** দেশে বছরে ৪ কোটি হ্যান্ডসেটের চাহিদার মধ্যে উৎপাদিত হয় ২.৫ কোটি, আমদানি হয় ১.৫ কোটি
** জাতীয় নিরাপত্তা ও রাজস্ব আদায়ের স্বার্থে মোবাইলে এনইআইআর চালু করতে বিটিআরসিকে চিঠি
** দেশে মোট মোবাইল হ্যান্ডসেটের বাজারের মধ্যে গ্রে বা চোরাই মার্কেটের বাজার প্রায় ৫০ শতাংশ
** দেশে সচল রয়েছে ১৯ লাখ ৭৬ হাজার আইফোন, যার মধ্যে ১৯ লাখ ৫৫ হাজার-ই অবৈধ
গত আট বছরে ১৭টি দেশি-বিদেশি মোবাইল হ্যান্ডসেট তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব কারখানায় প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। দেশে বর্তমানে চার কোটি হ্যান্ডসেটের মধ্যে প্রায় আড়াই কোটি দেশেই তৈরি হচ্ছে। বাকি দেড় কোটি হ্যান্ডসেট বিদেশ থেকে আমদানি হচ্ছে। সরকার সব ধরনের সুবিধা দেয়ার ফলে গড়ে ওঠা এসব কারখানা দেশের সব নিয়ম মেনে হ্যান্ডসেট উৎপাদন ও বাজারজাত করছে। কিন্তু দেশি-বিদেশি এসব ব্র্যান্ডের হ্যান্ডসেট উৎপাদনকারী কোম্পানির বিনিয়োগ ও বাজার ঝুঁকিতে পড়ছে। কারণ উৎপাদনে নিয়ম-নীতি থাকলেও আমদানিতে কোনো নিয়ম নেই।
এনবিআর সূত্রমতে, চলতি বছরের ১ অক্টোবর মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদনকারী মালিকদের সংগঠন মোবাইল ফোন ইন্ডাস্ট্রি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এমআইওবি) ‘মোবাইল ফোন হ্যান্ডসেট শিল্পের বিকাশে এনআইআর চালু করতে’ এনবিআরকে চিঠি দেয়। সেই চিঠি পর্যালোচনা শেষে ব্যবস্থা নিতে বিটিআরসিকে এনবিআর থেকে চিঠি দেয়া হয়েছে। ‘সরকারের রাজস্ব স্বার্থ সংরক্ষণ এবং দেশের অভ্যন্তরে অবৈধভাবে মোবাইল ফোনের অনুপ্রবেশ রোধে এনআইআর ব্যবস্থা চালু করতে’বিটিআরসি চেয়ারম্যানকে অনুরোধ জানিয়ে এই চিঠি দেয়া হয়েছে।
উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে বর্তমানে ১৭টি মোবাইল ফোন হ্যান্ডসেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কারখানা রয়েছে। দেশে বছরে চার কোটি হ্যান্ডসেটের চাহিদা রয়েছে, যার মধ্যে আড়াই কোটি হ্যান্ডসেট দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। বাকি প্রায় দেড় কোটি হ্যান্ডসেট আমদানির মাধ্যমে চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে। দেশের মোবাইল হ্যান্ডসেটের বাজার প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। আমদানি করা হ্যান্ডসেট থেকে সরকার সঠিকভাবে রাজস্ব আদায় করতে পারছে না। রাজস্ব আদায় নিশ্চিত, এই খাতে বিনিয়োগ আকর্ষণ ও জাতীয় নিরাপত্তা অক্ষুণ্ন রাখার স্বার্থে ন্যাশনাল ইকুইপমেন্ট আইডেনটিটি রেজিস্টার (এনইআইআর) সিস্টেম চালু করা প্রয়োজন। তারা বলছেন, দেশে মোবাইল ফোন অপারেটরের নেটওয়ার্কে সচল রয়েছে ১৯ লাখ ৭৬ হাজার আইফোন, যার মধ্যে ১৯ লাখ ৫৫ হাজারই অবৈধ। বর্তমানে অবৈধভাবে আমদানি করা মোবাইল হ্যান্ডসেট বিক্রির বিষয়ে কোনো নিষেধাজ্ঞা না থাকায় সরকার প্রতিবছর প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে।
অপরদিকে এমআইওবি সভাপতি জাকারিয়া শাহিদের সই করা এনবিআর চেয়ারম্যানকে একটি চিঠিতে বলা হয়েছে, দেশে মোবাইল ফোন প্রস্তুতকারী শিল্পের সম্ভাবনা রয়েছে। বিপুল পরিমাণ স্থানীয় চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সাল থেকে দেশে আমদানির বিকল্প হিসাবে মোবাইল ফোন সংযোজন কারখানা স্থাপন শুরু হয়। এ পর্যন্ত দেশে ১৭টি মোবাইল ফোন হ্যান্ডসেট কারখানা স্থাপিত হয়েছে। দেশি-বিদেশি প্রায় সব প্রধান ব্যান্ড দেশে মোবাইল কারখানা স্থাপন করেছে। বর্তমানে দেশের বৈধ বাজারের প্রায় শতভাগ মোবাইল ফোনের জোগান আসে এই কারখানাগুলো থেকে। কিন্তু উদীয়মান এই শিল্প শুরু থেকেই নানা সমস্যার সম্মুখীন, যা সমাধান করা জরুরি। বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। কারখানায় শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজারের বেশি, যার মধ্যে নারী শ্রমিক প্রায় ৩০ শতাংশ। কারখানায় চার বছরে পাঁচ কোটি হ্যান্ডসেট উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। বর্তমানে বছরে প্রায় আড়াই কোটি হ্যান্ডসেট তৈরি হচ্ছে। দেশের মোবাইলের গ্রে বা চোরাই মার্কেটের আকার প্রায় ৪০ শতাংশ। হ্যান্ডসেট কারখানা গড়ায় ওঠায় দেশে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রি (ব্যাটারি, চার্জার, অ্যাকসেরিজ ইত্যাদি) গড়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এছাড়া মোবাইল সেট রপ্তানির মাধ্যমে দেশকে প্রযুক্তি রপ্তানিকারক দেশে পরিণত করার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
