** ২০১৫ সালে উদ্বোধন হয়, ২০১৫-১৬ থেকে ২০২০-২১ করবর্ষ পর্যন্ত রিটার্ন ও কর দেয়নি
** ব্যাংক হিসাব যাচাই করে আয়-ব্যয় খতিয়ে দেখা ও করফাঁকি উদ্ঘাটনের নির্দেশ
** ৬০ দিনের মধ্যে কর মামলা নিষ্পত্তি আর ৩০ দিনের মধ্যে অগ্রগতি জানানোর নির্দেশ
পর্যটন নগরী কক্সবাজারের কলাতলী বিচের মেরিন ড্রাইভে অবস্থিত পাঁচ তারকা মানের হোটেল সায়মন বিচ রিসোর্ট লিমিটেড। সমুদ্র তীরবর্তী অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত এই রিসোর্ট ২০১৫ সালে উদ্বোধন হয়। উদ্বোধনের পর থেকে ১৯৬৪ সালে যাত্রা শুরু করা ঐতিহ্যবাহী ‘হোটেল সায়মন’-এর অঙ্গপ্রতিষ্ঠান সায়মন বিচ রিসোর্ট কোন আয়কর রিটার্ন দাখিল করেনি। এমনকি কোন প্রকার কর পরিশোধ করেনি। উদ্বোধনের সময় থেকে প্রায় ৮ বছরেও কোন রিটার্ন দাখিল ও কর পরিশোধ না করায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। গত ৮ বছরে বিলাসবহুল এই রিসোর্টের বিরুদ্ধে কর অফিস থেকে কোন ব্যবস্থা না নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। আধুনিক এই রিসোর্ট করফাঁকি দিতে বছরের পর বছর রিটার্ন দাখিল না করারও অভিযোগ উঠেছে। তবে এই রিসোর্টের মতোই দেশের বহু বিলাসবহুল হোটেল, রিসোর্ট করফাঁকি দিয়ে আসছে বলে জানিয়েছেন এনবিআর কর্মকর্তারা। এনবিআর সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
এনবিআর সূত্রমতে, দেশের বিলাসবহুল, পাঁচ তারকা হোটেল, রিসোর্ট সঠিকভাবে কর দেয় না বলে অভিযোগ পায় এনবিআর। এছাড়া বহু হোটেল, রেস্টুরেন্টের কর বকেয়া রয়েছে বলে অভিযোগ উঠে। এরই প্রেক্ষিতে সম্প্রতি এনবিআর চেয়ারম্যান বিলাসবহুল, পাঁচ তারকা হোটেল, রিসোর্ট, রেস্টুরেন্ট, পর্যটন ব্যবসাসহ দেশের সব হোটেলের রিটার্ন দাখিল ও কর পরিশোধের তথ্য চেয়ে কমিশনারদের চিঠি দেয় এনবিআর। যাতে ২০১৭-১৮ থেকে ২০২০-২১ করবর্ষ পর্যন্ত তথ্য দিতে বলা হয়। সব কমিশনার এনবিআরের নির্দেশনা অনুযায়ী তথ্য দিয়েছে। হোটেল, রিসোর্ট এর আয় আর কর পরিশোধের তথ্য বিশ্লেষণ করে হতাশ এনবিআর কর্মকর্তারা। কারণ বেশিরভাগ হোটেল, রিসোর্ট, রেস্টুরেন্ট যে কর দেয় তার তিনগুণ করফাঁকি হচ্ছে বলে মনে করেন তারা।
সূত্র আরো জানায়, কর অঞ্চল-১ চট্টগ্রাম থেকেও তথ্য দেয়া হয়। যাতে দেখা গেছে, হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও পর্যটন ব্যবসা থেকে এ কর অঞ্চল ২০১৭-১৮ করবর্ষে প্রায় এক কোটি ১০ লাখ, ২০১৮-১৯ করবর্ষে প্রায় এক কোটি ৪৫ লাখ, ২০১৯-২০ করবর্ষে প্রায় পৌনে দুই কোটি ও ২০২০-২১ করবর্ষে প্রায় ৩৪ লাখ টাকা কর আদায় করেছে। তবে কর অঞ্চল থেকে দেয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কক্সবাজারের পাঁচ তারকা হোটেল সায়মন বিচ রিসোর্ট ২০১৬-১৭ হতে ২০২০-২১ করবর্ষ পর্যন্ত রিটার্ন দাখিল ও কর পরিশোধ করেনি। ফলে সম্পূর্ণ তথ্য কর অঞ্চল দিতে পারে। দেশের পাঁচ তারকা হোটেল হলেও উদ্বোধনের পর থেকে রিটার্ন দাখিল ও কর পরিশোধ না করায় হতাশ হয় এনবিআর চেয়ারম্যান ও কর কর্মকর্তারা। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে এনবিআরের একটি সংস্থাকে নির্দেশ দেয়া হয়। নির্দেশনা অনুযায়ী সেই সংস্থা এই হোটেলের আয়কর সংক্রান্ত নথি যাচাই করে। যাতে প্রতিষ্ঠানটির রিটার্ন দাখিল ও কর পরিশোধ না করার চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে। পরে চেয়ারম্যান দপ্তরে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে।
সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সায়মন বিচ রিসোর্ট লিমিটেড কর অঞ্চল-১ চট্টগ্রাম এর আওতাধীন করদাতা। করদাতা কোম্পানি সায়মন বিচ ২০১৬-১৭ করবর্ষ থেকে ২০১৯-২০ করবর্ষ পর্যন্ত আয়কর রিটার্ন দাখিল ও কোন প্রকার কর পরিশোধ করেনি। রিটার্ন দাখিল না করার প্রেক্ষিতে প্রতিবেদনে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে স্থানীয় কর অফিসকে সায়মন বিচ হতে ২০১৬-১৭ থেকে ২০১৯-২০ করবর্ষ পর্যন্ত রিটার্ন সংগ্রহ করে নথিতে সংরক্ষণ করতে বলা হয়েছে। এছাড়া ২০১৫-১৬ থেকে ২০১৯-২০ করবর্ষ পর্যংন্ত কর মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি ও প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, সায়মন বিচ রিসোর্টের নথি যাচাই করে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি কক্সবাজার পৌরসভা হতে যে লাইসেন্স নিয়েছে, তা রিয়েল এস্টেট ব্যবসার লাইসেন্স। অর্থাৎ করদাতা কোম্পানির হোটেল ব্যবসা ছাড়াও রিয়েল এস্টেট ব্যবসা রয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে; যা কোম্পানি গোপন করে আসছে। এক্ষেত্রে সায়মন বিচ রিসোর্টের মামলা নিস্পত্তির সময় রিয়েল এস্টেট ব্যবসা সংক্রান্ত সঠিক তথ্য সংগ্রহ করে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির আগের নথির রেকর্ড অনুযায়ী, করদাতা কোম্পানির ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক ও সাউথইস্ট ব্যাংকে ব্যাংক হিসাব রয়েছে। নথিতে সায়মন বিচ সঠিক আয় প্রদর্শন করেনি। সেজন্য এই দুইটি ব্যাংকসহ সকল তফসিলি ব্যাংকে আয়কর অধ্যাদেশ এর ১১৩ (এফ) ধারা অনুযায়ী কার্যক্রম গ্রহনের মাধ্যমে সঠিক তথ্য সংগ্রহ করে আয় নিরূপণের প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, করদাতা কোম্পানির ২০১৫-১৬ থেকে ২০১৯-২০ করবর্ষ পর্যন্ত কর মামলাসমূহ আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪ এর ৯৩ ধারা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় আইনানুগ কার্যক্রম গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। সায়মন বিচ রিসোর্ট লিমিটেড উচ্চ রাজস্ব