আদানিকে শুল্ককর ফাঁকিতে সহায়তা, তদন্তে দুদক

বিদ্যুৎ আমদানির জন্য ভারতের আদানি গ্রুপের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের চুক্তিতে শুল্ক ও কর অব্যাহতির মাধ্যমে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) পাশ কাটিয়ে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ খতিয়ে দেখতে তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

এ চুক্তির জন্য সাবেক মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস (চুক্তির সময় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সচিব ছিলেন) ও তার নেতৃত্বাধীন কর্তৃপক্ষ ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের বিরুদ্ধেও তদন্ত করতে দুদকের উপপরিচালক রেজাউল করিমকে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর আগে তদন্তে নেমে আদানির বিদ্যুৎ আমদানিতে প্রায় ৪০ কোটি ডলারের শুল্ক ‘ফাঁকির’ প্রমাণ পায় এনবিআর; বহুল আলোচিত এ চুক্তির সময় সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে পাশ কাটিয়ে শুল্ক ও কর অব্যাহতি দেওয়ার তথ্যও উঠে এসেছে সংস্থাটির তদন্তে।

এনবিআর চেয়ারম্যান বরাবর চিঠি পাঠিয়ে কর আদায়ের এ সংস্থার প্রতিবেদনসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য দলিল চেয়ে চিঠি দিয়েছে দুদক।এর সত্যতা নিশ্চিত করে দায়িত্বপ্রাপ্ত অনুসন্ধান কর্মকর্তা রেজাউল করিম বলেন, আমরা সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে তথ্য ও ফাইল চেয়েছি। তা খতিয়ে দেখে প্রতিবেদন জমা দেব।এজন্য কোনো সময় বেঁধে দেওয়া হয়নি বলেও জানান তিনি।

এনবিআরের কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের দল তদন্তে নেমে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিদ্যুৎ প্রবেশ ও সঞ্চালনের সময় আমদানির যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণের অংশ হিসেবে কোনো বিল অব এন্ট্রি দাখিলের প্রমাণ পায়নি। এছাড়া তা আইনি পন্থায় নিষ্পত্তি না করার প্রমাণও পায়।এর প্রেক্ষাপটে কর ‘ফাঁকির’ বিপুল এ অর্থ পিডিবির কাছ থেকে আদায়ের সুপারিশ করে এনবিআরের কমিটি।

এবারের তদন্তে সেই প্রতিবেদন, বিদ্যুৎ আমদানির ক্ষেত্রে প্রতি ইউনিটের নির্ধারিত মূল্য ও তা শুল্ক কর আদায়যোগ্য কি না, প্রযোজ্য হলে শুল্ক-কর পরিশোধ করা হয়েছে কি না এবং শুদ্ধ কর ছাড়ের বিষয়ে এনবিআর অনুমতি দিয়েছিল কি না, দেওয়া হয়ে থাকলে এ সংক্রান্ত যাবতীয় রেকর্ডপত্র বা তথ্যাদি এবং আদানি গ্রুপের সাথে পিডিবির চুক্তি খতিয়ে দেখার জন্য শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর কর্তৃক ৯ সদস্যের কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনের ফটোকপি চাওয়া হয়েছে চিঠির মাধ্যমে।

আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনার আলোচিত এ চুক্তিতে শুল্ক সংক্রান্ত বিষয়গুলো কীভাবে সম্পাদন করা হয়েছে, তাতে কোনো ত্রুটি ছিল কি না, শুল্ক পরিহার বা প্রত্যাহারের বিষয় রয়েছে কি না; এমন আরও কিছু প্রশ্ন সামনে রেখে তদন্তে নেমেছিল এনবিআরের আট কর্মকর্তার তদন্ত দল।

তাদের প্রতিবেদনে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই পর্যন্ত ভারতের আদানি গ্রুপের কাছ থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের বিপরীতে ৩৯ কোটি ৭৩ লাখ ৭১ হাজার ৪৬৭ ডলারের শুল্ক-কর ‘ফাঁকি দেওয়া হয়েছে বলে তথ্য উঠে আছে।২০২৩ সালের ৯ মার্চ ঝাড়খণ্ডের গড্ডায় স্থাপিত আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ আমদানি শুরু করে বাংলাদেশ। তখন থেকেই আমদানি করা এ বিদ্যুতের শুল্কসহ অন্যান্য কর পরিশোধ করা হয়নি।

