** ৩,২৯,৯১৯ মেট্রিক টন র’সুগারের বন্ডিং মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়, অবৈধভাবে অপসারণ করে ৬১২ কোটি টাকা শুল্ককর ফাঁকি দিয়েছে
** ১,৯৪,৯৩০ মেট্রিক টন র’সুগার অবৈধভাবে অপসারণ করে শুল্ককর ফাঁকি দিয়েছে প্রায় ৪৮২ কোটি টাকা
** একটি মামলায় ২০২৩ সালের ৫ মার্চ ও অপর মামলায় ৬ আগস্ট বিচারাদেশ দেয় ঢাকা দক্ষিণ কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট
** আব্দুল মোনেম গ্রুপের সব প্রতিষ্ঠানের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম স্থগিত রাখতে কাস্টম হাউস-শুল্ক স্টেশনকে চিঠি দিয়েছে বন্ড কমিশনারেট
বিশেষ প্রতিনিধি: বন্ড সুবিধার প্রায় তিন লাখ মেট্রিক টনের বেশি র’সুগারের বন্ডিং মেয়াদ শেষ হয়েছে। কিন্তু সেই র’সুগার বা কাঁচামাল শুল্ককর পরিশোধ ছাড়াই অবৈধভাবে অপসারণ করা হয়েছে। এতে প্রায় ৬১২ কোটি টাকার শুল্ককর পরিশোধ করা হয়নি। আবার বন্ড সুবিধার দুই লাখ মেট্রিক টনের বেশি র’সুগার অবৈধভাবে অপসারণ করা হয়েছে। এতে শুল্ককর পরিশোধ করা হয়নি প্রায় ৪৮২ কোটি টাকা। দুইবার বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করা হয়েছে, যাতে শুল্ককর ফাঁকি দিয়েছে প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকা। ফাঁকি প্রমাণিত হওয়ায় প্রতিষ্ঠানকে গত এক বছর আগে বিচারাদেশে অর্থদণ্ড দেয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠান টাকা পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে কিছু টাকা পরিশোধও করেছে। বাকি টাকা কিস্তিতে পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা পরিশোধ করেনি। অবশেষে শুল্ককর ফাঁকি দেয়া টাকা আদায়ে প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে।
শুধু প্রতিষ্ঠান নয়, প্রতিষ্ঠানের তিন পরিচালকের ব্যাংক হিসাবও জব্দ করা হয়েছে। শুল্ককর ফাঁকি দেয়া প্রতিষ্ঠানটি হলো দেশের র্শীষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ আব্দুল মোনেম গ্রুপের আব্দুল মোনেম সুগার রিফাইনারী লিমিটেড। আর এই প্রতিষ্ঠানের দুই পরিচালক হলেন-আব্দুল মোনেম (মৃত) ও তার ছেলে এ এস এম মহিউদ্দিন মোনেম। এ এস এম মহিউদ্দিন মোনেম আব্দুল মোনেম গ্রুপের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এছাড়া ফাঁকি দেয়া শুল্ককর পরিশোধ না করায় আব্দুল মোনেম গ্রুপের সব প্রতিষ্ঠানের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট, ঢাকা (দক্ষিণ) ব্যাংক হিসাব জব্দ ও আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম স্থগিত করেছে। ব্যাংক হিসাব জব্দ করতে ৫৭টি ব্যাংক ও আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম স্থগিত করতে সব কাস্টম হাউস ও শুল্ক স্টেশনে পৃথক চিঠি দেয়া হয়েছে। এনবিআর সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
