আড়াই লাখ গ্রাহকের ১৬০০ কোটি টাকা আটকে

রংপুরের মাহিগঞ্জ পূর্ব খাসবাগ এলাকার মো. আলম মিয়া একজন ক্ষুদ্র মুদিদোকানি। তার আয়ে কোনোমতে সংসার চললেও সঞ্চয়ের সুযোগ ছিল না। ভবিষ্যতের নিশ্চয়তার আশায় তিনি ১৫ বছর আগে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্সে ১২ বছরের মেয়াদি একটি বিমা করেন। কিন্তু বিমার মেয়াদ শেষ হয়েছে তিন বছর আগে, আজও টাকা পাননি তিনি। ৫৩ বছর বয়সী আলম এখন সেই টাকা তুলতে রংপুর থেকে ঢাকার পথ ধরছেন বারবার। আলম মিয়া একা নন—রংপুর বিভাগের প্রায় ৩০ হাজার গ্রাহক একই সমস্যায় ভুগছেন। তাঁদের দাবি অনুযায়ী, ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্সের কাছে তাঁদের আটকে আছে প্রায় ১২১ কোটি টাকা। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে এই টাকার জন্য দৌড়ঝাঁপ করছেন তাঁরা। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, শুধু রংপুর নয়, সারাদেশে প্রতিষ্ঠানটির দুই লাখ ৪৩ হাজার গ্রাহকের মোট ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার বিমা পরিশোধ বাকি রয়েছে।

ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্সের রংপুর বিভাগীয় অফিসের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আব্দুল কাদের বীর জানান, গ্রাহকদের টাকা পরিশোধে বিমা কোম্পানিটির দেশের বিভিন্ন জায়গায় থাকা সম্পত্তি বিক্রির জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হলেও তা কেউ কিনতে সাড়া দেননি। তাই গ্রাহকদের টাকা পরিশোধ করা যাচ্ছে না। শুধু রংপুর নয়, সারা দেশে ২ লাখ ৪৩ হাজার গ্রাহকের ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা পাওনা আছে।

কোম্পানির ভারপ্রাপ্ত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শহিদুল ইসলাম বলেন, গত ১২ বছর ধরে কোম্পানিটি দুর্নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ফলে গ্রাহকদের বিমা দাবি পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। আমি সম্প্রতি দায়িত্ব নিয়েছি এবং দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই ২০০ কোটি টাকা পরিশোধ করেছি। গ্রাহকদের দাবির টাকা পরিশোধে একটি সুপরিকল্পিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে, যা ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করা হবে।

বিমা কোম্পানিটির রংপুর বিভাগীয় কার্যালয় সূত্র বলেছে, এই বিভাগে দুই লাখের বেশি গ্রাহক রয়েছে তাদের। ২০২১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত রংপুরের ৮ জেলার ২৯ হাজার ৫৯৬ জন গ্রাহকের বিমার মেয়াদ শেষ হয়েছে। বিমার বিপরীতে তাঁরা ১২০ কোটি ৯৭ লাখ ১১ হাজার ৪১৩ টাকা পাবেন। বিমা খাতের নিয়ম অনুযায়ী ৯০ দিনের মধ্যে গ্রাহকদের বিমার দাবি করা টাকা পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ নানা অজুহাতে গ্রাহকদের ঘোরাচ্ছে।

গ্রাহকদের অভিযোগ, তাঁরা বারবার কোম্পানির প্রধান কার্যালয়সহ বিভিন্ন শাখায় যোগাযোগ করেও শুধুমাত্র আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতি পাচ্ছেন, কিন্তু অর্থ হাতে পাচ্ছেন না। অনেকে দীর্ঘ প্রতীক্ষায় হতাশ হয়ে এখন আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলেও জানা গেছে।

গঙ্গাচড়া উপজেলার রাশেদা বেগমের ১২ বছর মেয়াদি বিমার মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২২ সালে। কিন্তু তিন বছর পেরিয়ে গেলেও তিনি এখনো টাকা পাননি। সোমবার ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বিভাগের কার্যালয়ে টাকা খোঁজে গেলে কর্মকর্তারা ঢাকায় যোগাযোগের পরামর্শ দিয়ে একটি সুপারিশপত্র ধরিয়ে দেন। রাশেদার ছেলে রাশেদুজ্জামান বলেন, মা অনেক কষ্ট করে এই টাকা জমিয়েছিলেন, যাতে পরে কিছু করতে পারেন। কিন্তু তিন বছর ধরে শুধু আশ্বাসই দিচ্ছে, টাকা দিচ্ছে না। কিছুদিন আগে জমি বিক্রি করে টাকা দেওয়ার প্রস্তাবও দিয়েছিল, এখন আবার ঢাকায় যেতে বলছে। আমরা বুঝতে পারছি না কী করব।

ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্সের রংপুর বিভাগীয় অফিসের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আব্দুল কাদের বীর বলেন, ব্যাংকে থাকা ডিপোজিট ও এফডিআর বন্ধক রেখে ঋণ নেওয়া হলেও তা পরিশোধ করা হয়নি। আগের মালিকেরা জমি কেনাবেচাসহ নানা ধরনের দুর্নীতিতে জড়িয়েছিলেন, যার ফল ভোগ করছেন এখন গ্রাহকেরা। গ্রাহকদের চাপ বাড়তে থাকায় আমরা ঢাকায় যোগাযোগ করেছি। মালিকপক্ষ জানিয়েছে, তারা প্রতিষ্ঠান পেয়েছেন, কিন্তু তহবিল পাননি। তবে কেউই অর্থ হারাবেন না, ধৈর্য ধরতে হবে—পুরো প্রক্রিয়ায় সময় লাগবে প্রায় দুই বছর।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!