আ.লীগের ১৩ বছরে রাজস্ব বেড়েছে ৪৮৬%

## ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছর লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ১৩ হাজার কোটি, ২০২১-২২ অর্থবছর হয়েছে ৩ লাখ কোটি
## ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছর আদায় হয়েছিলো সাড়ে ১২ হাজার কোটি, ২০২১-২২ অর্থবছর হয়েছে ৩ লাখ কোটি
## করোনাকালীন ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছর আদায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২১ ও ১৬ শতাংশ

শাহেদ মো. রাসেল: বর্তমান সরকার টানা তৃতীয় মেয়াদ ক্ষমতায় রয়েছে। আর বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় রয়েছে। টানা তৃতীয় মেয়াদে ১৪ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকায় উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষা হচ্ছে। উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে। তৈরি হয়েছে কর্মসংস্থান। বেড়েছে অর্থনীতির আকার। যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে করজাল। সরকারের টানা ১৪ বছরে ১৩ বছরে (২০০৯-১০ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর) রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা বেড়েছে ৫৪০ শতাংশ আর আদায় বেড়েছে ৪৮৬ শতাংশ। করোনা মহামারীর মধ্যেও রাজস্ব প্রবৃদ্ধি ছিলো সন্তোষজনক। আবার বর্তমান সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর লক্ষ্যমাত্রা ও আদায় ৫০ হাজার কোটি টাকার ঘর পার করে। আর চতুর্থবার ক্ষমতায় আসার পর লক্ষ্যমাত্রা আর আদায় পার হয়েছে তিন লাখ কোটি টাকা। এনবিআরের সক্ষমতা আরো করলে আদায় বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করেন রাজস্ব সংশ্লিষ্টরা।

সূত্রমতে, ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। জয় লাভ করার পর বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার ৬ জানুয়ারি দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করে। এনবিআরের গবেষণা ও পরিসংখ্যান অনুবিভাগের হিসাবমতে ওই অর্থবছর অর্থাৎ ২০০৮-০৯ অর্থবছর এনবিআরের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ৫৩ হাজার কোটি টাকার বিপরীতে আদায় হয় প্রায় ৫২ হাজার ৫২৭ কোটি টাকা। আহরণ প্রবৃদ্ধি ছিলো ১০ দশমিক ৭৩ শতাংশ। ওই অর্থবছর সরকার মাত্র ছয় মাস সময় পেয়েছিলো। ওই অর্থবছর রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ও আদায় প্রথমবারের মতো ৫০ হাজার কোটি টাকার ঘর ছুঁয়ে যায়। আর ২০০৯-১০ অর্থবছর রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ৬১ হাজার কোটি টাকার বিপরীতে আদায় হয়েছিলো ৬২ হাজার ৪২ কোটি ১৬ লাখ টাকা। আদায় প্রবৃদ্ধি ছিলো ১৮ দশমিক ১১ শতাংশ। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় এক হাজার ৪২ কোটি ১৬ লাখ টাকা বেশি আদায় হয়েছিলো। সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই রাজস্ব আদায়ে এনবিআরকে বাস্তবামুখী দিক-নির্দেশনা দেয়। যার ফলে সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম বছরই রাজস্ব আহরণে উল্ফলন দেখা দেয়।

মানুষের ক্ষয় ক্ষমতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যয়ের পরিমাণও বেড়ে যায়। সরকারের উন্নয়নের ফলে বাড়তে থাকে অর্থনীতির আকার। যার উপর ভর করে প্রতিবছর রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ও আদায় বাড়তে থাকে। আর সদ্য বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছর লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার বিপরীতে আদায় হয়েছে ৩ লাখ এক হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের বছর আদায় ছিলো ৬২ হাজার ৪২ কোটি ১৬ লাখ টাকা। আর বিদায়ী অর্থবছর আদায় হয়েছিলো ৩ লাখ এক হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেছে ১৪ বছর চলছে। এর মধ্যে ১৩ বছরে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা বেড়েছে ৫৪০ শতাংশ আর আদায় বেড়েছে ৪৮৬ শতাংশ। বিদায়ী অর্থবছর করোনা মহামারী সত্ত্বেও রাজস্ব আদায় বেড়েছে।

হিসাবে আরো দেখা গেছে, ২০১০-১১ অর্থবছর লক্ষ্যমাত্রা ৭৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকার বিপরীতে আদায় হয়েছে ৭৯ হাজার ৪০৩ কোটি ১১ লাখ টাকা। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৭ দশমিক ৯৮ শতাংশ। ২০১১-১২ অর্থবছর ৯২ হাজার ৩৭০ কোটি টাকার বিপরীতে আদায় হয়েছে ৯৫ হাজার ৫৮ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। প্রবৃদ্ধি হয় ১৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। ২০১২-১৩ অর্থবছর লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ১২ হাজার ২৫৯ কোটি টাকার বিপরীতে আদায় হয় ১ লাখ ৯ হাজার ১৫১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। আদায় প্রবৃদ্ধি হয় ১৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ।

অপরদিকে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ বিজয়ী হয়। ১২ জানুয়ারি তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতা গ্রহণ করে আওয়ামীলীগ। ক্ষমতায় এসেই সরকার উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় রক্ষায় লক্ষ্যমাত্রা ও আদায় বাড়ানোর উপর জোর দেয়। ক্ষমতা গ্রহণের বছর অর্থাৎ ২০১৩-১৪ অর্থবছর লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার বিপরীতে আদায় হয় ১ লাখ ২০ হাজার ৮৮১৯ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। প্রবৃদ্ধি হয় ১০ দশমিক ৬৯ শতাংশ। একইভাবে ২০১৪-১৫ অর্থবছর লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৩৫ হাজার ২৮ কোটি টাকার বিপরীতে আদায় হয় ১ লাখ ৩৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধি হয় ১২ দশমিক ৩২ শতাংশ। ২০১৫-১৬ অর্থবছর লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার বিপরীতে আদায় হয় ১ লাখ ৫৩ হাজার ৬২৬ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। প্রবৃদ্ধি হয় ১৩ দশকি ২১ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছর লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকার বিপরীতে আদায় হয় ১ লাখ ৭১ হাজার ৬৫৬ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। প্রবৃদ্ধি হয় ১১ দশমিক ৭৪ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছর লক্ষ্যমাত্রা ও আদায় প্রথমবারের মতো দুই লাখ কোটি টাকার ঘর পার করে। ওই অর্থবছর লক্ষ্যমাত্রা ২ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার বিপরীতে আদায় হয় ২ লাখ ২ হাজার ৩১২ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। প্রবৃদ্ধি হয় ১৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ।

অপরদিকে, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আবারও নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জনের পর ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি সরকার গঠন করে। আওয়ামী লীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা টানা তৃতীয়বারসহ চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন। ক্ষমতায় আসার পর উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখা হয়। দেশে ব্যবসার প্রসার লাভ করে, বাড়তে থাকে কলকারখানা ও কর্মসংস্থান। যার ফলে বিস্তৃত করা হয় করজাল। ২০১৮-১৯ অর্থবছর লক্ষ্যমাত্রা পৌনে তিন লাখ কোটি টাকার ঘরে উন্নীত হয়। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রা ২ লাখ ৮০ হাজার ৬৩ কোটি টাকার বিপরীতে আদায় হয় ২ লাখ ২০ হাজার ৭৭১ কোটি ৬২ লাখ টাকা। প্রবৃদ্ধি হয় ৯ দশমিক ১২ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছর লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। ওই অর্থবছর লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৫০০ কোটি টাকার বিপরীতে আদায় হয় ২ লাখ ১৬ হাজার ৪৫১ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছর লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ১০০ কোটি টাকার বিপরীতে আদায় হয় ২ লাখ ৬১ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধি হয় ২১ শতাংশ। আর বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছর লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার বিপরীতে আদায় হয়েছে ৩ লাখ ১ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধি হয় ১৬ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ।

