** অর্থ উপদেষ্টা মঙ্গলবার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চেয়েছেন
** কর্মকর্তারা বলছেন, আলোচনার জন্য তাদেরকে কোনো আমন্ত্রণ জানানো হয়নি
** অধ্যাদেশ সংযোজন-বিয়োজন নয়-সরাসরি বাতিল চেয়েছেন কর্মকর্তা-কর্মচারী
** প্রধান উপদেষ্টা যদি আমাদের সঙ্গে বসতে চান, তাহলে ঐক্য পরিষদ থেকে একটি প্রতিনিধি দল যাবেন
** আন্দোলনের ফলে করদাতা ও সেবাপ্রার্থীদের ভোগান্তির জন্য ঐক্য পরিষদের দু:খ প্রকাশ
** সোমবার সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে কলম বিরতি চলবে
এনবিআর বিলুপ্তির অধ্যাদেশ সংশোধন নয়, বাতিল চেয়েছেন এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। আর বাতিল না করার আগ পর্যন্ত কোন আলোচনায় বসতে রাজি নয় তারা। তবে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কলম বিরতি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। রোববার (১৮ মে) আগারগাঁও এনবিআরের নিচে সংবাদ সম্মেলনে ঐক্য পরিষদের কর্মকর্তারা এই ঘোষণা দিয়েছেন। ঘোষণা অনুযায়ী আগামীকাল সোমবার সকাল ৯টা থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্ত ৬ ঘণ্টা এনবিআর ও এনবিআরের অধীনস্থ কাস্টম হাউস, শুল্ক স্টেশন, ভ্যাট কমিশনারেট ও কর অঞ্চলগুলো বিরতিহীনভাবে কলম বিরতি চলবে।
এর আগে রোববার একইভাবে সারাদেশে কলম বিরতি পালিত হয়েছে। কলম বিরতি শেষে পূর্ব নির্ধারিত ঘোষণা অনুযায়ী নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। তবে রোববার দুপুরে এনবিআরের জনসংযোগ কর্মকর্তা আল আমিন শেখ জানিয়েছেন, অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আন্দোলনকারী এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে আলোচনা করতে রাজি হয়েছেন। মঙ্গলবার (২০ মে) বিকেল সাড়ে তিনটায় অর্থ মন্ত্রণালয়ে আলোচনায় বসবেন। তবে ক’জন আলোচনায় অংশ নেবেন, আন্দোলনকারীদের জানানো হয়েছে কিনা-তার কিছুই উল্লেখ করা হয়নি।
ঐক্য পরিষদের সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত কর কমিশনার সেহেলা সিদ্দিকী বলেন, এনবিআর বিলুপ্ত করে প্রণীত রাজস্ব অধ্যাদেশ বাতিল এবং টেকসই রাজস্ব সংস্কারের দাবিতে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ডাকে রোববার সকাল ৯ টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত ছয় ঘন্টা কাস্টমস, ভ্যাট ও ট্যাক্স বিভাগের বিভিন্ন দপ্তরে এবং এনবিআরে স্বতস্ফূর্তভাবে কলম বিরতি পালন করা হয়। এতে সকল স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অংশগ্রহণ করেন। দেশের স্বার্থে রাজস্ব ব্যবস্থার যুগোপযোগী ও টেকসই সংস্কারের কেবল এনবিআরের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাবি নয়; বরং করদাতা সমাজ, ব্যবসায়ী সমাজ, সিভিল সোসাইটিসহ সকল অংশীজনের দাবি। গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনদের মতামত গ্রহণ না করে, সরকার কর্তৃক গঠিত সংস্কার কমিটির সুপারিশ প্রকাশ না করে এবং তা আলোচনা-পর্যালোচনার সুযোগ না দিয়ে, সবাইকে অন্ধকারে রেখে নজিরবিহীন দ্রুততা ও গোপনীয়তার সাথে অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। অংশীজনদের মতামত গ্রহণ না করে এক তরফাভাবে গৃহীত এই সংস্কারের উদ্দেশ্য ও কার্যকারিতা নিয়ে ইতোমধ্যে রাজনৈতিক নেতারা ব্যবসায়ী মহল, পলিসি থিংক-ট্যাংকসহ বিভিন্ন মহল প্রশ্ন তুলেছেন।
