এইচএস কোড পাল্টে পণ্য খালাস নেয় বার্জার পেইন্টস

এক এইচএস কোডের জায়গায় পণ্য শুল্কায়ন করা হয়েছে অন্য এইচএস কোডে। এইচএস কোড পাল্টানোর সঙ্গে পাল্টে গেছে মোট শুল্ককর। যেখানে মোট শুল্ককর হবে ৩১ শতাংশ, সেখানে পরিশোধ করা হয়েছে ১০ শতাংশ। একটি বা দুটি নয়, ২৪টি বিল অব এন্ট্রিতে এইচএস কোড পাল্টে বা অসত্য এইচএস কোডে শুল্কায়ন করে পণ্য খালাস নিয়েছে পুঁজিবাজার তালিকাভুক্ত ‘বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেড’। দেশের রঙের বাজারে শীর্ষস্থানে থাকা বহুজাতিক কোম্পানিটি অসত্য এইচএস কোডে শুল্কায়ন করে বিপুল রাজস্ব পরিহার বা ফাঁকি দিয়েছে। কাস্টমস মূল্যায়ন ও অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিশনারেটের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। শুল্ককর পরিহার করায় প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসকে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। এনবিআর সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

সূত্রমতে, বার্জার পেইন্টের নিরীক্ষা করতে নিরীক্ষা দল গঠন করে কাস্টমস মূল্যায়ন ও অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিশনারেট। নিরীক্ষা দল কোম্পানির আমদানি করা পণ্যের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে এবং অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড থেকেও তথ্য সংগ্রহ করে পর্যালোচনা করে। বিশেষ করে ২০১৭ সাল থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত ‘পিগমেন্ট অক্সাইড ইয়োলো’ নামের পণ্যের আমদানি ও শুল্কায়ন করে খালাস নেয়ার তথ্য যাচাই করা হয়। যাচাইয়ে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি অসত্য এইচএস কোডে পণ্যটি শুল্কায়ন করে খালাস নিয়েছে, যার মাধ্যমে শুল্ককর পরিহার বা ফাঁকি দিয়েছে।

প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেড ২০১৭ সাল থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত ২৪টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে ‘পিগমেন্ট অক্সাইড ইয়োলো’ খালাস নিয়েছে। ২৪টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে চলতি বছর তিনটি, ২০২১ সালে ১০টি, ২০২০ সালে চারটি, ২০১৯ সালে চারটি, ২০১৮ সালে একটি ও ২০১৭ সালে দুটি দাখিল করা হয়। অসত্য ২৮২১.১০.০০ এইচএস কোডে শুল্কায়নের মাধ্যমে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ২৪টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে আমদানি করা পণ্যের শুল্কায়নে মোট শুল্ককর (টোটাল ট্যাক্স ইনসিডেন্স বা টিটিআই) পরিশোধ করেছে ১০ শতাংশ হারে। বাংলাদেশ কাস্টমস ট্যারিফ এবং অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড পর্যালোচনায় দেখা গেছে, আমদানি করা ‘পিগমেন্ট অক্সাইড ইয়োলো’-এর সঠিক এইচএস কোড হবেÑ৩২০৪.১৭.০০, যার মোট শুল্ককর বা টিটিআই হবে ৩১ শতাংশ। এর ফলে এই ২৪টি বিল অব এন্ট্রিতে খালাস নেয়া পণ্যে প্রতিষ্ঠান শুল্ককর পরিহার বা ফাঁকি দিয়েছে ৭০ লাখ ৬৭ হাজার ২৬৩ টাকা।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আমদানিকারক বার্জার পেইন্টস একই পণ্য তিনটি বিল অব এন্ট্রিতে সঠিক এইচএস কোডের (৩২০৪.১৭.০০) মাধ্যমে শুল্কায়ন এবং ৩১ শতাংশ হারে শুল্ককর পরিশোধ করে খালাস নিয়েছে বলে প্রমাণ পেয়েছে নিরীক্ষা দল। তিনটি বিল অব এন্ট্রি হলোÑবিল অব এন্ট্রি নং সি-৬২৮৩ (০২.০১.২০১৯), বিল অব এন্ট্রি নং সি-১২৫৮৯৯৭ (২০.০৮.২০১৮) এবং বিল অব এন্ট্রি নং সি-১৩৭০৭২১ (১৯.০৯.২০১৮)। পরিহার বা ফাঁকি দেয়া শুল্ককর আদায় এবং অসত্য এইচএস কোডে পণ্য খালাস নেয়ায় বার্জার পেইন্টসের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে সম্প্রতি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস কমিশনারকে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপালী চৌধুরীর ব্যক্তিগত নম্বরে ফোন দেয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। বক্তব্যের বিষয় লিখে হোয়াটসঅ্যাপে দেয়া হলে তিনি সিন করেন। তবে কোনো জবাব দেননি। একইভাবে বক্তব্য জানতে কোম্পানির পরিচালক ও প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) সাজ্জাদ রহিম চৌধুরীর ব্যক্তিগত নাম্বারে ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। হোয়াটসঅ্যাপে বক্তব্যের বিষয় লিখে দেয়া হলে তিনি সিন করলেও কোনো জবাব দেননি।