সম্ভাবনাময় হওয়া সত্ত্বেও ২০১৫-১৬ থেকে ২০১৯-২০ করবর্ষ পর্যন্ত কোন করবর্ষেই রিটার্ন দাখিল করেনি। ৬০ দিনের মধ্যে আয়কর রিটার্ন গ্রহণ ও মামলা সম্পূর্ণ করে ওই সংস্থাকে অবহিত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া ৩০ দিনের মধ্যে এ বিষয়ে অন্তবর্তীকালীন অগ্রগতি ওই সংস্থাকে জানাতে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে সায়মন বিচ রিসোর্ট লিমিটেড এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুব রহমান এর সঙ্গে চেষ্টা করা হয়। তিনি বিদেশে থাকায় যোগাযোগ করা যায়নি। তবে তার ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে বক্তব্য জানতে প্রশ্ন দেওয়া হলেও তিনি উত্তর দেননি। বক্তব্য জানতে হোটেলের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) নুরুল আজিম এর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি বিষয়টি শোনার পর তার চট্টগ্রাম অফিসে যোগাযোগ করার জন্য বলেন। পরে একাধিকবার ফোন দেয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। তার হোয়াটঅ্যাপে প্রশ্ন লিখে দেওয়া হলে তিনি সিন (দেখেছেন) করেও কোন জবাব দেননি।
সূত্রমতে, দেশের পর্যটন শিল্পে সোনালী ঐতিহ্যের সঙ্গে দীর্ঘ নতুন মাত্রা যোগ করার প্রত্যয়ে কক্সবাজারে যাত্রা শুরু করে সায়মন বিচ রিসোর্ট। ২০১৫ সালের ১৫ জানুয়ারি জমকালো আয়োজনের মধ্য দিয়ে এই রিসোর্টের উদ্বোধন হয়। সেই ১৯৬৪ সালে যাত্রা শুরু করা ঐতিহ্যবাহী ‘হোটেল সায়মন’-এর অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হিসেবে পথচলা শুরু হয়। পর্যটন নগরী কক্সবাজারের প্রথম প্রাইভেট হোটেল সায়মন। কক্সবাজারের প্রাণকেন্দ্রে স্থাপিত এই হোটেলটি ছিল তৎকালীন সময়ের অন্যতম অভিজাত এবং আন্তর্জাতিক মানের হোটেল। মনোরম পরিবেশ, আন্তরিক সেবা ও অনন্য আতিথেয়তায় মানুষের মন জয় করে এটি। যার ফলে দেশের এলিট শ্রেণীর মানুষদের অবকাশকালীন প্রিয় ঠিকানা ছিলো এটি।
কলাতলী বিচের মেরিন ড্রাইভে ২২৮টি অভিজাত রুম সম্বলিত ফাইভ স্টার মানের সমুদ্রতীরবর্তী এই রিসোর্টে রয়েছে অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা। ১৬ টি প্যানারমা ওশান স্যুট, ৩৬ টি ডিলাক্স স্যুট এবং ১৭৬ টি সি-ভিউ রুমে রয়েছে এলসিডি টিভি, কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, কেন্দ্রীয় ওয়াটার হিটিং সিস্টেম রুম কন্ট্রোলারসহ বহুমাত্রিক বিলাসবহুল ব্যবস্থা। বেশিরভাগ রুম থেকেই সমুদ্র সৈকত দেখা যাবে। রয়েছে তিনটি রেষ্টুরেন্ট, সুপরিসর সুইমিংপুল এবং বার ডেক। করপোরেট মিটিং এবং অন্যান্য ইভেন্টের জন্য রয়েছে সুবিশাল কনভেশন হল। মেরিনা বলরুমে প্রায় ৭০০ অতিথির জন্য আসন ব্যবস্থা রয়েছে। পর্যটকদের সর্বোচ্চ সেবাই এই রিসোর্টের মূল ব্রত নিয়ে এটি যাত্রা শুরু করে।