সেহেলা বলেন, রাজস্ব ব্যবস্থা সংস্কারের নামে অর্ধশত বছরের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান এনবিআরকে বিলুপ্ত করে দেওয়া হয়েছে কোনো কারণ ছাড়াই। যেখানে দেশের রাজস্ব এজেন্সিকে সংস্কারের মাধ্যমে শক্তিশালী করা প্রয়োজন। সেখানে এটিকে বিলুপ্ত করে রাজস্ব কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে দুটি বিভাগ সৃষ্টি করা হচ্ছে; যা রাজস্ব ব্যবস্থাপনার আন্তর্জাতিক রীতিনীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এই অধ্যাদেশের বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর মতামতে বলা হয়েছে, রাজস্ব ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার নামে যে বিকেন্দ্রীকরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সেই প্রক্রিয়াটিই স্বচ্ছ কি-না, এমন প্রশ্ন ওঠাও অমূলক নয়। আরো বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক উন্নত চর্চা অনুযায়ী, একটি দেশের রাজস্ব নীতি প্রণয়ন ও ব্যবস্থাপনার জন্য আইনি সুরক্ষা নিশ্চিতপূর্বক স্বতন্ত্র সংস্থা, বোর্ড বা এজেন্সি করা প্রয়োজন, যাতে তা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রভাবের আওতামুক্ত থাকে। অথচ দেশের রাজস্ব ব্যবস্থাকে নির্বাহী বিভাগের অধীনস্ত দুটি বিভাগে পরিণত করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ ও মতামতের জন্য আমরা টিআইবিকে ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানানো হয়।
এই কর্মকর্তা বলেন, এনবিআর বিলুপ্ত নয়, বরং এনবিআরকে স্বতন্ত্র ও শক্তিশালী এজেন্সি হিসেবে রেখেই রাজস্ব সংস্কার করতে হবে। এনবিআরে গত ৪৫ বছর ধরে ফুলটাইম চেয়ারম্যান নেই। অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের যিনি সচিব তিনি সচিবালয়ে দায়িত্বের পাশাপাশি এনবিআরের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। যদিও এই দুইটা ভিন্ন পদ সম্পূর্ন ভিন্ন পোর্টফোলিও। এই সচিবরা ভিন্ন ক্যাডার থেকে আসা, যাদের আয়কর, ভ্যাট এবং কাস্টমসসহ অন্যান্য রাজস্ব আইন ও পদ্ধতি অভিজ্ঞতা এবং পেশাগত জ্ঞান থাকে না; যা এনবিআরের কাজকর্মকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে।
আন্দোলনের কারণে করদাতা ও সেবাপ্রার্থীদের ভোগান্তির কারণে সংগঠনের পক্ষ থেকে দু:খ প্রকাশ করা হয়। সংগঠনের পক্ষ থেকে উপ কমিশনার সানজিদা খানম বলেন, আমরা সবসময়ই বলে আসছি যে আমরা সকলেই সংস্কারের পক্ষে। রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনার পৃথকীকরণ রাজস্ব ব্যবস্থার পূর্নাঙ্গ সংস্কারের জন্য আমরা বন্ধপরিকর। আমরা বলছি, এই সংস্কার হতে হবে বাস্তবমুখী, অংশীজনের মতামতভিত্তিক এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার সর্বোচ্চ মূল্যায়নের মাধ্যমে করদাতা ও সেবাপ্রার্থীদের এই আন্দোলনকে সাময়িক অসুবিধার জন্য ঐক্য পরিষদ আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছে। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ মনে করে তাদের এই সাময়িক ত্যাগ দেশ ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে ও রাজস্ব ব্যবস্থার টেকসই সংস্কারে সক্রিয় ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি, আমরা এটাও জানিয়ে রাখতে চাই, আমাদের দাবি আদায় হলে আমরা নির্ধারিত অফিস সময়ের বাইরে অতিরিক্ত সময়ে কাজ করে অনিষ্পন্ন কার্যক্রম সম্পন্ন করব।
অপরদিকে, এনবিআর বিলুপ্তির অধ্যাদেশ বাতিলের বিষয়ে উচ্চ আদালতে এক আইনজীবী শনিবার রিট করেছেন। এই রিটের সঙ্গে ঐক্য পরিষদের কোন সম্পর্ক নেই জানিয়ে সানজিদা খানম বলেন, প্রণীত রাজস্ব অধ্যাদেশ বিষয়ে যে রিট হয়েছে, এর সাথে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। তবে, এই রিটের অগ্রগতি বিষয়ে ঐক্য পরিষদ নজর রাখছে। আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে আন্দোলনকে এ পর্যায়ে নিয়ে আসায় এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ, বাংলাদেশ কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট এগজিকিউটিভ অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাকায়েভ), মিনিস্টেরিয়াল অ্যাসোসিয়েশন (বাকাএম), বাংলাদেশ কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট তৃতীয় শ্রেণি কর্মচারী সমিতি (বাকাস), বাংলাদেশ ট্যাকসেস ইন্সপেক্টরস অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ট্যাক্সেস এমপ্লয়ীজ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ট্যাক্সেস ১৭-২০ তম গ্রেড সরকারি কর্মচারী ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটি, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্মচারী কল্যাণ সমিতি, গাড়িচালক সমিতিসহ অন্যান্য সকল অংশীজন, সাংবাদিক, মিডিয়া, সুশীল সমাজসহ সকল স্টেকহোল্ডারদেরকে জানানো হয়েছে।
সানজিদা বলেন, আমরা মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পেরেছি যে, অর্থ উপদেষ্টা এনবিআর কর্মকর্তাদের সাথে আগামী মঙ্গলবার বিকাল সাড়ে ৩টায় আলোচনায় বসবেন। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে কোন সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব আমরা এখনও পর্যন্ত পাইনি। ফলে আমাদের কর্মসূচি আগামীকাল সোমবার একইভাবে ৯টা থেকে ৩টা পর্যন্ত চলবে।
অর্থ উপদেষ্টা যদি আলোচনার আমন্ত্রণ আসলে আপনারা বসতে রাজি কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে সানজিদা খানম বলেন, অর্থ উপদেষ্টার নির্দেশনায় যদি আমাদের বসতে হয়, তাহলে ঐক্য পরিষদের প্রতিনিধি থাকতে হবে। তবে শুধু অর্থ উপদেষ্টা থাকলে হবে না। অন্যান্য উপদেষ্টারাও আলোচনায় থাকতে হবে।
সংগঠনের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত কর কমিশনার সেহেলা সিদ্দিকী সাংবাদিকদের কাছে প্রশ্ন করে বলেন, আপনাদের কাছে কোনো তথ্য আছে কিনা যে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশক্রমে অর্থ উপদেষ্টা আমাদের সঙ্গে বসতে চাইছেন। আমরা অফিসিয়ালি কোনো তথ্য এখনো পাইনি। এনবিআর চেয়ারম্যান একাধিকবার অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে বসেছেন। কিন্তু আমরা তাতে সন্তুষ্ট নই। তবে প্রধান উপদেষ্টা যদি আমাদের সঙ্গে বসতে চান, তাহলে ঐক্য পরিষদ থেকে একটি প্রতিনিধি দল যাবেন।
আপনারা অধ্যাদেশ বাতিল চান-নাকি সংযোজন-বিয়োজন হলেও আলোচনায় বসবেন-এমন প্রশ্নের জবাবে সেহেলা সিদ্দিকী বলেন, অধ্যাদেশ সংযোজন-বিয়োজনে আমাদের কোনো উপায় নেই। আমরা কোন সংশোধন বা সংযোজন চাই না। সরাসরি বাতিল করতে হবে।
এনবিআর বিলুপ্ত করে দুইটি স্বতন্ত্র বিভাগ চান কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে অতিরিক্ত কর কমিশনার মোনালিসা শাহরীন সুস্মিতা বলেন, মিডিয়ার মাধ্যমে হলেও সরকার আমাদের সঙ্গে কথা বললেও হবে-সংগঠন থেকে এমন ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আমরা মিডিয়ায় দেখেছি, অর্থ উপদেষ্টা আমাদের সঙ্গে বসতে চান। আন অফিসিয়ালি আমরা শুনেছি, কিন্তু অফিসিয়ালি আমরা এখনো কিছু পাইনি। সেজন্য আমরা কনফিউজ যে, অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে আর কেউ আছে কিনা, এই বসা প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশক্রমে কিনা-এসব সুস্পষ্টভাবে যদি ঘোষণায় এসে যায় তাহলে আমরা সকলে ঐক্য পরিষদে বসে সিদ্ধান্ত নেবো।
**এনবিআর বিলুপ্ত: অধ্যাদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট
**এনবিআর সংস্কার: আলোচনায় রাজি অর্থ উপদেষ্টা
**রোববার ৬ ঘণ্টা কলম বিরতি, আলোচনায় রাজি
**তিন ঘণ্টার কলম বিরতি, স্থবির রাজস্ব কার্যক্রম
**‘পরিকল্পনা ছাড়া এনবিআর ভাঙা অস্থিরতা তৈরি করেছে’
**এনবিআর অচলাবস্থা, সমাধানে সরকারের তৎপরতা
**কর-কাস্টমস ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনে গণপদত্যাগ
**কোন আন্তর্জাতিক মডেলে এনবিআর সংস্কার?