সুন্নতে খতনার অস্ত্রোপচারের পর শিশু আয়ান আহমেদের মৃত্যুর জন্য রাজধানীর বাড্ডার সাঁতারকূলে ইউনাইটেড মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দায়ী করা হয়েছে। সম্প্রতি হাইকোর্টে দাখিল করা প্রতিবেদনে হাইকোর্টের আদেশে গঠন করা বিশেষজ্ঞ তদন্ত কমিটি এ সিদ্ধান্ত জানায়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৪ মাস আগে শিশু আয়ানের অস্ত্রোপচারের সময় হাসপাতালটি ছিল নির্মীয়মাণ এবং সেখানে অবৈধভাবে চিকিৎসা চলছিল।
প্রতিষ্ঠানটিকে শিশু আয়ানের মৃত্যুর জন্য আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রদান করা উচিত। ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর আয়ানের অভিভাবকরা তাকে সুন্নতে খতনা করানোর জন্য সাঁতারকূল বাড্ডার ইউনাইটেড মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। খতনা শেষ হওয়ার পর আয়ানের জ্ঞান ফিরে না আসায় তাকে সেখান থেকে গুলশান-২ এর ইউনাইটেড হাসপাতালে পাঠানো হয়, যেখানে পিআইসিইউ (শিশু নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) তে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়।
এর সাত দিন পর শিশুটির মৃত্যু ঘটে। ২০২৩ সালের ৯ জানুয়ারি এ ঘটনায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এ বি এম শাহজাহান আকন্দ মাসুম হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন। রিটে শিশুটির পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণের নির্দেশনা চাওয়া হয়। পরবর্তীতে এই রিটে শিশুটির বাবা শামীম আহমেদকেও আবেদনকারী হিসেবে যুক্ত করা হয়।
প্রাথমিক শুনানির পর হাইকোর্ট ঘটনা অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়। একই সঙ্গে রুল জারি করে আদালত। রুলে আয়ানের পরিবারকে কেন পাঁচ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। হাইকোর্টের এই আদেশে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক ডা. পরিমল কুমার পালের দেওয়া ১৫ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হয়, তবে এই প্রতিবেদনকে ‘আইওয়াশ’ এবং প্রতিবেদনের সুপারিশকে ‘হাস্যকর’ বলে মন্তব্য করেন হাইকোর্ট।
প্রতিবেদনে শুনানির পর নতুন করে পাঁচ সদস্যের বিশেষজ্ঞ তদন্ত কমিটি গঠন করে দেন উচ্চ আদালত। এর আহ্বায়ক করা হয় সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও অ্যানেসথেসিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. এ বি এম মাকসুদুল আলমকে।
সম্প্রতি এই কমিটি হাইকোর্টে প্রতিবেদন দাখিল করে। গত ২৯ জানুয়ারি হাইকোর্ট প্রতিবেদনটি নথিভুক্ত করে ক্ষতিপূরণ প্রশ্নে জারি করা রুলটি শুনানির জন্য রেখেছেন। বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায়চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চে আগামী ৫ মার্চ রুল শুনানির তারিখ রয়েছে।
রিটকারী আইনজীবী এ বি এম শাহজাহান আকন্দ মাসুম নিজেই রিটের পক্ষে শুনানিতে আছেন। তিনি বলেন, ‘আশা করি রুল শুনানিতে প্রতিবেদনটি নিয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হবে। চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে বেশ কিছু সুপারিশ করেছে বিশেষজ্ঞ কমিটি। আয়ানের মৃত্যুর জন্য ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে একটি যুগান্তকারী রায় প্রত্যাশা করছি।’
হাইকোর্টে দাখিল করা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কমিটি মনে করে, ইউনাইটেড মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের উপযোগী পরিবেশ ছিল না, তেমনি অস্ত্রোপচারের পর জরুরি পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার যথাযথ ব্যবস্থা ছিল না। এছাড়া, আয়ানের মা-বাবা ও আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে হাসপাতালের চিকিৎসক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের আচরণ ছিল রূঢ়। সর্বোপরি, পাঁচ লাখ ৭৭ হাজার ২৭৭ টাকার চিকিৎসা বিল পরিশোধ করে আয়ানের মৃতদেহ নিয়ে যেতে বলাটা ছিল হাসপাতালের অমানবিক আচরণ।
সুপারিশে বলা হয়েছে, শিশু আয়ানের মৃত্যুর জন্য দায়ী ইউনাইটেড মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উচিত আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়া। ক্ষতিপূরণের একটি অংশ আয়ানের মা-বাবাকে দিতে বলা হয়েছে। বাকি অংশ দিয়ে দুস্থ শিশু, কিশোর-কিশোরীদের জন্য একটি হাসপাতাল নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছে।
আরেক সুপারিশে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া চিকিৎসা কর্মকাণ্ড পরিচালনা এবং আয়ানের মৃত্যুর জন্য হাসপাতালটির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হোক। সেই সঙ্গে শিশু আয়ানের অস্ত্রোপচারের সঙ্গে জড়িত হাসপাতালের চিকিৎসক তাসনুভা মাহজাবীন ও অ্যানেসথেসিওলজিস্ট সৈয়দ সাব্বির আহম্মদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কাউন্সিল আইন, ২০১০ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতেও সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও সুপারিশ করা হয়েছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া যেসব হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসা কার্যক্রম চলছে, সেগুলো অবিলম্বে বন্ধ করে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।