এনইআইআর সিস্টেম চালুর বিষয়ে চিঠিতে বলা হয়েছে, এনইআইআর সিস্টেম চালু করার মাধ্যমে অবৈধভাবে ও কর ফাঁকি দিয়ে মোবাইল ফোনের আমদানি বন্ধ করা হবে—এ আশ্বাসের ভিত্তিতেই দেশের প্রায় সব প্রধান মোবাইল আমদানিকারক স্থানীয়ভাবে কারখানা স্থাপন করেছে। কিন্তু ২০২১ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে এনইআইআর চালু করার কিছুদিনের মধ্যেই তা স্থগিত করে দেয়া হয়। ফোন প্রস্তুতকারকদের সংগঠন এমআইওবি, মোবাইল ফোন অপারেটর, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সব অংশীজনের সঙ্গে কয়েক বছরের পর্যালোচনা শেষে সরকার ২০২১ সালে এই এনইআইআর চালু করে। এর আগে ২০২০ সালে বিটিআরসি বিপুল সরকারি অর্থ ব্যয় করে এনইআইআর সিস্টেমটি ক্রয় ও স্থাপন করে। কিন্তু চালু হওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যেই সিস্টেমটি শিথিল করে দেয়া হয়। এনইআইআর সিস্টেম শিথিল করে দেয়ায় ফোন কারখানাগুলোর বিনিয়োগ এখন দারুণ হুমকিতে পড়েছে। কারণ কর ফাঁকি দিয়ে অবৈধভাবে দেশে আসা হ্যান্ডসেটের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা কঠিন। বৈধ ফোন তৈরির কারখানাগুলোর জন্য রয়েছে বিটিআরসির ও অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের নানা রকমের নিয়ম-নীতি, বিধি-নিষেধ ও উচ্চ লাইসেন্স ফি। অথচ অবৈধ ফোনের ক্ষেত্রে কমিশনের কোন নিয়ম-নীতিই প্রযোজ্য নয়।
এনইআইআর সিস্টেম না থাকায় আরও যেসব অসুবিধা হচ্ছে তা হলো—সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে। গ্রাহক নিম্নমানের সেট কিনে প্রতারিত হচ্ছে। অবৈধ মোবাইলের কোনো ওয়ারেন্টি নেই। অবৈধভাবে আমদানি করা মোবাইল ফোন দিয়ে নানারকম অপরাধ সংগঠিত হয়, যা প্রতিরোধ করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে হিমশিম খেতে হয়। এনইআইআর চালু করার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল এসব অপরাধ দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহায়তা করা। এসব বিষয় বিবেচনা করেই বহু বছরের চেষ্টায় সিস্টেমটি ২০২১ সালে চালু করা হয়। এটি চালু করার কিছুদিন আগে থেকেই অবৈধ হ্যান্ডসেট আমদানিকারকরা সাবধান হয়ে যায় এবং চোরাপথে মোবাইল আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে চালু হওয়ার পরপরই এনইআইআর বন্ধ করে দেয়া হয়। এর ফলে বৈধ মোবাইল হ্যান্ডসেটের বাজারে বড় ধস নেমে আসে। অবৈধভাবে ও কর ফাঁকি দিয়ে দেশে আনা হ্যান্ডসেট ব্যবহারে কোনো বাধা না থাকায় অবৈধভাবে হ্যান্ডসেট আমদানি বেড়েই চলেছে। বর্তমানে মোবাইল ফোনের বাজারের প্রায় ৫০ শতাংশ দখল করে আছে অবৈধভাবে আমদানি করা হ্যান্ডসেট। এই পণ্যের ওপর সরকার কোনো রাজস্ব আদায় করতে পারছে না। বর্তমান অর্থবছরে সরকার এ খাত থেকে সম্ভাব্য দুই হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাবে।
এনইআইআর কেন চালু করা প্রয়োজন, তার চারটি কারণ তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে রয়েছে—উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ; রাজস্ব আদায়; প্রতিশ্রুতিশীল প্রযুক্তিশিল্প; জাতীয় নিরাপত্তা; চুরি, ছিনতাই ও হয়রানি বন্ধ। অপরদিকে এনইআইআর বাস্তবায়নের মাধ্যমে অবৈধ মোবাইল বন্ধ করার সুপারিশ করেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত পার্ক ইয়ং সিক। সোমবার সচিবালয়ে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলামের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে তিনি এই সুপারিশ করেন।