হাসিনার লুটের সহযোগী ‘ইউনাইটেড গ্রুপ’

সেনানিবাসের শহিদ মইনুল হক সড়কের বাড়ি ভেঙে বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে উচ্ছেদের পর ইউনাইটেড গ্রুপে জ্বলে উঠে ‘আলাদিনের চেরাগ’, যা আজও নিভে যায়নি এমন মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের অভিযোগ, বাড়িটি ভাঙার পেছনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন ইউনাইটেড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মইনুদ্দীন হাসান রশীদের এক নিকটাত্মীয়, যিনি ওই সময় সরকারের উচ্চ পদে ছিলেন। তার সহযোগিতায় হাসিনা সরকারের আশীর্বাদ লাভ করে গ্রুপটি গত সাড়ে ১৫ বছরে রীতিমতো ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ বনে যায়। বিশেষ করে বিদ্যুৎ খাতে নজিরবিহীন সুযোগ-সুবিধা আদায় করে কয়েক হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে। বাড়িটি ভাঙার পুরস্কার হিসেবে নির্বিঘ্নে এসব অপকর্ম সম্পন্ন হয়েছে, যেখানে সরাসরি সহযোগিতা করেছেন প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ও তার বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। অভিযোগ আছে, বিপুকে ঘুষ হিসেবে নামমাত্র মূল্যে দেওয়া হয়েছে রাজধানীর ১০০ ফিট সড়কের পাশে ৮০ কাঠা জমি, যার বর্তমান মূল্য দেড়শ কোটি টাকার বেশি।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৮ সালের ৪ জুন নসরুল হামিদ বিপু ৮০ কাঠা জমি রেজিস্ট্রি করেন আলিফা প্রপার্টিজ লিমিটেডের নামে, যার দলিল মূল্য ছিল মাত্র ২ কোটি ১৭ লাখ ৪২ হাজার টাকা। জমিটি খিলগাঁও সাবরেজিস্ট্রি অফিসে রেজিস্ট্রি হয় এবং এটি ইউনাইটেড গ্রুপের ভবনসংলগ্ন ১০০ ফিট সড়কের পাশে অবস্থিত। জমিটির রেজিস্ট্রি করান ইউনাইটেড গ্রুপের তৎকালীন এমডি আবুল কালাম আজাদ। আলিফা প্রপার্টিজের মালিকানাধীন এই জমির ঠিকানা বনানী, যেখানে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান অফিস ‘প্রিয়াঙ্গন টাওয়ার’ হিসেবে পরিচিত। এর আগে, ২১ আগস্ট বিপুর বাসায় যৌথ বাহিনীর অভিযান থেকে ১ কোটি ৫১ হাজার টাকা, ৫১০ তুর্কি লিরা, ২০০ পাউন্ড, একটি পিস্তল, দুটি ম্যাগাজিন ও ৫০ রাউন্ড গুলি জব্দ করা হয়। বিপুর ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান তার স্ত্রী সীমা হামিদ।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ইউনাইটেড গ্রুপের জন্য অনিয়ম ছিল নিয়মের অংশ। গ্রুপটি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মাধ্যমে দুর্নীতি ও ঘুস দিয়ে বিদ্যুৎ সেক্টর থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, এবং সাবেক মুখ্য সচিব আহমেদ কায়কাউসের প্রভাব খাটিয়ে গ্রুপটি ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্রকে আইপিপি হিসেবে রূপান্তরিত করেছে। ইপিজেডে বিদ্যুৎ উৎপাদনের নামে পাওয়ার প্ল্যান্ট তৈরি করে সেই বিদ্যুৎ পিডিবির কাছে চড়া দামে বিক্রি করেছে, ফলে সাধারণ গ্রাহকের উপর আর্থিক বোঝা বেড়েছে। সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ’ করে কম দামে গ্যাস কিনে বিদ্যুৎ ক্যাপটিভ রেটে বিক্রি করেছে, এতে তিতাস গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড ৫০০ কোটি টাকা রাজস্ব হারিয়েছে।

