‘অসামান্য অবদান’ নামে রাজউকের প্লট লুটপাট

পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ‘অসামান্য অবদান’ নামে একটি অভিনব পন্থায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এর প্লটগুলি লুটপাট করা হয়েছে। পূর্বাচল ও ঝিলমিলসহ অন্যান্য স্থানে এই কথিত অবদানকারীদের কালো হাত বিস্তৃত হয়েছে, আর এর ফলে রাজউকের কিছু তৎকালীন কর্মকর্তা-কর্মচারীর পকেটও ফুলে উঠেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অসামান্য অবদানকারীদের মধ্যে প্লট ভাগাভাগির সুযোগ করে দিতে ভূমি বণ্টন বিধিমালায় রাজউক আশ্চর্যজনকভাবে ১৩/এ ধারা সংযোজন করে। এই ধারাতেই সংরক্ষিত কোটায় পূর্বাচল ও ঝিলমিলে ৮৩০ জনকে বিভিন্ন আয়তনের প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়।

বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, এসব প্লট ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকারের তোষামোদ ও স্তাবকতার পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, এসব পুরস্কারের নির্দেশনামা সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হতো। এরপর মন্ত্রণালয়ের চূড়ান্ত নির্দেশ পেয়ে রাজউক চেয়ারম্যানের কাছে পৌঁছাত। নির্দেশ পাওয়ার পর রাজউক কর্মকর্তারা দ্রুত বিশেষ বোর্ড মিটিং ডেকে এসব নির্দেশ বাস্তবায়ন করতেন।

অভিযোগ রয়েছে, রাজউক এর ফাঁকে তাদের পছন্দের আবেদনকারীদের মধ্যেও কিছু কিছু প্লট বরাদ্দের উপায় খুঁজে নিয়েছেন। লটারির প্রথা চালু থাকলেও আওয়ামী আমলে সেই সব প্রথা বলতে গেলে পায়ে মাড়ানো হয়েছে।আশার বিষয়, জুলাই বিপ্লবের পর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার এই বিতর্কিত ১৩/এ ধারা বাতিল করে লটারির মাধ্যমে প্লট বরাদ্দের নিয়ম চালু করেন।

অসামান্য অবদানের নামে প্লট বরাদ্দের বিষয়টি উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ করা হয়। আদালত পর্যালোচনা করে বিষয়টি সুপারিশ করার জন্য তিন সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে। তবে, গত রোববার পর্যন্ত ওই কমিটি কাজ শুরু করতে পারেনি। এদিকে, বর্তমান রাজউক প্রশাসনও স্বপ্রণোদিত হয়ে সার্বিক বিষয়টি খতিয়ে দেখছে বলে জানা গেছে।

অসামান্য অবদানে প্লট পেয়েছেন যারা:অসামান্য অবদানের নামে ১৩/এ ধারায় রাজউকের পূর্বাচল ও ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্পে ২০৬ জন প্লট পেয়েছেন। তাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা সংগ্রহ করতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। রাজউকের বিভিন্ন ফ্লোরে ছোটাছুটি করেও তালিকা পাওয়া যায়নি। তবে বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে কিছু নাম জানা গেছে। বিশেষভাবে, ঝিলমিল প্রকল্পের প্লট প্রাপ্তদের তালিকা পাওয়া গেছে। তালিকা সংগ্রহ করতে ঝিলমিল প্রকল্পের পরিচালক আমিনুর রহমান সুমনের সহায়তা নেয়া হয়, যিনি প্রতিবেদককে রাজউকের উপপরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-৪) এর কক্ষে নিয়ে যান। তিনি কক্ষে না থাকায় সহকারী পরিচালক মো. হুমায়ুনের কাছে পাঠান, যিনি ঝিলমিলের প্লট প্রাপ্ত ব্যক্তিদের সম্পর্কে কিছু ধারণা দেন।