এনবিআরের দল তদন্তে দেখতে পেয়েছে, ২৫ বছর মেয়াদি চুক্তির আওতায় আদানির কাছ থেকে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) বিদ্যুৎ কেনার ক্ষেত্রে শুল্ক ও অব্যাহতি দিয়েছে। তবে এ বিষয়ে এনবিআরসহ যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেয়নি। প্রবল আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নেওয়া বিদ্যুৎ খাতের বিভিন্ন চুক্তি নিয়ে সমালোচনা বাড়তে থাকার মধ্যে আদানির বিদ্যুৎ নিয়েও ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে।

অন্তর্বর্তী সরকার গত ৫ সেপ্টেম্বর বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ এর অধীন সম্পাদিত চুক্তিগুলো পর্যালোচনায় একটি জাতীয় কমিটিও গঠন করেছে। ভারতের আদানি পাওয়ারসহ বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে বিদ্যুৎ সরবরাহ সংক্রান্ত ১১টি চুক্তি খতিয়ে দেখবে বলে ৩ অক্টোবর জানায় এ কমিটি।এর মধ্যে আদানি পাওয়ারের ১৬০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন গড্ডা পাওয়ার প্লান্টও রয়েছে।

কী পেয়েছিল এনবিআরের তদন্ত কমিটি?

চুক্তির আওতায় গেল বছরের জুলাই পর্যন্ত আদানির কেন্দ্র থেকে ১০৫৮ কোটি ৮৯ লাখ ৯০ হাজার ৮৪ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করেছে বাংলাদেশ; যার মূল্য ১২৮ কোটি ১৮ লাখ ৪৩ হাজার ৪৪২ ডলার। এর বিপরীতে ৩১ শতাংশ আমদানি শুল্ক ও বিভিন্ন কর মিলে ৩৯ কোটি ৭৩ লাখ ৭১ হাজার ৪৬৭ ডলারের শুল্ক-কর পাওয়ার কথা এনবিআরের। চুক্তিতে শুল্ক অব্যাহতি দেওয়া হলেও সেটির অনুমোদন নেওয়া হয়নি এনবিআর থেকে। শুল্ক গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভাষায় এটি ‘ফাঁকি’।

আমদানি করা বিদ্যুতের শুল্ক-কর মওকুফ সংক্রান্ত কোনো চুক্তি ছিল কি না এবং থাকলে এ বিষয়ে কোনো প্রজ্ঞাপন বা আদেশ জারি হয়েছে কি না জানতে চাইলে শুল্ক গোয়েন্দাকে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড লিখিত জবাব দেয়। সেখানে বলা হয়, আদানি পাওয়ার (ঝাড়খণ্ড) লিমিটেড ও বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে বাস্তবায়ন চুক্তি অনুযায়ী বিদ্যুৎ বিভাগ ২০২২ সালের ১৪ অগাস্ট তৎকালীন এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে আদানির বিদ্যুতের ওপর থেকে প্রযোজ্য যাবতীয় শুল্ক ও কর মওকুফের আবেদন করে। এক্ষেত্রে এর আগে ভারতীয় বিদ্যুৎ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান এনটিপিসি বিদ্যুৎ নিগম লিমিটেডকে দেওয়া অব্যাহতির কথা তুলে ধরা হয়।তবে এনবিআরের শুল্ক অব্যাহতি ও প্রকল্প সুবিধা শাখা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

এনবিআরের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, পরে ২০২৩ সালের ১৩ এপ্রিল চুক্তিতে থাকা শুল্ক-কর অব্যাহতির বিষয়ে চুক্তি সম্পাদনের আগে এনবিআরের কোনো মতামত নেওয়া হয়েছে কি না জানতে চেয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিবকে চিঠি দেওয়া হলেও তিনি জবাব দেননি।অভিযোগের বিষয়ে সাবেক মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউসের বক্তব্য জানার চেষ্টা করা হয়েছে।

**ভারত থেকে শুল্ককর ছাড়াই আসছে আদানির বিদ্যুৎ!
**শুল্ককর দেয়নি আদানি: অনিয়ম অনুসন্ধানে কমিটি
**আদানির বিদ্যুতে শুল্ক-কর ফাঁকি ৪৬৮৮ কোটি টাকা
**দেশে পুরো বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাবে আদানি পাওয়ার
**বিদ্যুৎ চুক্তিতে অনিশ্চিত, কঠোর অবস্থানে আদানি!
**আদানির কেন্দ্র থেকে বন্ধ বিদ্যুৎ সরবরাহ
**আদানির কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!