অভিযুক্ত ২০ জনের সম্পত্তির হিসাব চেয়েছে ট্রাইব্যুনাল

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন

১৬ জুলাই। রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নম্বর ফটক। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা রংপুর নগরীতে মিছিল বের করে ৫ কিলোমিটার পথ হেঁটে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে যায়। ওই মিছিলে যোগ দেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র ও অন্যতম সমন্বয়ক আবু সাঈদ। এসময় ছাত্রলীগ ও পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ বাধে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকে অবস্থান নিয়ে পুলিশ গুলি ও রবার বুলেট ছুড়ে আন্দোলনকারীদের হটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু সাঈদ একাই অবিচল দাঁড়িয়ে থাকেন। এক পর্যায়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। হাসপাতালে নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হলেও তা ভিন্ন খাতে চাপানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ততক্ষণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। ইলেট্রনিক মিডিয়ার ভিডিওতে স্পষ্ট ধরা পড়ে পুলিশের গুলিতে আবু সাঈদের মৃত্যুর বিষয়। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে প্রথম শহীদ হিসাবে নাম লেখায় আবু সাঈদ।

যদিও আবু সাঈদের মৃত্যুকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করে তৎকালীন সরকারের প্রশাসন। কিন্তু সারাদেশে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে, আন্দোলনে মাত্রা যোগ হয়। শুধু আবু সাঈদ নয়, অসংখ্য শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন, কয়েক হাজার আহত হয়েছেন। আন্দোলনে ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত অনেকের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ জমা পড়েছে। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে। এর অংশ হিসেবে তদন্ত সংস্থা আবু সাঈদ হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্টসহ ২০ জনের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির হিসাব চেয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) চিঠি দিয়েছে। ৫ মার্চ এনবিআর চেয়ারম্যানকে সংস্থার কো-কোঅর্ডিনেটর মুহম্মদ শহীদুল্যাহ চৌধুরী পিপিএম সই করা এই চিঠি দেওয়া হয়েছে। এনবিআর সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

জুলাই-আগস্ট, ২০২৪ গণ আন্দোলনে ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের বিবরণী চেয়ে চিঠিতে বলা হয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে সাবেক সরকারের আস্থাভাজন, রাজনৈতিক নেতা ও সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের মামলার তদন্ত কার্যক্রম এই তদন্ত সংস্থায় চলমান। তদন্তের স্বার্থে অভিযুক্ত এই ২০ জনের নামে-বেনামে ক্রয় করা স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের বিবরণ প্রয়োজন। জরুরিভিত্তিতে তদন্ত সংস্থাকে সম্পদের বিবরণ দিতে অনুরোধ করা হয়েছে। আরো বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তদন্ত সংস্থার অভিযোগ রেজিস্টারের ক্রমিক নম্বর ১৫৬ এবং আইসিটি বিডি মিস কেইস নম্বর ১২/২০২৫ এর তদন্তের সার্থে তাদের সম্পদের বিবরণ প্রয়োজন।

অভিযুক্তদের তালিকায় রয়েছেন রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক সাত কর্মকর্তা। তারা হলেন—রংপুর রেঞ্জের সাবেক ডিআইজি মো. আব্দুল বাতেন, রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক পুলিশ কমিশনার মো. মনিরুজ্জামান, সাবেক উপ-পুলিশ কমিশনার মো. আবু মারুফ হোসেন, সাবেক অতিরিক্ত উপ-পুলিশ মো. শাহ নূর আলম পাটোয়ারী, রংপুর মেট্রোপলিটনের কোতোয়ালী জোনের সাবেক সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. আরিফুজ্জামান, রংপুর মেট্রোপলিটনের সাবেক সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. আল ইমরান হোসেন ও রংপুর মেট্রোপলিটনের তাজহাট থানার সাবেক অফিসার ইনচার্জ রবিউল ইসলাম।

অপরদিকে, অভিযুক্তদের তালিকায় রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. হাসিবুর রশিদের নাম রয়েছে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও সাবেক প্রক্টর শরীফুল ইসলাম, সহকারী রেজিস্ট্রার রাফিউল হাসান রাসেল, গণিত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. মশিউর রহমান, লোক প্রশাসন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আসাদুজ্জামান মন্ডলের নাম রয়েছে। এছাড়া রংপুর জেলার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আহাম্মেদ সাদাত ও রংপুর কোতোয়ালী থানার চিকিৎসক মো. সারোয়াত হোসেন ওরফে চন্দনের নাম রয়েছে। অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতাদের মধ্যে রয়েছেন—বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সভাপতি পোমেল বড়ুয়া, সাধারন সম্পাদক মো. মাহফুজুর রহমান শামীম, সাংগঠনিক সম্পাদক ধনঞ্জয় কুমার দাস ওরফে টগর, তথ্য সম্পাদক, বাবুল হোসেন, যুগ্ম সাধারন সম্পাদক মোহাম্মদ এমরান চৌধুরী আকাশ ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাসুদুল হাসান মাসুদ। তালিকায় থাকা সবাই আবু সাঈদসহ অভ্যূত্থানে নিহতের হত্যার সঙ্গে কোন না কোনভাবেই জড়িত ছিলো বলে অভিযোগ পেয়েছে তদন্ত সংস্থা।

সূত্রমতে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ১৮ আগস্ট রংপুরের আদালতে হত্যা মামলা করেন আবু সাঈদের বড় ভাই রমজান আলী। মামলায় পুলিশের সাবেক আইজিপি আব্দুল্লাহ আল মামুন, পুলিশের রংপুর রেঞ্জের তৎকালীন ডিআইজি আবদুল বাতেন, রংপুর মহানগর পুলিশের তৎকালীন কমিশনার মো. মনিরুজ্জামানসহ ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে এবং আরও ৩০ থেকে ৩৫ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। এছাড়া বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ সভাপতি পোমেল বড়ুুয়া, সাধারণ সম্পাদক শামিম মাহফুজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক আসাদুজ্জামান মণ্ডল, গণিত বিভাগের শিক্ষক মশিউর রহমানকেও আসামি করা হয়। পরবর্তীতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ নেতা ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক প্রক্টর শরিফুল ইসলামসহ সাতজনের নাম মামলায় নথিভুক্ত করার জন্য সম্পূরক এজাহার দায়ের করেন তিনি। আদালতের আদেশে তাদেরও ওই মামলায় নামীয় এজহারভুক্ত আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে আবু সাঈদকে হত্যার ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে গত ১৭ জুলাই তাজহাট থানায় একটি মামলা করেছেন।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!