** শো-রুমে পণ্য বিক্রি, কুরিয়ার ও পিকআপে পণ্য বিক্রির উপর ভ্যাট দেয়নি ১৩.৮৭ কোটি টাকা
** অ্যাপল গ্যাজেট আড়াই বছরে বিভিন্ন সেবা গ্রহণ বা ক্রয়ের উপর ভ্যাট দেয়নি ২৪.৬৪ কোটি টাকা
অনলাইন ও শো-রুম-দুইভাবেই বিক্রি হচ্ছে আইফোন, ম্যাকবুক। বিক্রি হচ্ছে ব্র্যান্ডের সব মোবাইল ফোন। শুধু ফোন নয়, বিক্রি হচ্ছে ফোনের সামগ্রী, ডিজিটাল সব ডিভাইস। প্রতিমাসে প্রায় কোটি টাকা বিক্রিও করেন। কিন্তু কখনো রিটার্ন (দাখিলপত্র) দেয় না। দেয় না মোবাইল, মোবাইল এক্সেসরিজ, কম্পিউটার ও অন্যান্য ডিজিটাল ডিভাইস সামগ্রীর উপর ভ্যাট। প্রতিষ্ঠানটি পাঁচ খাতে ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটিত হয়েছে প্রায় ৪৬ কোটি ৮৮ টাকা বা ৪৭ কোটি টাকা, যা সুদসহ প্রায় শত কোটি টাকা ছুঁইবে। বিপুল পরিমাণ এই ভ্যাট ফাঁকি দেয়া প্রতিষ্ঠানটি হলো অ্যাপল গেজেট লিমিটেড। ভ্যাট ফাঁকির মামলার পর প্রতিষ্ঠানকে ইতোমধ্যে কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করা হয়েছে। ভ্যাট কর্মকর্তারা বলছেন, কোটি কোটি টাকা বিক্রির পরও প্রযোজ্য ভ্যাট দেয় না। বিক্রি গোপন করতে মাসিক দাখিলপত্রও দেয় না। প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তবে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ ভ্যাট ফাঁকি, মামলা ও অভিযানের বিষয়টি অস্বীকার করেছে।
এনবিআর সূত্রমতে, অ্যাপল গেজেট লিমিটেড মোবাইল ফোন, কম্পিউটার ও অন্যান্য সামগ্রীর বিক্রির উপর ভ্যাট পরিশোধ করছে না। একইভাবে প্রতিষ্ঠানটি মাসিক দাখিলপত্র (রিটার্ন) দেয় না বলে অভিযোগ পায় এনবিআর। বিষয়টি খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নেয় মূসক নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর (ভ্যাট গোয়েন্দা)। ২০২৩ সালের ৯ আগস্ট গ্রীন রোডের জেআইআর হেরিটেড ভবনে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয় পরিদর্শন করেন ভ্যাট গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের কাছে মূসক সংক্রান্ত দলিলাদি ও দাখিলপত্র চাইলে তা দেখাতে ব্যর্থ হন তারা। পরে ভ্যাট অনলাইন সার্ভারে অ্যাপল গেজেট লিমিটেডের দাখিলপত্র সার্চ (তল্লাশি) করেও কোনো দাখিলপত্র পাননি ভ্যাট কর্মকর্তারা। ভ্যাট কর্মকর্তারা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সহায়তায় কম্পিউটার হতে প্রতিষ্ঠানের ক্রয়, বিক্রয় এর তথ্য নেয়া হয়। এছাড়া ‘হ্যান্ড ক্যারি’ নামে একটি ফাইল থেকে প্রতিষ্ঠানের দুবাই থেকে আমদানি করা মোবাইল ও কম্পিউটার ডিভাইস এর আমদানির তথ্য নেয়া হয়। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের কম্পিউটারে গুগল ড্রাইভ থেকে প্রতিমাসের বিক্রির তথ্য নেয়া হয়, যাতে প্রতিষ্ঠানে সব ব্রাঞ্চভিত্তিক বিক্রয় তথ্য ছিলো। এসব কাগজপত্র পর্যালোচনা করে বিপুল পরিমাণ ভ্যাট ফাঁকি পায় ভ্যাট গোয়েন্দা। পরে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ভ্যাট ফাঁকির প্রতিবেদন পাঠানো হয় ভ্যাট ঢাকা পশ্চিম কমিশনারেটে। কমিশনারেট সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানকে দাবিনামা সম্বলিত কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের শুরু থেকে মোবাইলের উপর অব্যাহতি সুবিধা সরকার বাতিল করেছে। সে অনুযায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরের আগে প্রতিষ্ঠানের সকল শাখার হিসেব এক সঙ্গে পর্যালোচনা করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের মে পর্যন্ত অর্থাৎ এক বছর চার মাসে মোবাইল ফোন, কম্পিউটার ও অন্যান্য ভ্যাটযোগ্য পণ্য বিক্রি করেছে ১৬৬ কোটি ৭ লাখ ৮৮ হাজার ৯৬১ টাকা। যাতে প্রযোজ্য ভ্যাট ৭ কোটি ৯০ লাখ ৮৫ হাজার ১৮৯ টাকা।
প্রতিবেদনে মোবাইল ও কম্পিউটার সামগ্রীর উপর ভ্যাট বিষয়ে বলা হয়েছে, ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত মোবাইল ও কম্পিউটার সরবরাহের উপর শর্ত সাপেক্ষে ভ্যাট অব্যাহতি দিয়েছে এনবিআর। শর্ত পরিপালন করলেই কেবল অব্যাহতি সুবিধা পাওয়া যাবে। শর্তের মধ্যে রয়েছে, প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত দাখিলপত্র বা ভ্যাট রিটার্ন দাখিল, মূসক চালান ইস্যু করা, মূসক সংক্রান্ত হিসাব পুস্তক সংরক্ষণ করা। তবে প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের সময় প্রতিষ্ঠান কোনো দাখিলপত্র দেখাতে পারেনি। ভ্যাট অনলাইন সিস্টেমেও প্রতিষ্ঠানের রিটার্ন দাখিলের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এছাড়া প্রতিষ্ঠান কোনো মূসক চালান ইস্যু করে না। শর্ত পরিপালন না করায় প্রতিষ্ঠানকে মোবাইল ও কম্পিউটার সামগ্রী বিক্রির উপর ভ্যাট দিতে হবে।
