## নোটিশ সার্ভার ও নৈশ প্রহরী থেকে পদোন্নতি নিয়োগ বিধিমালা, ২০১৬-তে অন্তর্ভূক্ত নেই
## অফিস সহায়ক থেকে পদোন্নতি স্থগিত করেনি, কয়েকটি কর অফিস পদোন্নতি দিয়েছে, বেশিরভাগ দিচ্ছে না
## এনবিআরের অফিস সহায়কদের পদোন্নতিতে জট তৈরি হয়েছে, নিয়োগ বিধি-২০১৯ অন্তভূর্ক্ত করার আবেদন
বিশেষ প্রতিনিধি: ফিডার পদ পূর্ণ হয়েছে কারো ৫ বছর, কারো ১০ বছর আগে। কিন্তু পদোন্নতি পান না। মানা হচ্ছে না নিয়োগ বিধিমালা। এমন কি এনবিআর থেকে নির্দেশনা দেয়ার পরও ‘অফিস সহায়কদের’ পদোন্নতি দিচ্ছে না। কয়েকটি কর অফিস ‘অফিস সহায়ক’ থেকে ‘অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক’ পদে পদোন্নতি দিলেও বেশিরভাগ কর অফিস পদোন্নতি দিতে গড়িমসি করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, নিয়োগ বিধিমালায় অন্তর্ভূক্তি ও পদোন্নতি পেতে নোটিশ সার্ভার ও নৈশ প্রহরীরা আদালতে মামলা করেছেন। মামলার রায়ে অফিস সহায়ক থেকে পদোন্নতিতে কোন স্থগিতাদেশ দেয়নি। এরপরও কর অফিসগুলো পদোন্নতি দিচ্ছে না। কর অফিসের মতো এনবিআরের অফিস সহায়কদের পদোন্নতিতেও জট তৈরি হয়েছে। এনবিআর তাদের একদিকে পদোন্নতি দিচ্ছে না, অন্যদিকে তারা নিয়োগ বিধিমালা, ২০১৯-তে অন্তর্ভূক্ত হতে আবেদন করলেও অন্তর্ভূক্ত করা হচ্ছে না বলে জানা গেছে।
এনবিআর সূত্রমতে, ২০২১ সালের ২৯ নভেম্বর এনবিআর থেকে নির্দেশনা দিয়ে সব কর অঞ্চলকে চিঠি দেয়া হয়। যাতে বলা হয়, ‘কর বিভাগ (১০ম গ্রেড হতে ২০তম গ্রেড কর্মচারী) নিয়োগ বিধিমালা-২০১৬’ অনুযায়ী অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে ফিডার পদের তালিকায় ‘নোটিশ সার্ভার ও নৈশ প্রহরী’ পদ দুইটি অন্তর্ভূক্ত নেই। ফলে বিভিন্ন কর অঞ্চলে দুইটি পদে কর্মরত কর্মচারীরা ২০১৭ ও ২০১৮ সালে সাতটি রিট মামলা দায়ের করেন। ২০১৯ সালের ২ মে মামলাসমূহের সম্মিলিত রায় দেয়া হয়। সেই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৯ ও ২০২০ সালে সরকার পক্ষ লিভ টু আপীল দায়ের করেন। এর মধ্যে ২০১৯ ও ২০২০ সালের মোট দুইটি লিভ টু আপীলের শুনানি (ভার্চুয়াল) হয় ২০২১ সালের ২৮ জুন। ওই দুইটিতে দেয়া আদেশ সম্পর্কে এনবিআরের রিটেইনার অ্যাডভোকেট মো. বদরুল ইসলাম বলেছেন, ‘সিভিল পিটিশন ফর লিভ টু আপীলে আপীল বিভাগে শুনানি শেষে মহামান্য সুপ্রীম কোর্ট হাইকোর্ট বিভাগের আদেশ স্থগিত করেন। অর্থাৎ রিট পিটিশনকারীদের নোটিশ সার্ভার এবং নাইট গার্ড থেকে অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে পদোন্নতি স্থগিত হয়ে যায়। এ ছাড়া বিধিমালা কর বিভাগ নিয়োগ বিধিমালা-২০১৬ চ্যালেঞ্জ করায় সেটিও স্থগিত হয়।’
নির্দেশনায় আরো বলা হয়, কর বিভাগের বিদ্যমান নিয়োগ বিধিমালা অনুযায়ী ‘অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক’ পদে ফিডার পদধারীদের মধ্য হতে পদোন্নতি প্রদানের নির্দেশ প্রদান করা হয়। এর আগে ২০১৯ সালের ৬ আগস্ট অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ থেকে পদোন্নতি স্থগিত রাখতে এনবিআরকে নির্দেশ দেয়া হয়। সেই চিঠিতে বলা হয়, ‘মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনার আলোকে আয়কর বিভাগের (১০ম গ্রেড হতে ২০তম গ্রেড) কর্মচারীদের মধ্যে নোটিশ সার্ভার ও নিরাপত্তা প্রহরী পদ হতে অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে পদোন্নতি বিষয়ে সংশোধিত নিয়োগ বিধি ভেটিং এর কার্যক্রম চলমান থাকায় চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের পদোন্নতি কার্যক্রম সাময়িক স্থগিত রাখতে’ নির্দেশ প্রদান করা হয়।
