অনিয়মের ফাঁদে ১৪ ব্যাংকের আমানতকারীরা

দেশের কিছু ব্যাংক আমানত ও ঋণের ভারসাম্য বজায় রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। ১৪টি ব্যাংক গ্রাহকের নিরাপত্তা সীমা লঙ্ঘন করে ইচ্ছামতো ঋণ বিতরণ করেছে, যার ফলে ঋণের অর্থ আদায়ে ব্যাংকগুলো একদিকে চাপে পড়ছে, অন্যদিকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। অতিরিক্ত লাভের লোভে এবং ব্যাপক অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ বিতরণ করেছে এই ব্যাংকগুলো। এর ফলে অনেক ব্যাংকে তারল্য সংকট তীব্র হয়ে উঠেছে এবং ভারসাম্যহীন ঋণ বিতরণের কারণে গ্রাহকের আমানত ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। এসব তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেক হিসাব-নিকাশ করে ঋণ দেয়ার সীমা বেঁধে দিয়েছে। সেই সীমা অতিক্রম করা ঠিক নয়। এতে ব্যাংক খাতে আরও ঝুঁকি তৈরি করবে। বিশেষ করে আমানতকারীরা বেশি ঝুঁকিতে থাকবে। ইতোমধ্যে কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বিধিমালা অনুযায়ী, প্রচলিত ধারার ব্যাংক ১০০ টাকা আমানতের বিপরীতে সর্বোচ্চ ৮৭ টাকা এবং ইসলামি ধারার ব্যাংক ৯২ টাকা ঋণ দিতে পারে। একে ব্যাংকিং পরিভাষায় এডিআর বা ঋণ-আমানত অনুপাত সীমা বলা হয়। ব্যাংকগুলোকে গ্রাহকের নিরাপত্তার জন্য (সিএলআর এবং এসএলআর) অবিতরণকৃত অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখতে বাধ্য করা হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে প্রচলিত ধারার ন্যাশনাল ব্যাংক সীমার চেয়ে ২৬ টাকা ৫৬ পয়সা বেশি ঋণ দিয়েছে, ফলে ন্যাশনাল ব্যাংকের এডিআর সীমা ১১৩ দশমিক ৫৬ শতাংশে পৌঁছেছে। এ পরিস্থিতিতে ব্যাংকটি এখন গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে হিমশিম খাচ্ছে। তবে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তারল্য সহায়তা পাওয়ার পর কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে ব্যাংকটি। এছাড়া, পদ্মা ব্যাংক ঋণ বিতরণ করেছে ৮৭ দশমিক ৯০ শতাংশ, সীমার বেশি ঋণ বিতরণ করলেও ব্যাংকটি তা আদায় করতে পারছে না এবং গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। একইভাবে এবি ব্যাংকের এডিআর ৯৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ এবং ব্যাংকটির ইসলামি উইন্ডো ১১২ দশমিক ৩১ শতাংশ ঋণ বিতরণ করেছে।

যেখানে সর্বোচ্চ সীমা ৯২ শতাংশ। এখানে ২০ শতাংশের বেশি ঋণ বিতরণ হয়েছে; যা গ্রাহকের জন্য বাড়তি ঝুঁকি তৈরি করেছে। এছাড়া প্রিমিয়ার ব্যাংকের এডিআর ৮৭ দশমিক ৩৭ শতাংশ এবং ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক পিএলসি ৯১ দশমিক ৩৯ শতাংশ এডিআর।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, আমানতের বিপরীতে কত টাকা ঋণ দিতে পারবে, এর একটি সীমা নির্ধারণ করে দেয়া আছে। সুতরাং নির্দিষ্ট হারের ওপরে ব্যাংকগুলো কোনোভাবেই ঋণ দিতে পারবে না। তাহলে তারল্য সংকটে ভুগবে ব্যাংকগুলো। আমানতকারীদের টাকাও ফেরত দিতে পারবে না। এজন্য এডিআর রেশিওর বিষয়টি সঠিকভাবে মানতে হবে। অনেক সময় ব্যাংক অধিক লাভের আশায় ঝুঁকি নিয়ে ঋণ বিতরণ করে। এতে আমানতকারীরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। অর্থাৎ অধিক লাভের লোভ ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনায় ঝুঁকি তৈরি করে, যার মাশুল গুনতে হয় আমানতকারীদের। এডিআর রেশিও অতিক্রম করলে নিয়মিত চিঠি দিয়ে তদারকি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলো ঋণ আদায় ও আমানত বাড়িয়ে এমন ঝুঁকি থেকে বের হয়ে আসতে পারে।

গত ডিসেম্বর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের এডিআর দাঁড়িয়েছে ৯৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ। সীমার অতিরিক্ত ঋণ দেয়ায় মাত্র কয়েকজন গ্রাহকের কাছে বিতরণ করা ঋণের সিংহভাগ আটকে পড়েছে; যা আদায় করা যাচ্ছে না।

বেসিক ব্যাংকের ঋণ বিতরণ ৯২ দশমিক ৬২ শতাংশ হয়েছে। ইসলামি শরিয়াহ ভিত্তিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে ইউনিয়ন ব্যাংকের এডিআর ১১৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ৯৫ দশমিক ১৪ শতাংশ, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ১০৬ দশমিক ৭১ শতাংশ এবং ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের রেকর্ড এডিআর ১২৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ। ইসলামি ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির এডিআর ৯৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ, আইএফআইসি ব্যাংক পিএলসি ৯১ দশমিক ৩৪ শতাংশ এবং সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসির এডিআর ১১৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ। এছাড়া, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ইসলামী উইন্ডো ১৪০ দশমিক ০৫ শতাংশ ঋণ বিতরণ করেছে।

গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ এম হেলাল আহমেদ বলেন, এই সমস্যা সমাধানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি আরও জোরদার করা প্রয়োজন, পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানো উচিত। সতর্ক করার পরও যেসব ব্যাংক একই অনিয়ম চালিয়ে যাবে, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। এছাড়া, রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংকের সংখ্যা বৃদ্ধি না করে, দেশের অর্থনীতির আকার অনুযায়ী ব্যাংকগুলোর সংখ্যা নির্ধারণ করা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।

এদিকে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে অনিয়ম ও জালিয়াতির মাধ্যমে যেসব ঋণ দেয়া হয়েছিল, তা একে একে খেলাপি হয়ে পড়েছে, যা অর্থনীতির ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করেছে। গত ডিসেম্বরের শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ ঋণ বিতরণ করেছে, এর ২০ দশমিক ২০ শতাংশ খেলাপি হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে ২০২৪ সলের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা।

খেলাপি ঋণের কারণে নিরাপত্তা সঞ্চিতি ঘাটতি দ্রুত বাড়ছে। ভালো ও মন্দ ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে পর্যাপ্ত প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে হয়। তবে ঋণ জালিয়াতি, অব্যবস্থাপনা এবং অন্যান্য অনিয়মের কারণে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ যেভাবে বাড়ছে, তাতে ব্যাংকগুলো পরিচালন মুনাফা না বাড়ায় পর্যাপ্ত প্রভিশন রাখতে পারছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংক খাতে মোট প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি ঘাটতি ১ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকারও বেশি হয়ে গেছে। গত সেপ্টেম্বর শেষে এই ঘাটতি ছিল ৫৫ হাজার ৩০০ কোটি টাকারও বেশি, অর্থাৎ মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে প্রভিশন ঘাটতি দ্বিগুণ বেড়ে গেছে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!