মেট্রোরেলের যাত্রীদের ভাড়ার পাস সংকটের পেছনে রয়েছে শেখ হাসিনা সরকারের সময় খোয়া যাওয়া ২ লাখ ৪০ হাজার পাস, হঠাৎ করে পাসের চাহিদা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি, সময়মতো প্রয়োজনীয় সংখ্যক পাস সরবরাহে ব্যর্থতা এবং সংশ্লিষ্ট দুই সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব কারণে যাত্রীরা চরম ভোগান্তির মুখে পড়েছেন। তবে কর্তৃপক্ষের দাবি, পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে এবং খুব শিগগিরই সমস্যা অনেকটাই কেটে যাবে।
মেট্রোরেলে ভাড়া পরিশোধে দুটি ধরনের পাস ব্যবহৃত হয়—স্থায়ী পাস এবং একক পাস। স্থায়ী পাসের মধ্যে রয়েছে র্যাপিড পাস ও এমআরটি পাস, আর একক যাত্রার জন্য ব্যবহৃত হয় আলাদা পাস। প্রতিদিন প্রায় চার লাখ যাত্রী এই পাসগুলো ব্যবহার করেন। তাদের মধ্যে ৬০ শতাংশ নিয়মিত যাত্রী স্থায়ী পাস এবং ৪০ শতাংশ অনিয়মিত যাত্রী একক পাস ব্যবহার করে থাকেন। র্যাপিড পাস সরবরাহ করে মেট্রোরেলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ), আর এমআরটি ও একক পাস সরবরাহ করে মেট্রোরেল পরিচালনাকারী সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। র্যাপিড পাস ব্যবহার করে রাজধানীর সবধরনের গণপরিবহনে চলাচল করা গেলেও এমআরটি পাস শুধুমাত্র মেট্রোরেল লাইন-৬ এ ব্যবহৃত হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মেট্রোরেলে চলমান পাস সংকটের মূল কারণ একক পাসের ঘাটতি। ২০২২ সালে মেট্রোরেল চালুর সময় ডিএমটিসিএল মোট ৩ লাখ ২০ হাজার একক পাস সংগ্রহ করেছিল। তবে সে সময়, আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে, পাস সংগ্রহে যাত্রীদের দীর্ঘ লাইনের চিত্র দেখা গেলেও বিপুলসংখ্যক পাস হারিয়ে যাওয়ার বিষয়টি প্রকাশ্যে আনা হয়নি। এমনকি এই সমস্যা প্রতিরোধে কোনো কার্যকর বা দৃশ্যমান পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়নি।
অন্তর্বর্তী সরকারের সময় হঠাৎ জানানো হয়, যাত্রীরা ২ লাখ ৪০ হাজার একক পাস নিয়ে গেছেন, যা পাস সংকটের প্রধান কারণ হিসেবে তুলে ধরা হয়। এ অবস্থায়, ২০২২ সালে কেনা ৩ লাখ ২০ হাজার পাস থেকে কমে গত বছরের নভেম্বর নাগাদ ব্যবহারের উপযোগী পাসের সংখ্যা নেমে আসে মাত্র ৬০ হাজারে। অথচ প্রতিদিন প্রায় দুই লাখ যাত্রী একক পাস ব্যবহার করে থাকেন, ফলে তাদের পড়তে হয় তীব্র ভোগান্তিতে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সম্প্রতি দ্বিতীয় ধাপে ডিএমটিসিএল ১ লাখ ২০ হাজার একক পাস সংগ্রহ করেছে, যা যুক্ত করার প্রক্রিয়াধীন। এই পাসগুলো চালু হলে মোট একক পাসের সংখ্যা দাঁড়াবে ১ লাখ ৮০ হাজারে।
এত বিপুল সংখ্যক পাস কীভাবে হারিয়ে গেল, সে বিষয়ে ডিএমটিসিএল কোনো তদন্ত করেনি। এমনকি পাস হারানো ঠেকাতে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সে সম্পর্কেও স্পষ্টভাবে কিছু জানায়নি তারা। সংশ্লিষ্টদের মতে, যাত্রীরা পাস ফেরত না দিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে এবং হারানো পাস ধাপে ধাপে পুনরায় সরবরাহ করা হলে সংকট এতটা তীব্র হতো না। একক পাস সংকটের ফলে হঠাৎ করে স্থায়ী পাসের চাহিদা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। এখন একক পাস না পেয়ে অনেক যাত্রী স্থায়ী পাস গ্রহণ করছেন, কিন্তু প্রয়োজন না হলে তা ব্যবহার করছেন না। এতে পাস ব্যবস্থার চাপ ও সংকট আরও বেড়েছে।
শতভাগ সরকারি মালিকানাধীন ডিএমটিসিএল তার ২ লাখ ৪০ হাজার পাস হারানোর ঘটনায় কোনো তদন্ত করেছে কিনা— জানতে চাইলে লাইন-৬-এর প্রকল্প পরিচালক মো. জাকারিয়া সরাসরি বলেন, না, না। তিনি জানান, শুরুতে অনেক যাত্রী একাধিক পাস কিনেছিলেন, কেউ কেউ পরিবারের সদস্যদের জন্য পাস নিয়ে জমা দেননি। শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশেও মেট্রোরেলের পাস বা টোকেন হারানো একটি সাধারণ সমস্যা বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, পাস হারানোর বিষয়টি প্রতি সপ্তাহের মিটিংয়ে আলোচনায় এসেছে। তবে কম পাস কিনে বেশি দেখানো হয়েছে বা মানগত কারণে পাসগুলো নষ্ট হয়েছে— এমন আশঙ্কা নাকচ করে দিয়ে তিনি বলেন, কম পাস কিনে বেশি দেখানোর সুযোগ নেই। কাস্টমস থেকে শুরু করে একাধিক ধাপ পেরিয়ে আমাদের কাছে পাস আসে। আর পাসগুলো নষ্ট হয়ে থাকলে সেগুলো আমাদের স্টকে থাকত, অথবা সরবরাহকারী তা বদলে দিত। সেই লটের কিছু পাস এখনো মজুদে আছে, চাইলে দেখে নিতে পারেন। তিনি জানান, পাস সংক্রান্ত বিষয়গুলো মূলত ডিএমটিসিএলের অপারেশন ইউনিট দেখে, তারা এ বিষয়ে আরও স্পষ্ট করে বলতে পারবেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, স্থায়ী পাস ব্যবস্থায় এখন পর্যন্ত ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) বিভিন্ন ধাপে ৬ লাখ ৩৬ হাজার ৫০০ র্যাপিড পাস বিতরণ করেছে। অন্যদিকে, ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) ক্রয় করেছে ৭ লাখ ৩০ হাজার এমআরটি পাস। ফলে দুই ধরনের পাস মিলিয়ে মোট স্থায়ী পাসের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৩ লাখ ৬৬ হাজার ৫০০। তবে সাম্প্রতিক সময়ে পাস সংকট ও অতিরিক্ত চাহিদা দেখা দেওয়ায় ডিটিসিএ আরও ২ লাখ ৫০ হাজার র্যাপিড পাস কেনার উদ্যোগ নেয়। এর মধ্যে ৯০ হাজার পাস ইতোমধ্যে যুক্ত হওয়ার পর্যায়ে রয়েছে। তবে বাকি পাসগুলো নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না।
২০১৯ সালে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট অপারেটর (পিটিও) চুক্তির আওতায় মেট্রোরেলে র্যাপিড পাস চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, জাইকার অর্থায়নে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে ডিএমটিসিএল স্থায়ী পাস হিসেবে র্যাপিড পাস সংগ্রহ করবে এবং ভাড়া আদায় ও সেটেলমেন্টের দায়িত্ব ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)-র কাছে হস্তান্তর করবে। ডিটিসিএ পরে এই পাস বাজারজাত করবে। তবে অভিযোগ রয়েছে, ডিটিসিএ যখন র্যাপিড পাস তৈরির গোপন কোড হস্তান্তর করেছিল, তখন ডিএমটিসিএলের তৎকালীন ক্ষমতাশালী এমডি এম এ এন সিদ্দিক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সহযোগিতায় গোপনে অনুমোদন নিয়ে এমআরটি পাস তৈরি করায়।
তদন্তে জানা গেছে, পিটিও চুক্তি অনুযায়ী মেট্রো স্টেশনের ভিতরে টিকিট অফিস মেশিন (টিওএম) ও টিকিট ভ্যান্ডিং মেশিন (টিভিএম) থেকে র্যাপিড পাস বিক্রির ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু তৎকালীন ডিএমটিসিএলের এমডি এম এ এন সিদ্দিকের একচ্ছত্র সিদ্ধান্তের কারণে স্টেশনে পাস বিক্রি করা হয়নি। এর পাশাপাশি, ডিটিসিএ গণপরিবহনের সমন্বিত ক্লিয়ারিং হাউজের ব্যাংক হিসেবে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের অস্থায়ী বুথ থেকে পাস সরবরাহ শুরু করলেও সিদ্দিক সেটাতেও বাধা দেন।
সর্বশেষ সোমবার ডিটিসিএর সূত্র জানিয়েছে, তাদের কার্ড বিক্রয় ও রিচার্জ এজেন্টদের মেট্রো স্টেশনে বসতে দেওয়া হচ্ছে না। স্টেশন কন্ট্রোলার এজেন্টদের লিখিত অনুমতির কাগজ দেখাতে বলছেন, যাতে স্পষ্ট থাকে যে তারা স্টেশনের ভেতরে স্থায়ী কার্ড (এমআরটি এবং র্যাপিড পাস) রিচার্জ করার অনুমতি পেয়েছে। এই নথি না দেখালে এজেন্টদের স্টেশন থেকে বের করে দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিটিসিএর একজন কর্মকর্তা, নাম প্রকাশ না করার শর্তে, বলেন যে যাত্রী সেবা সহজ ও দ্রুত করতে ডিএমটিসিএলের অনুমতি নিয়ে ডিটিসিএ তাদের এজেন্টদের স্টেশনে বসিয়েছে। তবে ডিএমটিসিএলের বুথে লম্বা লাইন থাকলেও ডিটিসিএর এজেন্টদের স্টেশন থেকে বের করে দেয়ার কারণ তিনি জানেন না। এর ফলে যাত্রী সেবায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এছাড়া প্রশ্ন উঠেছে, ডিএমটিসিএল ট্রান্সপোর্ট কী না দেওয়ায় কি ডিটিসিএর নিয়োগকৃত এজেন্টদের স্টেশন থেকে বের করে দিচ্ছে?