এই প্রথম বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ ছাড়াল ৪ বিলিয়ন ডলার

সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো বার্ষিক ৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করেছে। মেগা প্রকল্পগুলোর ঋণ পরিপক্ব হওয়া এবং বাজেট সহায়তা ঋণের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়ে আসায় ঋণ পরিশোধের চাপ বেড়েছে। রোববার (২৮ জুলাই) অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশটি সুদ ও আসল মিলিয়ে উন্নয়ন সহযোগীদেরকে মোট ৪.০৮৭ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছে, যা এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ। আগের অর্থবছরে এই অঙ্ক ছিল ৩.৩৭ বিলিয়ন ডলার। ফলে এক বছরে ঋণ পরিশোধ বেড়েছে প্রায় ২১.২ শতাংশ।

ইআরডির হিসাব অনুযায়ী, সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের আসল পরিশোধের পরিমাণ আগের বছরের তুলনায় ২৮.৮ শতাংশ বেড়েছে। এ সময়ে বাংলাদেশ ২.৫৯৫ বিলিয়ন ডলার আসল পরিশোধ করেছে, যেখানে আগের বছর এই অঙ্ক ছিল ২.০২ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে সুদ পরিশোধে ব্যয় হয়েছে ১.৪৯১ বিলিয়ন ডলার, যা আগের অর্থবছরের ১.৩৪৯ বিলিয়নের তুলনায় ১০.৫ শতাংশ বেশি।

ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, আগের বছরগুলোতে নেওয়া মেগা প্রকল্প ও বাজেট সহায়তা ঋণের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হওয়ায় মূল ঋণ পরিশোধের চাপ ক্রমাগত বাড়ছে। তাদের মতে, আগামী এক-দুই বছরের মধ্যেই রাশিয়ার সহায়তায় নির্মিত পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ কয়েকটি বড় প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ শুরু হবে, ফলে ঋণ পরিশোধের চাপ আরও তীব্র হবে।

পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী ড. এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে দেশের ঋণ ব্যবস্থাপনা চাপের মুখে পড়ে। এ সময় যত্রতত্র বহু প্রকল্প নেওয়া হয়— যার মধ্যে কিছু ছিল অপ্রয়োজনীয়, আবার কিছুতে ব্যয় ধরা হয় অস্বাভাবিকভাবে। অনেক প্রকল্পেই ছিল না অর্থনৈতিক রিটার্ন; অনুমোদন হয়েছে যথাযথ সমীক্ষা ও মান নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই। তিনি বলেন, রাজস্ব আহরণ সবসময়ই চাপে থাকে, তাই এসব প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। ফলে গত সাত বছরে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ঋণ গ্রহণের গতি ও পদ্ধতি— দুইই এখন উদ্বেগের বিষয়।

ড. মাসরুর রিয়াজ আরও জানান, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হার্ড টার্ম ঋণের পরিমাণ বেড়েছে— যেগুলোর সুদের হার তুলনামূলক বেশি, গ্রেস পিরিয়ড কম এবং পরিশোধের সময়ও সীমিত। কোভিড পরবর্তী অর্থনৈতিক সংকট ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাত সামাল দিতে বাংলাদেশ কয়েকটি বাজেট সহায়তা ঋণ নিয়েছে। এসব ঋণের বেশিরভাগেরই স্বল্প গ্রেস পিরিয়ড ও দ্রুত পরিশোধের শর্ত ছিল; ইতোমধ্যে সেই পরিশোধ শুরু হয়েছে। ফলে রাজস্ব ব্যয় ব্যবস্থাপনা ও আর্থিক শৃঙ্খলা চাপে পড়েছে। ড. রিয়াজ বলেন, এখনই সময় ঋণ পরিশোধ সক্ষমতা, ভবিষ্যৎ ঋণচাহিদা এবং সামগ্রিক রাজস্ব কৌশল নতুন করে মূল্যায়নের।

কমেছে ঋণ ছাড় ও প্রতিশ্রুতি

ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, ঋণ পরিশোধ বাড়লেও বৈদেশিক ঋণের অর্থছাড় ও নতুন প্রতিশ্রুতি কমেছে। সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে মোট ৮.৩২৩ বিলিয়ন ডলারের ঋণ প্রতিশ্রুতি বা চুক্তি হয়েছে, যা আগের বছরের ১০.৭৩৯ বিলিয়নের তুলনায় কম। একই সময়ে ঋণ ছাড়ের পরিমাণও কমে ৮.৫৬৮ বিলিয়নে দাঁড়িয়েছে, আগের বছরের ১০.২৮৩ বিলিয়নের থেকে।

ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, অন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে প্রশাসনসহ বিভিন্ন সেক্টরে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এর ফলে অনেক প্রকল্পে বিদেশি ঠিকাদাররা কাজ বন্ধ করে চলে গেছে। এসব কারণে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে, যা বৈদেশিক ঋণের অর্থছাড়েও প্রভাব ফেলেছে। তারা আরও বলেন, ওই সময় মেয়াদি ঋণ কৌশলের অংশ হিসেবে উন্নয়ন প্রকল্পে কম ঋণ নেওয়া হয়েছে। তবে চলমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী থেকে ৩.৪ বিলিয়ন ডলারের বাজেট সহায়তা নেয়া হয়েছে, যা বাজেট সহায়তার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ। এই সহায়তা ঋণ প্রতিশ্রুতি ও অর্থছাড় বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রেখেছে।

শীর্ষ ঋণদাতাদের প্রতিশ্রুতি

ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, বিদায়ী অর্থবছরে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ঋণের প্রতিশ্রুতি পেয়েছে বিশ্বব্যাংক থেকে। এর মধ্যে বাজেট সহায়তা হিসেবে এসেছে ১ বিলিয়ন ডলার, আর মোট প্রতিশ্রুতির পরিমাণ ছিল ২.৮৪৪ বিলিয়ন ডলার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রতিশ্রুতি পেয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে, যা মোট ২.০০৪ বিলিয়ন ডলার—এর মধ্যে ১.৫ বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা হিসেবে ছিল।

বিদায়ী অর্থবছরে বাংলাদেশ জাপান থেকে ১.৮৮৮ বিলিয়ন ডলার, এবং এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি) থেকে ৫৬০.৬৭ মিলিয়ন ডলারের ঋণ প্রতিশ্রুতি পেয়েছে। একই সময়ে সবচেয়ে বেশি ঋণ ছাড় করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) — মোট ২.৫২২ বিলিয়ন ডলার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঋণ ছাড় করেছে বিশ্বব্যাংক, যা ২.০১২ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে, জাপান ১.৫৭৯ বিলিয়ন ডলার, রাশিয়া ৬৭৪.৯৩ মিলিয়ন ডলার, এআইআইবি ৫২৭.৩৭ মিলিয়ন ডলার, চীন ৪১৪.৭ মিলিয়ন ডলার এবং ভারত ১৮৪.৬৩ মিলিয়ন ডলার ঋণ ছাড় করেছে।

**সরকারের ঋণ দাঁড়াবে ২৩.৪২ লাখ কোটি টাকা
**আইএমএফের ১৩৩ কোটি ডলার ঋণ পেল বাংলাদেশ
**তিন মাসে বিদেশি ঋণ কমেছে ৭৪ কোটি ডলার
**রাজস্ব হ্রাস ও খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ
**বাংলাদেশ মধ্যম আয় ও ঋণের ফাঁদে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!