অনিয়ম ঋণের খেলাপি, বাড়ছে অর্থনৈতিক চাপ

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে অনিয়ম ও জালিয়াতির মাধ্যমে যেসব ঋণ দেওয়া হয়েছিল, তা একে একে খেলাপি হয়ে পড়েছে, ফলে অর্থনীতির ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। গত ডিসেম্বরের শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাংকগুলো বর্তমানে যে পরিমাণ ঋণ বিতরণ করেছে, এর ২০ দশমিক ২০ শতাংশ খেলাপি হয়ে গেছে। বিশেষত, গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর ছয় মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বুধবার ( ২৭ ফেব্রুয়ারি ) এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আগেই বলেছিলাম, খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি আপাতত ভালোর দিকে যাবে না। যতই নতুন তথ্য আসছে, ততই বাড়ছে। যেভাবে ধারণা দিয়েছিলাম, সেভাবে বাড়ছে। সামনে আরও বাড়বে।’তিনি জানান, আগে খেলাপি ঋণ কিছুটা কম দেখানো হতো। একসময় ছিল ৯ শতাংশ, যা বেড়ে ২০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। খেলাপি ঋণ এখনো সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছায়নি। এ ছাড়া নীতিমালায় কিছু পরিবর্তন আসছে। আগে ১৮০ দিন পর খেলাপি হতো, এখন ৯০ দিনে খেলাপি হয়ে পড়ছে। এ কারণেও খেলাপি ঋণ কিছুটা বাড়বে।

খেলাপি ঋণ বাড়ল কত
গত সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা, যা ডিসেম্বরে বেড়ে হয় ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। ফলে অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬০ হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা। ডিসেম্বর শেষে মোট বিতরণ করা ঋণ ছিল ১৭ লাখ ১১ হাজার ৪০১ কোটি টাকা।এর আগে গত জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে বা ওই তিন মাসে ব্যাংকব্যবস্থায় খেলাপি ঋণ বাড়ে ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। বিগত সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে যে অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে, তা এখন খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হতে শুরু করেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকে মোট বিতরণ করা ঋণের মধ্যে খেলাপি ঋণের হার কিছুটা বেড়েছে। এ হার আগের সেপ্টেম্বরে ছিল ৪০ দশমিক ৩ শতাংশ, যা বেড়ে ৪২ দশমিক ৮৩ শতাংশ। একই সময়ে বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১১ দশমিক ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৫ দশমিক ৬০ শতাংশ।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। এর পর থেকে এই পরিমাণ বেড়েই চলছে। অর্থনীতিবিদেরা অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করছেন, সাবেক সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ লুটপাট হয়েছে, যার একটা বড় অংশ বিদেশে পাচার হয়েছে।

গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র বের হতে শুরু করেছে। সাবেক সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে প্রভাবশালীদের বড় অঙ্কের ঋণ দিতে নানা সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ কাগজে-কলমে কম দেখানো হতো। সরকার পরিবর্তনের পর সেই নীতি থেকে সরে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

কেন বাড়ছে খেলাপি
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, আওয়ামী লীগঘনিষ্ঠ এবং সমালোচিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের নামে ও বেনামে নেওয়া ঋণের প্রকৃত চিত্র এখন ব্যাংকগুলো প্রকাশ করতে শুরু করেছে, যার কারণে খেলাপি ঋণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। ইসলামী ব্যাংকে খেলাপি ঋণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। একইভাবে, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকেও খেলাপি ঋণ বেড়েছে। এর পাশাপাশি, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, সিকদার গ্রুপসহ কিছু বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর ঋণও খেলাপি হয়ে পড়েছে। বেশিরভাগ ঋণ ছিল বেনামি, যা অনিয়ম ও জালিয়াতির মাধ্যমে নেওয়া হয়েছিল।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের শীর্ষ ১০ খেলাপি প্রতিষ্ঠান হলো বেক্সিমকো গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, এননটেক্স গ্রুপ, মাইশা গ্রুপ, এফএমসি গ্রুপ, ক্রিসেন্ট গ্রুপ, রতনপুর গ্রুপ, জাকিয়া গ্রুপ, রিমেক্স ফুটওয়্যার ও রাঙ্কা গ্রুপ।

ব্যাংক খাতের পরিস্থিতি ঠিক করতে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী। তিনি বলেন, “খেলাপি ঋণ বাড়ছে, এই গল্প আর কত দিন শুনব? বাংলাদেশ ব্যাংক তাহলে কি সমস্যার সমাধান করতে পারছে না? বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে হবে, কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, কত টাকা খেলাপি ঋণ আদায় হয়েছে, খেলাপি ঋণের কারণে কতজন আইনের আওতায় এসেছে, এবং ছয় মাসে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। জাতি জানতে চায়। না হলে মনে হবে মূল সমস্যাকে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে।”

টাকা ফেরত পাবেন সবাই
ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পেলেও, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর গতকাল আবারও নিশ্চিত করেছেন যে, সব আমানতকারী তাদের টাকা ফেরত পাবেন। গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, ব্যাংকের আমানত প্রবৃদ্ধি পর্যাপ্ত নয় এবং ৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি বলেন, ব্যাংক খাতের ওপর জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে, পাশাপাশি লেনদেন ভারসাম্য উন্নত করতে হবে এবং রিজার্ভ বাড়াতে হবে। বর্তমানে রিজার্ভ ২১ বিলিয়ন ডলার।

গভর্নর বলেন, আইএমএফ যে লক্ষ্য দিয়েছে, তা আমরা অর্জন করেছি এবং সামনের মার্চেও তা সম্ভব হবে। আমরা স্বস্তিকর অবস্থায় আছি এবং সহসাই লেনদেন ভারসাম্য ও ব্যাংক খাত থেকে কোনো চাপ আসবে না। তবে কিছু ব্যাংকের তারল্যে সমস্যা রয়েছে, যা আমানত প্রবৃদ্ধি বাড়লে সমাধান হবে। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার চেষ্টা করা হবে এবং এ জন্য আইন তৈরি হচ্ছে। পাশাপাশি, আমানত বিমা আইন পরিবর্তন করার পরিকল্পনাও জানান গভর্নর। তিনি বিশ্বাস করেন, কোনো ব্যাংক বন্ধ হবে না এবং ব্যাংকে টাকা রেখে ফেরত পাওয়া যাবে না, এমন কিছু হবে না। সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ব্যাংক থাকুক বা না থাকুক, সব আমানতকারী তাদের টাকা ফেরত পাবেন।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!