অনিয়মে ডুবছে কেরু, রাজস্ব ক্ষতি অর্ধশত কোটি টাকা

দেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত মদ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান কেরু অ্যান্ড কোং (বাংলাদেশ) লিমিটেড চরম অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর রাব্বিক হাসান এবং বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের চেয়ারম্যান ড. লিপিকা ভদ্রের বিরুদ্ধে রয়েছে গুরুতর অভিযোগ। তাদের অনিয়মের ফলে গত অর্থবছরে সরকারের ৫০ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে। এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত ১৯ জুন লিপিকাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে সরকার।

অন্যদিকে, আওয়ামী সরকারের সময় যিনি সুবিধা পেয়েছেন সেই রাব্বিক হাসান এখন ভোল পাল্টে পরিচয় দিচ্ছেন জাতীয়তাবাদী চিন্তার অনুসারী হিসেবে। বাড়ির ঠিকানা বদলে এখন বগুড়াকে নিজের স্থায়ী ঠিকানা দেখিয়ে, তিনি গড়ে তুলেছেন চার সদস্যের একটি গোপন সিন্ডিকেট।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্রে জানা গেছে, করপোরেশনের কোনো অনুমতি ছাড়াই কেরু অ্যান্ড কোং-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর রাব্বিক হাসান গত আখ মাড়াই মৌসুমে ৬২ জন শ্রমিককে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেন। অভিযোগ রয়েছে, এসব নিয়োগের বিনিময়ে প্রত্যেকের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করা হয়েছে। রাব্বিক হাসানের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে চালানো এসব দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে কেরু ডিস্টিলারি থেকে সরকার অর্ধশত কোটি টাকারও বেশি রাজস্ব হারিয়েছে। এ সংক্রান্ত একটি লিখিত অভিযোগ কেরুর দুই কর্মকর্তা দুদকে জমা দেন। অভিযোগটি বর্তমানে তদন্তের শেষ ধাপে রয়েছে বলে জানিয়েছে দুদক।

অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে কেরুর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর রাব্বিক হাসান গত সোমবার সন্ধ্যায় বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনিত সব অভিযোগ ভিত্তিহীন ও বানোয়াট। বিষয়টি শিল্প মন্ত্রণালয়ের নজরে রয়েছে এবং তারা এ নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটি বিষয়টি খতিয়ে দেখছে।

এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একজন পরিচালক জানিয়েছেন, কেরু সংক্রান্ত তদন্ত এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে। খুব শিগগিরই তদন্ত সম্পন্ন করে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্রে জানা গেছে, কেরুর বাংলা মদ (সিএস) প্লাস্টিক বোতলে বাজারজাত করার সিদ্ধান্তে ফরেন লিকার (এফএল) বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। অথচ কেরু থেকে সরকারের রাজস্ব আয়ের বড় অংশ, প্রায় শতকরা ৯০ শতাংশই আসে এই এফএল বিক্রি থেকে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে যেখানে এফএল বিক্রি হয়েছিল ২ লাখ ২৮ হাজার ৭৯৩ কেস, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় ২ লাখ ২ হাজার ৬৯৮ কেসে। এতে প্রায় ৪৬ কোটি ৯৭ লাখ টাকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হয় সরকার। এ ছাড়া কেরুর ব্যবস্থাপনা পরিচালক পরিবেশ অধিদপ্তরের মতামত এবং অ্যালকোহল বিধিমালা উপেক্ষা করে একগুঁয়ে সিদ্ধান্তে সিএস প্লাস্টিক বোতলে বাজারজাত করেন, যার ফলে সেগুলো অবিক্রীত থেকে যায় এবং তাতেও সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে কোটি কোটি টাকা।

সূত্র জানিয়েছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলা মদ (সিএস) বিক্রি হয়েছিল ২৮ লাখ ৪ হাজার ৯০৯ প্রুফ লিটার, যা ২০২৪-২৫ অর্থবছরে নেমে আসে ২৪ লাখ ১৭ হাজার ৭১৫ প্রুফ লিটারে। ফলে সদ্য শেষ হওয়া অর্থবছরে আগের বছরের তুলনায় সিএস বিক্রি কমেছে ৩ লাখ ৮৭ হাজার ১৯৪ প্রুফ লিটার।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, গত এক বছর ধরে নিয়ম ভেঙে চলছে কেরুতে মদের বোতলজাতকরণ কার্যক্রম। প্রতিষ্ঠানটি যে নতুন মেশিন ব্যবহার করছে, তার অনুমোদন ছিল শুধুমাত্র পরীক্ষামূলক উৎপাদনের জন্য, তবু তা ব্যবহার করে চলছে নিয়মিত বোতলজাত। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কেরুর দেশি লিকার বোতলের গায়ে ট্রেডমার্ক, প্রুফ একক, সুরাশক্তির পরিমাণ, ব্যাচ নম্বর, উৎপাদনের তারিখ এবং উৎপাদকের নাম-ঠিকানাসহ কয়েকটি বাধ্যতামূলক তথ্য উল্লেখের নির্দেশনা দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে এসব নির্দেশনার অনেকটাই উপেক্ষিত। উৎপাদনের তারিখ বা মেয়াদোত্তীর্ণের বিষয়টি বোতলের গায়ে নেই, আর প্লাস্টিক বোতল প্রতি সাত টাকা দামের হলেও লেবেলে দেখানো হয়েছে ১৪ টাকা।

সূত্র আরও জানায়, অতীতে কেরুর চিনিকলে যেসব ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করেছেন, তারা নিয়মিত মাঠপর্যায়ে গিয়ে চাষিদের সমস্যা, দাবি-দাওয়া ও অভিযোগ শুনতেন এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতেন। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসব বিষয়কে গুরুত্ব দিচ্ছেন না এবং চাষিদের কথা শুনছেন না। এতে করে চাষিরা বিভ্রান্ত ও হতাশ হয়ে পড়েছেন।

দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) দেওয়া এক অভিযোগে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভুক্তভোগী জানান, কেরুতে একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে। তার মতে, এই সিন্ডিকেটের লাগামহীন দুর্নীতি বন্ধ না হলে খুব শিগগিরই রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটি চরম সংকটে পড়বে বা ধ্বংসের মুখে পড়বে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!