তার তথ্যমতে, ১৩/এ ধারায় ২০৬ জনের বাইরে কমবেশি ১৭৬৪ জন প্লট পেয়েছেন। বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ঝিলমিলে প্লট পাওয়াদের মধ্যে ব্যবসায়ী শ্রেণিরই আধিক্য। তালিকা অনুযায়ী প্লট পেয়েছেন ব্যবসায়ী ৩৮ জন, সরকারি চাকরিজীবী ৩১ জন, সাবেক এমপি ১৩ জন, আইনজীবী ১২ জন ও সাংবাদিক ১০ জন।

সাবেক এমপিদের তালিকা : প্লট পাওয়া আওয়ামী আমলের সাবেক এমপিদের মধ্যে রয়েছেন- আব্বাস আলী মণ্ডল, মো. জামাল হোসেন, কবিরুল হক মুক্তি, জয়নাল হাজারী (প্রয়াত), আশরাফুন্নেসা, আফজাল হোসেন, গোলাম সারওয়ার হিরু, মো. মনিরুল ইসলাম, উম্মে রাজিয়া কাজল, হ্যাপী বড়াল, টিপু সাত্তার, অপরাজিতা হক ও লুৎফুন্নেসা।

প্লট পাওয়া আইনজীবীরা: ঝিলমিলে যে ১২ জন আইনজীবী প্লট পেয়েছেন, তাঁরা হলেন- আরিফ আহমেদ দুলাল, কাজী শফিউল আলম, মো. জাকির হোসেন, গাজী মো. শাহ আলম, মো. ফারুক মিয়া, মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন মিয়া, আব্দুর রহমান হাওলাদার, মোহাম্মদ আলী আকবর, মো. আক্তার হোসেন, মোহাম্মদ জামালউদ্দিন, এ বি এম মাহবুবুর রহমান এবং সাবেক সহকারী অ্যাটর্নী জেনারেল এ বি এম মাহবুবুর রহমান ও মুরাদ রেজা।

সাংবাদিকরা পেয়েছেন প্লট : যে ১০ জন সাংবাদিক ঝিলমিলে অসামান্য অবদানের জন্য প্লট পেয়েছেন তারা হলেন- শাকিল আহমেদ ও তার স্ত্রী ফারজানা রূপা, সোহেল হায়দার চৌধুরী, ইয়াসিন কবির, মাহবুবুর রহমান টিপু, অরূপ কুমার দত্ত, মশি শ্রাবণ, আফজাল হোসেন, আইনি ইলিয়াস ও শান্ত মিশ্রি। এই ১০ জনের বাইরে সাংবাদিক নেতা সাজ্জাদ আলম খান তপু প্লট পেয়েছেন। তিনি বর্তমানে ঝিলমিল সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক।

এছাড়া পূর্বাচলে আটজন সাংবাদিক বিশেষ বরাদ্দ পেয়েছেন, তারা হলেন- মিথিলা ফারজানা, আব্দুল্লাহ আল ফারুক (প্রয়াত), মাসুদা ভাট্টি, হারুনুর রশিদ, কার্তিক চ্যাটার্জি, নুরুল আমিন, শওকত জামিল খান ও দুলাল আচার্য। এর বাইরে সাংবাদিক নেতা মোল্লা জালাল ও প্রয়াত সনৎ নন্দী প্লট পেয়েছেন বলে জানা গেছে। সাংবাদিক মোল্লা জালাল বরাদ্দপ্রাপ্ত প্লটে একতলা বাড়ি নির্মাণ করে নাম রেখেছেন ‘মোল্লা বাড়ি’।

এ বিষয়ে বর্তমান রাজউক চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) ছিদ্দিকুর রহমান সরকার বলেন, উপরের নির্দেশ পালন করা রাজউকের দায়িত্ব। পূর্ববর্তী সরকার যাদের প্লট দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন, রাজউক তাদেরই প্লট প্রদান করেছে। তবে এতে কোনো ভুল-ত্রুটি থাকতে পারে, যা তদন্তের মাধ্যমে পর্যালোচনা হতে পারে। সেই সময় যাদের প্লট দেওয়া হয়েছিল, বিষয়টি পর্যালোচনা করতে উচ্চ আদালত তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে। তারা বিষয়টি দেখছেন। এর পাশাপাশি আমরাও বিষয়টি গভীরভাবে তদন্ত করছি।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!