সূত্রমতে, আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম স্থগিত করতে উপ কমিশনার দ্বৈপায়ন চাকমা সই করা চিঠি দেয়া হয়। কাস্টম হাউস ও শুল্ক স্টেশনকে দেয়া চিঠিতে দেশের সব সমুদ্র, স্থল ও বিমানবন্দরকে প্রতিষ্ঠানটির মালিকানাধীন সব প্রতিষ্ঠানের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ করার পাশাপাশি সব বিজনেস আইডেনটিফিকেশন নম্বর বা বিআইএন স্থগিত রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিআইএন স্থগিত রাখার অর্থ হচ্ছে—প্রতিষ্ঠানটির আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়া। বন্দরে যেসব পণ্য ইতোমধ্যে আমদানি হয়েছে, তার শুল্কায়ন কার্যক্রমও বন্ধ থাকবে।একইভাবে গ্রুপটির প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি এর মালিকানাধীন ও ব্যবস্থাপনাধীন সব প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করার অর্থ—প্রতিষ্ঠানটি এসব অ্যাকাউন্ট থেকে কোনো অর্থ উত্তোলন বা লেনদেন করতে পারবে না।
চিঠিতে বলা হয়, শুল্ক পরিশোধ না করে ৫ লাখ ২৫ হাজার টন অপরিশোধিত চিনি কারখানা থেকে অবৈধভাবে অপসারণ করে ১ হাজার ২০৫ কোটি ৫২ লাখ টাকার কর ফাঁকি দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। ছয় কিস্তিতে এসব অর্থ পরিশোধের নির্দেশনা দেওয়া হলে প্রতিষ্ঠানটি ৫৩৩ কোটি টাকা পরিশোধ করে এবং বাকি ৬৭৪ কোটি ৩৫ লাখ টাকা এখন পর্যন্ত জমা দেয়নি। দেশের ১৯টি শুল্ক স্টেশনসহ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে নির্দেশনা দিয়ে আদেশপত্রে বলা হয়, কাস্টমস অ্যাক্ট ১৯৬৯ এর সেকশন ২০২ (১,বি) অনুযায়ী সরকারি পাওনা আদায় না হওয়া পর্যন্ত ওই প্রতিষ্ঠান অথবা তার সহযোগী প্রতিষ্ঠান অথবা একই মালিকানাধীন বা ব্যবস্থাপনাধীন প্রতিষ্ঠানের মালামাল খালাস স্থগিত থাকবে। পাশাপাশি বন্ড সুবিধায় আনা সুগার রিফাইনারি থাকা সব ধরনের অপরিশোধিত চিনি বাজারজাতকরণ ও সরবরাহ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট বন্ড কর্মকর্তাদের।
অপরদিকে, ব্যাংক হিসাব জব্দ করতে ৫৭টি ব্যাংকে চিঠি দেন উপকমিশনার জোবায়দা নাহার। চিঠিতে বলা হয়েছে, আব্দুল মোনেম সুগার রিফাইনারী লিমিটেডের ৩ লাখ ২৯ হাজার ৯১৯ মেট্রিক টন র’সুগারের বন্ডিং মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়। প্রতিষ্ঠানটি শুল্ককর পরিশোধ ছাড়াই এই সুগার ব্যবহার করেছে। বন্ড সুবিধার অপব্যবহার প্রমাণিত হওয়ায় ২০২৩ সালের ৫ মার্চ প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে বিচারাদেশে অর্থদণ্ড দেয়া হয়। অর্থদণ্ডসহ এই র’সুগারের শুল্ককর দাঁড়ায় ৬১২ কোটি ২৩ লাখ ১৭ হাজার ৪৪৪ টাকা। আবার প্রতিষ্ঠানটি শুল্ককর পরিশোধ ছাড়াই ১ লাখ ৯৪ হাজার ৮৩০ মেট্রিক টন চিনি অবৈধভাবে অপসারণ করেছে। বন্ড সুবিধার অপব্যবহার প্রমাণিত হওয়ায় প্রতিষ্ঠানকে ২০২৩ সালের ৬ আগস্ট বিচারাদেশে অর্থদণ্ড দেয়া হয়। অর্থদণ্ডসহ র’সুগারের শুল্ককর দাঁড়ায় ৪৮২ কোটি ৪৬ লাখ ৪২ হাজার ৮৯৮ টাকা। দুইটি বিচারাদেশে অর্থদণ্ড ও শুল্ককর দাঁড়ায় প্রায় ১ হাজার ৯৪ কোটি টাকা। তবে সুদসহ এক হাজার ২০৫ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এই টাকা পরিশোধে প্রতিষ্ঠানকে ছয়টি কিস্তি সুবিধা দেয়া হয়। প্রতিষ্ঠান ৫৩৩ কোটি ১৭ লাখ টাকা পরিশোধ করে। বাকি ৬৭৪ কোটি ৩৫ লাখ টাকা পরিশোধ করেনি। এ কারণে প্রতিষ্ঠানটির ব্যাংক হিসাব জব্দ ও আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
***