গরু জবাইয়ের পর মাংস সংগ্রহের পরে অধিকাংশ অবশিষ্টাংশ ময়লা বা ভাগাড়ে ফেলা হয়। তবে পশুর যৌনাঙ্গ, রক্ত, হাড়, শিং, ভুঁড়ি, লেজের লোম ও চর্বি কোনো অংশই অকেজো নয়। এসবের বাণিজ্যিক মূল্য ও নানা ব্যবহার রয়েছে। বিশেষ করে গরুর লিঙ্গ থেকে তৈরি কুকুরের খাবারের চাহিদা বিদেশে অনেক বেশি। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে নয়টি প্রতিষ্ঠান প্রক্রিয়াজাত বুলস্টিক রপ্তানি করছে। সদ্য শেষ হওয়া অর্থবছরে শুধুমাত্র মে মাসে ৫টি প্রতিষ্ঠান ১৪,৭৫২ কেজি বুলস্টিক রপ্তানি করেছে, যার মূল্য প্রায় ৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা।
রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তারা জানান, এই পণ্য মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় রপ্তানি হয়। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রে এবং বাকি ৪০ শতাংশ কানাডায় যায়। বুলস্টিকের মান ও ধরনের ওপর ভিত্তি করে প্রতি কেজির দাম ১৮ থেকে ৩৫ মার্কিন ডলার পর্যন্ত হয়। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র প্রধান রপ্তানি বাজার, তাই সেখানে পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা এই পণ্যের রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
গরু ও মহিষের বুলস্টিক (ষাঁড়গরুর যৌনাঙ্গ) থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের বিষয়টি অনেকের কাছে অপরিচিত হতে পারে। তবুও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রায় ২০ কোটি টাকার বুলস্টিক রপ্তানি করেছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৫৩৭ কেজি বুলস্টিক রপ্তানি হয়, যার ৯৫ শতাংশ গরুর। ওই বছরে এই অপ্রচলিত পণ্য থেকে বাংলাদেশ ৩৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা আয় করে। খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, আগে এ পণ্যে ১০-১৫ শতাংশ প্রণোদনা থাকলেও এখন তা কমে ৬ শতাংশে নেমেছে, যা রপ্তানি আগ্রহ কমানোর একটি কারণ হিসেবে কাজ করছে।
সংশ্লিষ্ট রপ্তানিকারকরা জানান, চীনের কিছু ব্যবসায়ী এই পণ্য কাঁচা অবস্থায় কম দামে রপ্তানি করায় বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রা হারাচ্ছে। একই সঙ্গে কাঁচামালের ঘাটতির কারণে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এছাড়া, গরু জবাইয়ের আগে বিএসই (বভিন স্পঞ্জিফর্ম এনসেফ্যালোপ্যাথি বা ম্যাডকাউ ডিজিজ) সার্টিফিকেট প্রদান করলে এই পণ্য ইউরোপীয় বাজারে সহজে রপ্তানি করা সম্ভব হবে। ইউরোপের বাজারে প্রবেশ করলে রপ্তানি আয় দ্বিগুণের আশঙ্কা রয়েছে।
গরু ও মহিষের বুলস্টিক যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপের কিছু দেশে কুকুরের খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বিশ্বে এ ধরনের অপ্রচলিত পণ্য রপ্তানিতে ব্রাজিল ও তুরস্ক এগিয়ে রয়েছে। তবে খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, বাংলাদেশেরও এ পণ্য রপ্তানির ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।
খাত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বুলস্টিক রপ্তানির জন্য প্রথমে গরু জবাইয়ের পর লিঙ্গ সংগ্রহ করে ফ্রিজারে সংরক্ষণ করতে হয়। এরপর ভালোভাবে ধুয়ে চামড়া ও চর্বি অপসারণ করে আলাদা করা হয়। মূত্রনালি বিচ্ছিন্ন করে পুনরায় পরিষ্কার করার পর রোদে শুকানো হয়। তবে সূর্যের আলোতে শুকালে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণের সম্ভাবনা থাকে। এজন্য বাণিজ্যিক ওভেনে ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ৬০ মিনিট ধরে শুকানো হয়, যা পণ্য প্রস্তুত করে। তবে ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী এই পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা হয়। শুকানোর সময় আর্দ্রতা ৫ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে রাখা জরুরি। রপ্তানির জন্য পণ্য প্রস্তুত হলে স্বাস্থ্যসনদ ও ছাড়পত্র সংগ্রহ করা হয়। প্রতি বুলস্টিক নির্দিষ্ট ওজন ও আকৃতিতে (৬ ও ১২ ইঞ্চি) কেটে ভ্যাকুয়াম প্যাকিং করে রপ্তানি করা হয়।
গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট ১ লাখ ২ হাজার ৮৯ কেজি বুলস্টিক রপ্তানি হয়েছে, যার বাজারমূল্য প্রায় ২০ কোটি টাকা। ২০২২ সাল থেকে বুলস্টিক রপ্তানি ব্যবসা শুরু করেছে ফ্রন্টিয়ার পেট ফুডস, যা বর্তমানে প্রতি মাসে গড়ে দেড় টন পণ্য যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় পাঠাচ্ছে। ফ্রন্টিয়ার পেট ফুডসের পরিচালক আবিদ আজাদ জানান, রপ্তানিতে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে একটি সমিতি গঠনের চেষ্টা চলছে, যা ব্যবসা পরিচালনাকে আরও সহজ করবে। তিনি বলেন, প্রণোদনা বাড়ালে অনেকেই এই ব্যবসায় আগ্রহ দেখাবেন। যেহেতু বুলস্টিক অপ্রচলিত পণ্য, ব্যাংক ঋণ পাওয়া কঠিন; সরকার যদি এই সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসে, ব্যবসায়ীরা লাভবান হবে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উৎপাদন শাখার পরিচালক এ বি এম খালেদুজ্জামান জানান, কয়েক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে বিএসই ও আইএসও সার্টিফিকেটের জন্য জিএলপিপি (গুড ল্যাবরেটরি প্র্যাকটিস প্রোগ্রাম) কর্মসূচি শুরু হয়েছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়ন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রকল্পটি স্থগিত রয়েছে। বর্তমানে বড় চ্যালেঞ্জ হলো অধিদপ্তরের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও প্রশিক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়ন সংগ্রহ করা।