বৈষম্যের বিরুদ্ধে সৃষ্ট নতুন বাংলাদেশ বিনির্মানে গঠিত বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে সব বিভাগের সমস্যা ও সম্ভাবনার প্রতিফলন ঘটেছে। রাজস্ব খাতে চাকরিতদের রেশন, ঝুঁকি ভাতা, আবাসন, যানবাহন ইত্যাদি সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির মাধ্যমে স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা নিশ্চিতের প্রস্তাব উঠে এসেছে। অথচ অবহেলিত খোদ রাজস্ব বিভাগের নন-ক্যাডাররা! জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সংস্কার কমিশন গঠনের পর রাজস্ব বিভাগের সবাই আশাবাদী ছিলেন। এবার হয়তো সংসারের উপার্জনকারীদের কপালে কিছু জুটবে। অথচ এবারও বিধিবাম।
আয়কর অনুবিভাগে মাঠ পর্যায়ের ইন্সপেক্টর (পরিদর্শক) ও অতিরিক্ত সহকারী কর কমিশনার এবং কাস্টমস ও ভ্যাট অনুবিভাগে মাঠ পর্যায়ে সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা (পূর্ব নাম ইন্সপেক্টর) ও রাজস্ব কর্মকর্তা (পূর্ব নাম সুপারিনটেনডেন্ট) এর মোট সংখ্যা ছয় হাজারের বেশি। নন-ক্যাডার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তারা এই সংস্কার কার্যক্রমের সবচেয়ে বড় স্টেকহোল্ডার হওয়া স্বত্ত্বেও তাদের সাথে কোন সভা বা আলোচনা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সংস্কারে পরামর্শক কমিটি। রাজস্ব হলো রাষ্ট্রের অক্সিজেন। রাষ্ট্রের আয়ের কিয়দংশ ছাড়া প্রায় পুরোটার যোগানদাতা এনবিআর। অথচ শুধু আয় করেই খালাস। ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা দেয়ার সময় তাদের নাম কারোরই মনে থাকে না।
মাঠ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অধীনে আয়কর, কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট বিভাগের নন-ক্যাডার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তারাই মূলত মাঠে সরাসরি রাজস্ব আহরণে দিনরাত পরিশ্রম করেন। সব পর্যায়ের আলোচনায় তাই তাদেরকে বেসিক অফিসারও সম্বোধন করা হয়। চারিদিকে নেই আর নেই। লজিস্টিক সাপোর্ট বলতে কিছুই নেই। তথাপিও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায়ে তারা বদ্ধপরিকর এবং নিরলস প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। যে বিভাগে সরকারের ব্যয় বলতে কিছুই নেই; যা ব্যয় তাই ইনভেস্টমেন্ট। এক টাকা ইনভেস্ট করলে শতগুণে ফেরত পাবে। বাত্তির নিচে অন্ধকারের মতো সেখানেই কারো নজর পড়ে না। গঠিত সংস্কার কমিশন শুধু ক্যাডার কর্মকর্তাদের সাথে যা আলোচনা করেছেন, তারই ভিত্তিতেই এনবিআর দুইভাগের প্রস্তাব চূড়ান্ত হওয়ার পথে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া খসড়া অধ্যাদেশে আলোচনা ও গৃহীত মতামতের সাথে প্রস্তাবের বিরাট ফারাক। অন্য সব সংস্কার কমিশন সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের মতামতের ভিত্তিতে রিপোর্ট প্রণয়ন এবং প্রকাশ করলেও একমাত্র ব্যতিক্রম মনে হয় রাজস্ব বোর্ড সংস্কার কমিশন।