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) সাবেক একজন চেয়ারম্যান বলেন, ‘আইন অনুযায়ী ইউনাইটেডের বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটি ক্যাপটিভ ক্যাটাগরির। আইপিপি হিসাবে তাদের দর নির্ধারণের কোনো সুযোগ নেই। ইউনাইটেড বিইআরসিতে এলে আমরা তাদের আবেদন নাকচ করে দেই। রিভিউয়ের আবেদনও নাকচ হয়ে যায়।’ তিনি বলেন, ‘আমি যতদূর জানি হাইকোর্টও তাদের আবেদন নাকচ করে দিয়েছেন। ইউনাইটেডের দুটি প্রকল্প শুরু হয়েছে ক্যাপটিভ হিসাবে। আইপিপি হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না।’

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. শামসুল আলম বলেন, ইউনাইটেড গ্রুপকে দেওয়া লাইসেন্স রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থি। রাষ্ট্রের সংবিধান, আইন ও নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বেসরকারি কোনো কোম্পানিকে ডিস্ট্রিবিউশন লাইসেন্স দেওয়ার এখতিয়ার নেই। কিন্তু ইউনাইটেড গ্রুপ ডিস্ট্রিবিউশন করছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কি আইনের ঊর্ধ্বে ছিলেন? তিনি নির্দেশ দিলেই অনুমোদন দেওয়া যাবে না। এটা দেওয়ার এখতিয়ার প্রধানমন্ত্রীর নেই। ক্যাপটিভ শ্রেণির গ্রাহককে আইপিপির রেটে গ্যাস দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিদ্যুৎ বিভাগের তৎকালীন উপসচিব সাইফুল আজাদ স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের প্রেক্ষিতে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ক্যাপটিভ শ্রেণিতে ৩০ টাকা (ঘনমিটার) হিসাবে গ্যাস ক্রয় করে ঢাকা-চট্টগ্রাম ইপিজেডে স্থাপিত দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র আইপিপি হিসাবে লাইসেন্স প্রদানের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’ চিঠিতে বর্ণিত সিদ্ধান্তের আলোকে আইপিপি গ্যাস শ্রেণির জন্য বিদ্যুৎ ট্যারিফ নির্ধারণে বিইআরসিকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত জানানো হয়।

সম্প্রতি ইউনাইটেড গ্রুপের এমডি মইনুদ্দীন হাসান রশীদকে অভিযোগের বিষয়ে অবহিত করা হলে, তার পক্ষে শামীম মিয়া জানান যে, ইউনাইটেড গ্রুপ সব আইন মেনে তিতাস গ্যাসের সঙ্গে চুক্তি করেছে এবং তাদের সব কাগজপত্র রয়েছে। তিনি দাবি করেন, তিতাসের কাছে কোনো বকেয়া নেই এবং সরকার তাদের দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য অনুমোদন দিয়েছে। তিনি আরও জানান, ইপিজেডে অব্যবহৃত বিদ্যুৎ বাইরে বিক্রি করতে হচ্ছে এবং আইপিপি রেটে গ্যাস কেনার অনুমোদন থাকলেও, তিতাস গ্যাস তাদের বিল ক্যাপটিভ রেটে দিচ্ছে। এই সমস্যা সমাধানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল, এবং তার পরবর্তী সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিল প্রদান করা হচ্ছে।

জানা গেছে, ইউনাইটেড গ্রুপের দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র ঢাকা ও চট্টগ্রামের ইপিজেডে অবস্থিত, যেখানে যথাক্রমে ৮৬ ও ৭২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। তারা সরকারি গ্যাস ব্যবহার করে এই বিদ্যুৎ উৎপাদন করে, যা কম দামে ইপিজেডে বিক্রি করার কথা ছিল। তবে, তারা অব্যবহৃত বিদ্যুৎ বাইরে ক্যাপটিভ রেটে বিক্রি করে, যার ফলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৪ টাকা ১৭ পয়সা খরচ হলেও, বাইরে ১০ টাকা ৮৮ পয়সায় বিক্রি করে দ্বিগুণ আয় করেছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগ বিষয়টি জানতে পারলে তিতাস গ্যাসকে ক্যাপটিভ রেটে বিল করার নির্দেশ দিলেও, গ্রুপটি তা মানেনি এবং তাদের ৫০০ কোটি টাকার বিলও আটকে দিয়েছে।

