টমস। এতো গেলো শুল্কায়নে কাস্টমসের অনিয়ম ও গাফিলতি। রপ্তানির ক্ষেত্রে ব্যাংক ইএক্সপি ইস্যু করে। এতো কম রপ্তানি মূল্য দেখার পরও ব্যাংক ইএক্সপি ইস্যু করেছে। এতো গেলো ব্যাংকের অনিয়ম ও গাফিলতি। রপ্তানিকারক এত কম মূল্য দেখিয়ে এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এসব পোশাক রপ্তানি করেছে।
এক বা দুই কনটেইনার নয়, কম মূল্য দেখিয়ে ৭৬ কনটেইনার পণ্য রপ্তানি করা হয়েছে। কিন্তু রপ্তানির কম মূল্য দেখানো টাকা দেশে আসেনি। খাজা ট্রেডার্স নামে একটি অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান রপ্তানির আড়ালে এই টাকা পাচার করেছে। অভিযোগ উঠেছে—রপ্তানিকারক শুল্কায়নে কাস্টমস ও কম মূল্য দেখাতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে ‘ম্যানেজ’ করে এই বিপুল পরিমাণ টাকা পণ্য রপ্তানি করেছে। এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের অভিযোগে অনুসন্ধান শেষে মানিলন্ডারিং আইনে মামলার সুপারিশ করা হয়েছে। কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর সম্প্রতি এনবিআরে এই অনুসন্ধান প্রতিবেদন দিয়েছে। এনবিআর সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
কাস্টমস গোয়েন্দা সূত্রমতে, কম মূল্য বা আন্ডার ইনভয়েসিং এর মাধ্যমে তৈরি পোশাক রপ্তানি হচ্ছে—এমন অভিযোগে ২০২৩ সালের ১৫ নভেম্বর কাস্টমস গোয়েন্দা কয়েকটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান চিহূিত কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়। এর মধ্যে রয়েছে ঢাকার মিরপুর, ফকিরবাড়ীর ১০/বি, প্লট-৩ এর মেসার্স খাজা ট্রেডার্স। এই প্রতিষ্ঠানের ২০২১ সালের ৭৫টি ও ২০২২ সালের একটিসহ মোট ৭৬টি বিল অব এক্সপোর্টের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। প্রাথমিক অনুসন্ধানে আন্ডার ইনভয়েসিং এর প্রমাণ পান কর্মকর্তারা। পরে মালিন্ডারিং অনুসন্ধান ও তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি প্রায় এক বছর তদন্ত শেষে চলতি বছরের ৩১ জুলাই প্রতিবেদন দেয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৭৬টি চালানে ৭ লাখ ৯৩ হাজার ৯৮৯ কেজি বিভিন্ন ধরণের রেডিমেড গার্মেন্টস রপ্তানি করা হয়েছে। মূল্য দেখানো হয়েছে ১ লাখ ৩৫ হাজার ৩৪৭ ডলার ও ৪৭ হাজার ২৯৬ ইউরো। প্রতি পিসের ওজন ১ দশমিক ৩৯ কেজি থেকে ১৬ দশমিক ৭৫ কেজি দেখানো হয়েছে। প্রতি পিসের ওজন অসামঞ্জস্যপূর্ণ। বন্ডেড ও নন-বন্ডেড অন্যান্য রপ্তানিকারকের বিল অব এক্সপোর্ট পর্যালোচনায় দেখা গেছে, পণ্যের প্রতি পিস এবং প্রতি কেজিতে মূল্য অনেক বেশি। সেক্ষেত্রে সমসাময়িক বিল অব এক্সপোর্ট বিবেচনায় নিয়ে প্রতি পিস অস্বাভাবিক ওজনে রয়েছে—এমন শুল্কায়িত বিল অব এক্সপোর্টসমূহের রপ্তানি পণ্যসমূহ প্রতি কেজি ন্যূনতম ৩ ডলার ধরে সম্ভাব্য মূল্য হিসাব করা হয়েছে ২৩ লাখ ৮১ হাজার ৯৬৭ ডলার।
আবার সমজাতীয় পণ্যের গড় রপ্তানিমূল্য হিসাব করলে দেখা যায়, প্রতি কেজি হয় ৯ দশমিক ৮৭ ডলার। রপ্তানি করা প্রতি পিস টি-শার্ট, হুডি, প্যান্ট, শার্ট, পেন্টি, বক্সার, টাইস, ট্যাংক, টপ এর গড় ওজন প্রায় শূন্য দশমিক ২৯ কেজি। সে হিসেবে ৭৬টি চালানে ৭ লাখ ৯৩ হাজার ৯৮৯ কেজি গামেন্টস পণ্য রপ্তানি করা হয়, যা সংখ্যার হিসেবে দাঁড়ায় এক লাখ ৮ হাজার ৪০৯ ইউনিট। প্রতি ইউনিটের গড় ওজন হয় ৭ দশমিক ৩২ কেজি। প্রতিষ্ঠানের ঘোষণা অনুযায়ী পণ্যের পরিমাণ ৯ লাখ ৪৭ হাজার ৯৩ পিস। প্রতি পিসের গড় ওজন শূন্য দশমিক ৮৪ কেজি। গড় রপ্তানি মূল্য দাঁড়ায় শূন্য দশমিক ৩৪ ডলার। সে হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি ৭ লাখ ৯৩ হাজার ৯৮৯ কেজি পণ্যের মোট ১২ লাখ ১৪ হাজার ৮০৩ ডলার দেশে আসার কথা। দেশে এসেছে ১ লাখ ৯১ হাজার ৮০৬ ডলার। বাকি ১০ লাখ ২২ হাজার ৯৯৬ ডলার দেশে আসেনি, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় পৌনে নয় কোটি টাকা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তদন্ত চলাকালে খাজা ট্রেডার্স এর সঙ্গে যোগাযোগ করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের কোন কর্মকর্তা হাজির হননি। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে একটি লিখিত জবাব দেয়া হয়েছে। যাতে, রপ্তানির আড়ালে অর্থপাচারের বিষয়টি অস্বীকার করা হয়েছে। বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটি পোশাক খাতের ত্রুটিযুক্ত পোশাক লট আকারে কিনে তা রপ্তানি করেছে। প্রতিষ্ঠানটি ভ্যাট ঢাকা পশ্চিম কমিশনারেটের আওতাধীন। ওই কমিশনারেটের কর্মকর্তারা ভ্যাট নিবন্ধনের ঠিকানায় গিয়ে এই প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্ব পাননি।
এই বিষয়ে এনবিআরের একজন কর্মকর্তা বলেন, শুল্কায়ন যেসব কর্মকর্তা করেছেন, তাদের চিহূিত করে শাস্তির আওতায় আনা উচিত। কিভাবে নামমাত্র মূল্য দেখিয়ে রপ্তানি করা হয়েছে। কর্মকর্তা কেন খতিয়ে দেখলেন না। ব্যাংক কিভাবে না দেখে ইএক্সপি ইস্যু করেছেন। অনুমোদনকারী কর্মকর্তাও একইভাবে অপরাধী। প্রতিষ্ঠানকে শাস্তির আওতায় আনা হবে। কোনো লেনদেন না হলেও এমন অনিয়ম হতে পারে না।
***