প্রতিবেদনে উৎসে মূসক বিষয়ে বলা হয়েছে, লিমিটেড প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন সেবা গ্রহণ বা পণ্য ক্রয়ের বিপরীতে উৎসে মূসক কর্তন করে সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হবে বলে এনবিআরের আদেশ রয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠান কোনো উৎসে মূসক কর্তন করেনি। অ্যাপল গ্যাজেট ২০২০-২১ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত ২৫৯ কোটি ৬৯ লাখ ১৩ হাজার ৬৫৩ টাকার পণ্য ক্রয় করেছে। এর উপর মূসক কর্তন করা হয়নি ২৪ কোটি ৬৩ লাখ ৭৮ হাজার ৩৭৫ টাকা। অপরদিকে, প্রতিষ্ঠানটি ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত পাঁচটি খাতে মোট ৪৬ কোটি ৮৮ লাখ ৩৯ হাজার ৯৭৮ টাকা (সুদ ছাড়া) ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটিত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মোবাইল ও কম্পিউটার বিক্রয়, অন্যান্য পণ্য বিক্রয়, শো-রুমের মাধ্যমে পণ্য বিক্রয়, কুরিয়ার ও পিকআপ এর মাধ্যমে পণ্য বিক্রয় ও উৎসে কর্তন। তবে সুদসহ ফাঁকির পরিমাণ শত কোটি টাকার কাছাকাছি যাবে বলে মনে করেন কর্মকর্তারা। ভ্যাট গোয়েন্দা অ্যাপল গ্যাজেট লিমিটেডের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ২০২৩ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ভ্যাট ঢাকা পশ্চিম কমিশনারেটকে মামলার প্রতিবেদন দিয়েছে। সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানকে দাবিনামা সম্বলিত কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করেছে ভ্যাট কমিশনারেট।
অপরদিকে, অ্যাপল গেজেট লিমিটেডের প্রধান কার্যালয়ে ভ্যাট গোয়েন্দার অভিযান সম্পর্কে জানেন না বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শরিফুল ইসলাম। এমনকি ভ্যাট গোয়েন্দা যে মামলা করেছে, ভ্যাট পশ্চিম কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করেছে, তাও জানেন না তিনি। তিনি বলেন, মামলা হয়েছে কিনা, ভ্যাট ফাঁকি দেয়া হয়েছে কিনা আমি খোঁজ নিয়ে জানাবো। মামলার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অ্যাপল গেজেট কখনো রিটার্ন (দাখিলপত্র) দেয়নি। প্রশ্ন করা হলে তিনি তা অস্বীকার করেন। বলেন, আমাদের তো মার্কেট থেকে প্রতিমাসে ভ্যাটের লোকজন এসে সেলের উপর ভ্যাট নিয়ে যায়। রিটার্ন দেবো না কেন? বসুন্ধরা সিটিতে ভ্যাট না দিয়ে থাকা যায়? অ্যাপল গেজেট পাঁচটি খাতে প্রায় ৪৭ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছেন-এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে মোহাম্মদ শরিফুল ইসলাম বলেন, আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। আমাদের তো আলাদা আলাদা শো-রুম, আলাদা আলাদা মালিক। আমরা তো ফ্রাইঞ্চাজি। আপনাদের প্রধান কার্যালয়ে অভিযান করলো, কাগজপত্র জব্দ করলো, মামলা করলো, কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করলো-এরপরও আপনি জানেন না-প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমি কথা বলে জেনে আপনাকে জানাবো। তবে পরে ফোন দেয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
অন্যদিকে, এই বিষয়ে এনবিআরের একজন সদস্য বলেন, আইফোন ও আইফোনের সামগ্রী, কম্পিউটার, সব ব্র্যান্ডের সব ও ফোনের এক্সেসরিজ সামগ্রী, ডিজিটাল সব ডিভাইস বিক্রি করে অ্যাপল গেজেট। প্রতিষ্ঠানটি দিনে দিনে বড় হচ্ছে। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, প্রতিষ্ঠানটি ভ্যাট রিটার্ন দেয় না। ভ্যাট কর্মকর্তাদের অভিযানে দেখা গেছে, প্রতিমাসে কোটি কোটি টাকার বিক্রি রয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট দেয়ার রেকর্ড নেই। পাঁচ খাতে সুদবাদে প্রায় ৪৭ কোটি টাকার ফাঁকি উদ্ঘাটিত হয়েছে। অথচ এই প্রতিষ্ঠানের ক্রেতাদের মধ্যে সাধারণ ক্রেতার সংখ্যা কম। ভ্যাট ফাঁকির বিষয়ে ভ্যাট কমিশনারেট কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে বলেও জানান তিনি।
***