জানা যায়, কেপিসিএলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ খাতে যাত্রা শুরু ইউনাইটেড গ্রুপের। সামিট গ্রুপের সঙ্গে যৌথভাবে এ যাত্রা শুরু হয় তাদের। পরে এককভাবে একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলে গ্রুপটি। বেসরকারি খাতে দ্বিতীয় বৃহৎ বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী ইউনাইটেড গ্রুপ। বর্তমানে ইউনাইটেড গ্রুপের ছয়টি নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। এছাড়া কেপিসিএলের ৩৫ শতাংশ, পায়রায় একটি কেন্দ্রের ৮২ দশমিক ৫০ শতাংশ ও আশুগঞ্জের একটি কেন্দ্রের ৯৩ শতাংশ শেয়ার রয়েছে ইউনাইটেডের। যদিও অভিযোগ আছে-এই ৯৩ শতাংশ শেয়ার হাতিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে বড় ধরনের ‘আন্ডার হ্যান্ড ডিলিং’ হয়েছে একটি সরকারি কোম্পানির সঙ্গে। সব মিলিয়ে বর্তমানে ইউনাইটেড গ্রুপের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা এক হাজার পাঁচ মেগাওয়াট।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড থেকে পাওয়া (পিডিবি) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৩ বছরে গ্রুপটি নিজস্ব কেন্দ্রগুলোর জন্য প্রায় ৬ হাজার ৬০৪ কোটি ৭৪ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ হাতিয়ে নিয়েছে। আর কেপিসিএলের ৩৫ শতাংশ ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ১২ বছরে নিয়েছে প্রায় এক হাজার ২৭৫ কোটি ১৪ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে প্রায় সাত হাজার ৮৮০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ইউনাইটেড গ্রুপ।

নসরুল হামিদ বিপু বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর ইউনাইটেড গ্রুপ একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স পেতে শুরু করে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তাদের উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ২৯৩ মেগাওয়াট এবং ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয় ৪৩৬ কোটি ৩২ লাখ টাকা। পরবর্তীতে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তাদের উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে ৪৯৩ মেগাওয়াট হয় এবং ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল ৪৪২ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। ২০১৮-১৯ সালে উৎপাদন সক্ষমতা ৬০৮ মেগাওয়াট এবং ক্যাপাসিটি চার্জ ৭৬৫ কোটি ২৬ লাখ টাকা। ২০১৯-২০ সালে উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে ৮৫৫ মেগাওয়াটে দাঁড়ায়, যার ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল এক হাজার ২৩৬ কোটি ১৮ লাখ টাকা। ২০২০-২১ সালে ইউনাইটেড পায়রাকেন্দ্রসহ তাদের উৎপাদন সক্ষমতা এক হাজার মেগাওয়াটে পৌঁছায় এবং ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল এক হাজার ৩৩৫ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। গত অর্থবছরে তাদের ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল এক হাজার ৩৬৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা।

এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বাইরে, ইউনাইটেড গ্রুপ এবং এর কয়েকজন পরিচালক কেপিসিএলের ৩৫ শতাংশ শেয়ারের মালিক। ২০১০ সালের এপ্রিলে কেপিসিএল পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় এবং এক সময় এই কোম্পানির অধীনে তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র ছিল। এসব কেন্দ্রের জন্য ইউনাইটেড গ্রুপ ১২ বছরে প্রায় এক হাজার ২৭৫ কোটি ১৪ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ পেয়ে থাকে।

সূত্র-দৈনিক যুগান্তর (৩ মার্চ ২০২৫)

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!