আরও ১.৫ লাখ কোটি টাকা বাড়বে খেলাপি ঋণ

দখল ও লুটপাটের কারণে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের মাত্রা উদ্বেগজনক হারে বেড়ে যাচ্ছে। জুন প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ আরও দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে, ফলে মোট খেলাপি ঋণ পৌঁছাতে পারে পাঁচ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার ওপরে। এভাবে খেলাপি ঋণের হার ভবিষ্যতে মোট ঋণের ৩০–৪০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে। খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট আরও গভীর হবে এবং কিছু দুর্বল ব্যাংক থেকে আমানতকারীরা টাকা তোলার ক্ষেত্রে আরও সমস্যায় পড়বেন। বর্তমানে ১২টি ব্যাংক কার্যত দেউলিয়া, যা আমানতকারীদের টাকা দিতে পারছে না। এ ছাড়া ১৫টি ব্যাংক অতিমাত্রায় দুর্বল হয়ে পড়েছে, যার মধ্যে অর্ধেকের বেশি ব্যাংকে লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে।

রোববার (২১ সেপ্টেম্বর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবন মিলনায়তনে ব্যাংক খাত নিয়ে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে বক্তারা এ বিষয়ে মন্তব্য করেন। সেমিনারটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয় (ইউএপি) ও জার্মানির ওটিএইচ অ্যামবার্গ ওয়েইডেন যৌথভাবে আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। সেখানে ব্যাংকার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং সংশ্লিষ্ট খাতের অন্যান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। মূল প্রবন্ধের খসড়া গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিন মাহমুদ ওসমান ইমাম। বক্তৃতা দেন পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী, সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন এবং ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহেল আর কে হোসেন প্রমুখ।

সেমিনারে বক্তারা বলেন, এস আলম একাই পুরো ব্যাংক খাতকে ধ্বংস করেছেন এবং তার সহযোগীরাও অবদান রেখেছেন। ফলে খাতটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে আরও অনেক সময় লাগবে। ব্যাংক খাতে যে সংস্কারের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা ইতিবাচক হলেও রাজনৈতিক সরকার এসে সেই সংস্কার বজায় রাখতে পারেনি। একইভাবে সম্পন্ন সংস্কারের ধারাবাহিকতাও বজায় থাকে না, যার ফলে ব্যাংক খাত আবার আগের অবস্থায় বা আরও অবনতিতে ফিরে যায়। বক্তারা আরও উল্লেখ করেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আওয়ামী লীগ সরকার একটি শক্তিশালী ব্যাংক খাত পেয়েছিল, কিন্তু তারা এর সুফল ধরে রাখতে পারেনি এবং সংস্কারগুলো পূর্বাবস্থায় নিয়ে গেছে। এর ফলে ব্যাংক খাতে ব্যাপক লুটপাট হয়েছে, যা খাতকে ধ্বংসের পথে নিয়ে গেছে। সেমিনারে আরও বলা হয়, লুটপাটের টাকা বেশির ভাগই পাচার হয়ে গেছে এবং আদায়ের সম্ভাবনা নেই, ফলে ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট বেড়েছে এবং এই সংকট দীর্ঘ সময় চলতে থাকবে।

সেমিনারে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশের প্রবৃদ্ধির জন্য বিদেশি বিনিয়োগ অপরিহার্য, বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে। তবে দুর্বল অবকাঠামোর কারণে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ কম আসছে। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়লে প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পাবে এবং কর্মসংস্থানও বাড়বে। সংস্কারের বিষয়ে তিনি বলেন, ব্যাংক খাতে ইতিমধ্যেই সংস্কার চলছে এবং এটি অব্যাহত রাখার দায়িত্ব নতুন সরকারের। তিনি উল্লেখ করেন, বিগত সরকারের সময়ে ব্যাংক খাতে যে লুটপাট হয়েছে তা নজিরবিহীন এবং খাতটিকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো চ্যালেঞ্জিং কাজ।

সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন বলেন, একজন মাত্র ব্যক্তি একটি ব্যাংক ধ্বংস করতে পারে, ঠিক তেমনি কয়েকজন সৎ পরিচালকও ব্যাংকের সফলতার জন্য যথেষ্ট। দেশের ব্যাংক খাতে মোট ঋণের পরিমাণ ১৮ লাখ কোটি টাকা, যার মধ্যে প্রায় ১১ লাখ কোটি টাকা সমস্যাগ্রস্ত। এসব ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত জামানত নেই। বাংলাদেশে বর্তমানে ৬০টি ব্যাংক রয়েছে, যার মধ্যে ৫০টি স্থানীয় ব্যাংক। এসব স্থানীয় ব্যাংকের কমবেশি ৪০টি মানসম্মত নয়। এর মধ্যে প্রায় ১৫টি ব্যাংককে ‘জম্বি ব্যাংক’ বা অতিমাত্রায় দুর্বল বলা হচ্ছে, এবং এসব ব্যাংকের অর্ধেকেই সরাসরি লুটপাট হয়েছে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!