অপরদিকে, ২০২০ সালের ২৭ ডিসেম্বর সেই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারে আবার এনবিআরকে চিঠি দেয়া হয়। কর অঞ্চলগুলোকে পদোন্নতি দেয়ার সেই নির্দেশনায় অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ থেকে পদোন্নতি স্থগিতাদেশ বাতিলের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। অর্থাৎ রিট পিটিশনে আদালতের রায় ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের চিঠি অনুযায়ী, অফিস সহায়ক থেকে অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে পদোন্নতি জটিলতা কেটে গেছে এনবিআরের চিঠিতে বলা হয়।
আয়কর বিভাগ সূত্রমতে, নিয়োগ বিধিতে নোটিশ সার্ভার ও নিরাপত্তা প্রহরী থেকে অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে পদোন্নতির বিষয়টি উল্লেখ নেই। তবে অফিস সহকারী থেকে অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে পদোন্নতির বিষয়টি বলা আছে। নিয়োগ বিধিতে অন্তর্ভূক্ত করতে নোটিশ সার্ভার ও নৈশ প্রহরীরা রিট করেন। রিটের রায়ে নিয়োগ বিধিতে এই দুইটি পদে কর্মরতদের অন্তর্ভূক্ত করতে সরাসরি এনবিআরকে নির্দেশ না দিয়ে বিবেচনা করতে বলেছে। আবার অফিস সহায়ক থেকে পদোন্নতি স্থগিত করেনি আদালত। যার ফলে এনবিআর সব কর অঞ্চল, এলটিইউ, কর পরিদর্শন পরিদপ্তর, কর আপীল অঞ্চলগুলোকে নিয়োগ বিধি অনুযায়ী কেবল অফিস সহায়ক থেকে অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে পদোন্নতি দিতে ২০২১ সালের ২৯ নভেম্বর নির্দেশনা প্রদান করে।
সূত্রমতে, এনবিআরের এই নির্দেশনা মেনে কয়েকটি কর অঞ্চল ইতোমধ্যে অফিস সহায়ক থেকে অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে পদোন্নতি দিয়েছে। তবে এনবিআরের এই নির্দেশনার আগেও কয়েকটি কর অফিস নিয়োগ বিধি অনুযায়ী এই পদে পদোন্নতি দিয়েছে। এর মধ্যে চলতি বছর কর পরিদর্শন পরিদপ্তর একজন, কর অঞ্চল বগুড়া পাঁচজন, ২০২১ সালে কর অঞ্চল বগুড়া দুইজন, বিসিএস (কর) একাডেমি তিনজন, ২০১৯ সালে কর অঞ্চল-১২, ঢাকা চারজন, কর অঞ্চল-২, ঢাকা তিনজন ও কর অঞ্চল-৩, চট্টগ্রাম চারজন, ২০২০ সালে কর পরিদর্শন পরিদপ্তর একজন, কর আপীল অঞ্চল-৪, ঢাকা দুইজন।
অপরদিকে, এনবিআর অভিযোগ পায়, কিছু কর অঞ্চল নিয়োগ বিধিমালা অমান্য করে নোটিশ সার্ভার ও নৈশ প্রহরী হতে অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে পদোন্নতি দিচ্ছে। বিষয়টি জানার পর কমিশনারদের সর্তক করে এনবিআর থেকে ২০১৭ সালের ২০ এপ্রিল চিঠি দেয়া হয়। চিঠিতে বলা হয়, নিয়োগ বিধিমালা-২০১৬’ অনুযায়ী নৈশ প্রহরী ও নোটিশ সার্ভার পদ হতে অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার অপারেটর পদে পদোন্নতি প্রদানের কোন সুযোগ নেই। এ বিষয়ে সকলকে সর্তক থাকতে বলা হয়। আবার কিছু কর অঞ্চল নোটিশ সার্ভার ও নৈশ প্রহরী হতে অফিস সহায়ক পদে সমন্বয় করছে-এমন অভিযোগ পায় এনবিআর। এমন কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকা এবং কর বিধিমালা-২০১৬ অনুসরণ করে পদোন্নতি দিতে অঞ্চলগুলোকে নির্দেশ দিয়ে ২০১৯ সালের ১০ জুলাই এনবিআর থেকে চিঠি দেয়া হয়।