অপরদিকে, ১৯৯৬ সালের ১২ জুন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যাতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ২৩ জুন শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। ক্ষমতায় আসার পরপরই দেশের উন্নয়নে মনোযোগ দেয় সরকার। রাজস্ব আদায় তথা করনেট সম্প্রসারণে উদ্যোগ নেয়া হয়। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলে অর্থনীতি বড় হতে থাকে। যার ফলে বাড়তে থাকে রাজস্ব আহরণ। সরকার ক্ষমতা গ্রহণের বছর অর্থাৎ ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছর লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ১৩ হাজার ৪০ কোটি টাকা। যার বিপরীতে আদায় হয়েছে ১২ হাজার ৫০৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা। প্রবৃদ্ধি হয় ৯ দশমিক ৯৭ শতাংশ। ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছর লক্ষ্যমাত্রা ১৪ হাজার ১০০ কোটি টাকার বিপরীতে আদায় হয় ১৩ হাজার ৮০১ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। প্রবৃদ্ধি হয় ১০ দশমিক ৩৯ শতাংশ। ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছর লক্ষ্যমাত্রা ১৪ হাজার ৮৫০ কোটি টাকার বিপরীতে আদায় হয় ১৪ হাজার ৮৬৯ কোটি ২৯ লাখ টাকা। প্রবৃদ্ধি হয় ৭ দশমিক ৭৩ শতাংশ। ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছর লক্ষ্যমাত্রা ১৬ হাজার কোটি টাকার বিপরীতে আদায় হয় ১৫ হাজার ১২৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা। ২০০০-২০০১ অর্থবছর লক্ষ্যমাত্রা ১৮ হাজার ৩০০ কোটি টাকার বিপরীতে আদায় হয় ১৮ হাজার ৭৭৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। প্রবৃদ্ধি হয় ২৪ দশমিক ১৪ শতাংশ। অর্থাৎ সরকারের শেষ বছর আদায় এবং প্রবৃদ্ধি দুটোই বেড়ে যায়। ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়।

এনবিআরের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ২০২০ সালের মার্চ মাসে বিশ্বব্যাপী কভিড-১৯ অতিমারী শুরু হয়। করোনাভাইরাসের ধাক্কা লাগে বিশ্ব অর্থনীতিতে, যার প্রভাব পড়ে দেশের অর্থনীতিতে। কভিড মোকাবেলায় সরকার বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেয়। এর মধ্যে অন্যতম হলো আমদানি-রপ্তানি সচল রাখা। সরকারের নির্দেশে সব বন্দর ও হাউস সচল ছিলো। যার ফলে আমদানি-রপ্তানি একদিনের জন্যও বন্ধ ছিলো না। এছাড়া ভ্যাট ও আয়কর আদায় করা হয়েছে। অতিমারী সত্ত্বেও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে কাজ করেছে। এতে করোনাভাইরাস আক্রান্ত হয়ে কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী মারা গেছেন। সরকারের বাস্তবমুখী পদক্ষেপের ফলে কভিডকালীন ২০২০-২১ অর্থবছর এনবিআর ২১ শতাংশ এবং ২০২১-২২ অর্থবছর ১৬ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের নজির স্থাপন করেছে। এতে প্রমাণিত হয়েছে যে, সঠিক পরিকল্পনা এবং কর্মকৌশল অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালিত হলে যেকোনো পরিস্থিতিতে রাজস্ব আহরণ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি করা সম্ভব। এছাড়া সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী এনবিআর কাজ করায় ১৩ বছরে রাজস্ব আদায় জ্যামিতিক হারে বেড়েছে বলে মনে করেন তারা।

ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের মতে, রাজস্ব আদায় প্রক্রিয়া পুরোপুরি অটোমেশন করার চেষ্টা করছে সরকার। বিশেষ করে ভ্যাট ও আয়কর আদায় প্রক্রিয়া অটোমেশন করা হচ্ছে। অনলাইনভিত্তিক করা হলে একদিকে ফাঁকি প্রতিরোধ হবে, অন্যদিকে আদায় বৃদ্ধি পাবে। তাদের মতে, অভ্যন্তরীণ আদায় করা রাজস্ব পদ্মাসেতু, কর্ণফুলী টানেল, মেট্টোরেলসহ বড় বড় প্রকল্পে যোগান দেয়া হচ্ছে।

###

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!