অপরদিকে, রাজস্ব আদায়ের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড নন-ক্যাডার কর্মকর্তারা হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করে জানিয়েছেন, এনবিআর সংস্কার ও এনবিআরকে দুই ভাগ করাকে আমরা সাধুবাদ জানাই। নীতি ও বাস্তবায়ন পৃথক করা এবং সংস্কারের ফলে মাঠ পর্যায়ে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। নতুন কর সংস্কৃতি গড়ে উঠবে। রাজস্ব আদায়ে গতিশীলতা আসবে। তবে এনবিআর পৃথক ও সংস্কারের ক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ের কোন কর্মকর্তার মতামত না নেয়ায় তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
কর্মকর্তারা বলছেন, এনবিআর সংস্কার যেভাবেই হোক না কেন বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকবেন মাঠ পর্যায়ের এসব কর্মকর্তা। ফলে সংস্কার এবং এনবিআর পৃথক করা হলে তা কিভাবে বাস্তবায়ন হবে বা বাস্তবায়নে কি ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে-সেগুলো নিরসন করে কিভাবে টেকসই বাস্তবায়ন সম্ভব-তা হাজার হাজার কর্মকর্তার মতামতের ভিত্তিতেই উঠে আসতো। এছাড়া এনবিআর পৃথক হলে মাঠ পর্যায়ে কি ধরনের প্রভাব পড়বে, এখন থেকে কি ধরনের প্রস্তুতি নিতে হবে, রাজস্ব ঝুঁকি কোথায়, মাঠ পর্যায়ে কি ধরনের প্রযুক্তি ও অন্যান্য সহায়তা প্রয়োজন-তা আলোচনা করা উচিত ছিলো বলে মনে করেন কর্মকর্তারা। এর ফলে একদিকে রাজস্ব আদায়ে মাঠ পর্যায়ের সমস্যা চিহ্নিত হতো, অন্যদিকে সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নে কর্মকর্তাদের মাঠে ঝুঁকি কমে আসতো। যা রাজস্ব আদায়ে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতো। এহেন কার্যক্রম নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের সাথে চরম বৈষম্যমূলক আচরণ, যা জুলাই বিপ্লবের চেতনার সাথেও সাংঘর্ষিক।
তারা আরো বলছেন, সকল আইন-বিধি যুগোপযোগীকরণ, রেশন, ঝুঁকিভাতা, আবাসন, যানবাহন, বদলি নীতিমালা, প্রশিক্ষণ, উচ্চশিক্ষা, ক্যারিয়ার প্ল্যানিংসহ স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণে কোন কিছুই আলোচনায় না করে শুধু এনবিআর দু’ভাগ করাটা কতটুকু ফলপ্রসু হবে তা সময়ই বলে দিবে। সময় শেষ হয়ে যায়নি। তাই নন-ক্যাডার কর্মকর্তারা মনে করেন সব পর্যায়ের সাথে আলোচনার মাধ্যমে মতামতের ভিত্তিতেই কেবল টেকসই সংস্কার সম্ভব। কিছু অংশের সাথে আলোচনা না করে বা কিছু অংশের মতামত উপেক্ষা করে সর্বোপরি সবাইকে পাশ কাটিয়ে তড়িঘড়ি করে করা সংস্কার কার স্বার্থে এই প্রশ্ন রয়েই যায়। এটাও সরকারকে বেকায়দায় ফেলার ষড়যন্ত্র কিনা-সেটিও খতিয়ে দেখা জরুরি।
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। এই সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা ধরনের সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। তার অংশ হিসেবে এবার এনবিআর সংস্কারে পরামর্শক কমিটি গঠন করা হয়েছে। পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট এই পরামর্শক কমিটির সবাই এনবিআরের সাবেক কর্মকর্তা। সদস্যদের মধ্যে দুজন এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান। তারা হলেন-মো. আব্দুল মজিদ ও নাসিরউদ্দিন আহমেদ। কমিটির অন্য সদস্যরা এনবিআরের সাবেক সদস্য। তারা হলেন-মো. দেলোয়ার হোসেন (কর), ফরিদ উদ্দিন (শুল্ক) ও আমিনুর রহমান (কর)।