কর অফিসে পদোন্নতি বঞ্চিতদের অভিযোগ, এনবিআরের নির্দেশনা দেওয়ার পর কিছু কর অফিস পদোন্নতি দিয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ অফিস পদোন্নতি দিচ্ছে না। ফিডার পদ পূর্ণ হয়ে কেউ কেউ ৬-১০ বছর পরও পদোন্নতি না পেয়ে অনেকেই হতাশায় ভুগছেন। তাদের অভিযোগ, আদালত নোটিশ সার্ভার ও নৈশ প্রহরী থেকে পদোন্নতি দিতে এনবিআরকে সরাসরি নির্দেশনা দেয়নি। আবার অফিস সহায়ক থেকে পদোন্নতি স্থগিতও করেনি। এরপরও কর কমিশনাররা অনেকেই ইচ্ছে করেই পদোন্নতি দিচ্ছেন না। আবার কর অফিসগুলো পদোন্নতি দেয়ার উদ্যোগ নিলেই নোটিশ সার্ভার ও নিরাপত্তা প্রহরীদের পক্ষ থেকে আদালতের রায়ের ভুল ব্যাখ্যা করে কমিশনারদের বিভিন্ন জায়গা থেকে চিঠি দেয়া হয়। ফলে কমিশনাররা অনেকেই ভয়ে পদোন্নতি দিচ্ছেন না।
অপরদিকে, এনবিআরে অফিস সহায়ক পদে পদোন্নতি বঞ্চিতরা জানিয়েছেন, ফিডার পদ পূর্ণ হয়ে ৮-১০ বছর হলেও এই পদ থেকে পদোন্নতি দেয়া হচ্ছে না। এনবিআরের নিয়োগ বিধি অনুযায়ী এই পদে ২৫% পদোন্নতির বিধান চালু রয়েছে। তবুও পদোন্নতি দেয়া হচ্ছে না। নিয়োগ বিধিমালা, ২০১৯ (কমন) অন্তর্ভূক্ত করতে আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু এনবিআর এই বিধিমালা অনুসরণ করছে না বলে অভিযোগ করেছেন তারা।
এই বিষয়ে একাধিক কর কমিশনার জানিয়েছেন, ‘নিয়োগ বিধিতে নোটিশ সার্ভার ও নৈশ প্রহরীর পদোন্নতির বিষয় উল্লেখ নেই। ফলে তাদের পদোন্নতির সুযোগ নেই। আদালতের মামলার রায়ে যেহেতু অফিস সহায়ক পদ থেকে পদোন্নতিতে কোন স্থগিতাদেশ দেয়া হয়নি, সেহেতু পদোন্নতির যোগ্য হলেই পদোন্নতি দেয়া হবে।’
এই বিষয়ে বাংলাদেশ ট্যাকসেস ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. মঞ্জিল মিয়া বলেন, আদালত বলেছে, যদি কোন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর নোটিশ সার্ভার ও নৈশ প্রহরী-এই দুইটি পদে পদোন্নতি দিয়ে থাকে, তাহলে আমাদের পদোন্নতি দিতে। ১৯টি মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর এই দুইটি পদে পদোন্নতি দিয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। নিয়োগ বিধি, ২০১৬-তে এই দুইটি পদ অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি। তাহলে কিভাবে আপনারা পদোন্নতি পাবেন-এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ২০১৬ সালে নিয়োগ বিধি হওয়ার পূর্বে ২০১২ সালে এনবিআরের ৮ সদস্য নিয়ে একটি সভা হয়েছে। সেই সভায় আমাদের দুইটি পদে পদোন্নতির একটি খসড়া নীতিমালা তৈরি করে অনুমোদন করে এনবিআর থেকে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে পাঠানো হয়। সেখানে পাস হলে তা পাঠানো হয় জনপ্রশাসনে। জনপ্রশাসনে পাস হয়ে তা পাঠানো হয় পিএসসিতে। পিএসসি তা চূড়ান্ত করে আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ে পাঠায়। কিন্তু শেষ মূহুর্তে কোন অদৃশ্য কারণে তা বাতিল হয়ে যায়।
এই বিষয়ে এনবিআরের একজন কর্মকর্তা বলেন, কোন আইনি জটিলতা না থাকায় অফিস সহায়ক থেকে পদোন্নতি দিতে আমরা কর অঞ্চলসহ মাঠ অফিসগুলোকে চিঠি দিয়েছি। কিছু অফিস পদোন্নতি দিয়েছে। যারা দেয়নি, কেন দেয়নি তা জানার চেষ্টা করা হবে। তবে নিয়োগ বিধির বাইরে গিয়ে পদোন্নতি দেয়ার সুযোগ নেই।
###