এ বিষয়ে কোম্পানির কর্মকর্তা (হেড অব ভ্যাট) আবদুর সবুর খান বলেন, পণ্যের এইচএস কোড তো কাস্টমস ঠিক করে দেয়। সেই এইচএস কোডে পণ্য খালাস হয়। ফাঁকি দেয়ার প্রশ্নই আসে না। আমাদের ফাঁকি দেয়ার দরকার কী? তিনি বলেন, বিষয়টি শুল্ক মূল্যায়ন থেকে আমাদের জানিয়েছে। আমরা বলেছি, বার্জার সঠিক এইচএস কোডে পণ্য খালাস নেয়। তবে কাস্টম হাউস থেকে আমরা এখনও কোনো চিঠি পাইনি বলে জানান তিনি।

সূত্রমতে, জার্মানির নাগরিক লুইস বার্জার ১৭৬০ সালে যুক্তরাজ্যে রাসায়নিকের ব্যবসা শুরু করেন। বার্জার এ অঞ্চলে ব্যবসা করতে আসে ১৯৫০ সালে। ১৯৭০ সালে বাংলাদেশে তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চট্টগ্রামে বার্জার কারখানা স্থাপন করে। বার্জার পেইন্টস ২০০৬ সালে দেশের উভয় পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। গতকাল পুঁজিবাজারে কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেন হয়েছে এক হাজার ৭৫৫ টাকা ৯০ পয়সায়।

এদিন কোম্পানিটির মোট এক হাজার ৪৪০টি শেয়ার লেনদেন হয়েছে, যার বাজারমূল্য ২৫ লাখ ৩০ হাজার টাকা। ২০২২ হিসাববছরে কোম্পানিটি শেয়ারহোল্ডারদের ৪০০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে। কোম্পানিটির মোট শেয়ারসংখ্যা চার কোটি ৬৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮৮০টি। এর মধ্যে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের কাছে ৯৫ শতাংশ শেয়ার, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ, বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছে দশমিক ১৮ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে ১ দশমিক ০৭ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। কোম্পানিটির রিজার্ভে রয়েছে এক হাজার আট কোটি ৬০ লাখ টাকা। বার্জারের মূল্য ব্যবসা রং। বাড়ি, কাঠ, শিল্পকারখানা, নৌযান ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যবহৃত নানা ধরনের রং উৎপাদন করে তারা। এ ছাড়া রয়েছে আঠা, নির্মাণ খাতে ব্যবহৃত রাসায়নিক ইত্যাদির ব্যবসা। রঙের বাজারে একচ্ছত্র আধিপত্য বার্জারের। বাজার জরিপ অনুযায়ী বার্জারের হিস্যা ৫০ শতাংশের মতো।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!