** ১৮ বছরের নিরীক্ষা একসঙ্গে করা হয়েছে, প্রতিবছর কেন নিরীক্ষা হয়নি, দুর্বলতা ছিল বন্ডের
** কোরিয়ার দূতাবাসের মাধ্যমে বকেয়া আদায়ে মালিকদের কাছে চিঠি পাঠাতে বন্ডের অনুরোধ
** ১৭৯ কোটি টাকা আদায়ে প্রতিষ্ঠানের আমদানি-রপ্তানি, উৎপাদন-বাজারজাতকরণ সবই বন্ধ করা হয়েছে
শতভাগ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি ইপিজেডের শতভাগ বিদেশি মালিকানাধীন। বন্ড সুবিধায় শত শত কোটি টাকার কাঁচামাল আমদানি হয়েছে। তবে সেই কাঁচামালের হদিস নেই। বছরের পর বছর প্রতিষ্ঠান নিরীক্ষা করা হয়নি। যদিও বন্ড প্রতিষ্ঠান প্রতিবছর নিরীক্ষা করার বিধান রয়েছে। প্রতিষ্ঠান যে কাঁচামাল আমদানি করেছে, তাতে শুল্ককর বকেয়া প্রায় ৪২২ কোটি টাকা। এই কাঁচামাল দিয়ে পণ্য তৈরি করে রপ্তানি হয়েছে কি না, তার কোনো সুর্নিদিষ্ট প্রমাণ নেই। শুল্ককর না দিয়ে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে মালিকরা নির্বিঘ্নে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর বন্ড কমিশনারেটের হুঁশ ফিরিছে। এখন প্রতিষ্ঠানের মালিকদের কাছ থেকে সেই টাকা আদায়ে দূতাবাসের মাধ্যমে উদ্যোগ নিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) অনুরোধ করেছে চট্টগ্রাম কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট। সম্প্রতি কমিশনারেট থেকে এনবিআরকে এ-সংক্রান্ত চিঠি দেয়া হয়েছে। বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করা প্রতিষ্ঠানটি হলো চট্টগ্রাম ইপিজেডের শতভাগ বিদেশি মালিকানাধীন নর্থপোল (বিডি) লিমিটেড।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইপিজেডে বিদেশি মালিকানাধীন ও দেশের অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ড সুবিধায় কাঁচামাল আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান পণ্য রপ্তানি করে টাকা পাচার করে দেয়। এক্ষেত্রে শুল্ককর পরিশোধ করা হয় না। বন্ড কমিশনারেট যে সময় শুল্ককর আদায়ের উদ্যোগ নেয়, ততক্ষণে প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব থাকে না। মালিক বিদেশে পালিয়ে যায়। ব্যাংকঋণ নিতে যে রকম সিকিউরিটি নেয়া হয়, বন্ড সুবিধা দেয়ার ক্ষেত্রেও একই ধরনের উদ্যোগ এনবিআর নিতে পারে। এতে শুল্ককর ফাঁকি রোধ হবে।
চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেট সূত্রমতে, সিইপিজেডের শতভাগ দক্ষিণ কোরিয়ার বিনিয়োগকারীদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান নর্থপোল (বিডি) লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি এ ক্যাটেগরির রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ২০০০ সালে বন্ড লাইসেন্স পায়। বন্ড সুবিধায় কাঁচামাল আমদানি করে পণ্য রপ্তানি করে। কিন্তু কয়েক বছর ধরে প্রতিষ্ঠানের আমদানি-রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। তবে প্রতিষ্ঠান কখনও নিরীক্ষা করা হয়নি। যদিও এনবিআরের আদেশ অনুযায়ী, বন্ডেড প্রতিষ্ঠানকে প্রতিবছর নিরীক্ষা সম্পন্ন করতে হয়। নিরীক্ষা না করলে বা শর্ত ভঙ্গ করলে লাইসেন্স স্থগিত করার বিধান রয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি নিরীক্ষা না করলেও লাইসেন্স স্থগিত করা হয়নি। তবে প্রতিষ্ঠানটির নিরীক্ষা না হওয়ার পেছনে ওই সময়ের বন্ড কর্মকর্তাদের দুর্বলতা ছিল বলে মনে করেন একাধিক বন্ড কর্মকর্তা।
সূত্র আরও জানায়, নিরীক্ষা সম্পাদনের জন্য ২০০৩ সালের ১৪ অক্টোবর কমিশনারেট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটি দুই বছর পর ২০০৫ সালের ৪ অক্টোবর প্রাথমিক প্রতিবেদন ও ১৮ অক্টোবর চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। তত দিনে প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি বন্ড সুবিধায় যে কাঁচামাল আমদানি করেছে, তা দিয়ে কোনো পণ্য উৎপাদন করেনি। সেই কাঁচামালের হদিসও পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, কাঁচামাল খোলাবাজারে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে বা কাঁচামাল নষ্ট হয়েছে। আমদানি করা এই কাঁচামালের ওপর প্রযোজ্য শুল্ককর ১৭৯ কোটি ৫৫ লাখ ৯৬ হাজার ৬২৫ টাকা। এই শুল্ককর ফাঁকির অভিযোগে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। একইসঙ্গে দাবিনামা-সংবলিত কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করা হয়। প্রতিষ্ঠান ফাঁকি দেয়া শুল্ককর পরিশোধ না করে কারণ দর্শানো নোটিশকে তর্কিত করে ২০০৭ সালের ২৭ আগস্ট উচ্চ আদালতে রিট করে। রিটে সরকারের পক্ষে রায় আসে। অর্থাৎ ফাঁকি প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে এই রাজস্ব আদায়ে প্রতিষ্ঠানকে বহুবার চিঠি দেয়া হলেও তা পরিশোধ করেনি। এই রাজস্ব আদায়ে ১৭ বছর পর ২০২৪ সালের ৫ মার্চ এই প্রতিষ্ঠানের আমদানি-রপ্তানি, পণ্য উৎপাদন-বাজারজাতসহ সব ধরনের লেনদেন স্থগিত করে।
কমিশনারেট সূত্রমতে, প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন বন্ধ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক কিউং সিক কিম এবং সাত পরিচালকসহ সবাই দেশ ছেড়ে কোরিয়া চলে গেছেন। প্রতিষ্ঠানের শিল্প প্লটের ভাড়া, বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস বিল পরিশোধ করা হয়নি। ফলে প্রতিষ্ঠানটি নিলাম করার উদ্যোগ নেয় বেপজা। শুল্ককর দায়-দেনার বিষয় জানতে বেপজা থেকে বন্ড কমিশনারেটকে চিঠি দেয়া হয়। কমিশনারেট নিরীক্ষা নর্থপোলের ২০০৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৮ বছরের নিরীক্ষা করতে ২০২১ সালের ২৯ ডিসেম্বর পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করে। কমিটি প্রতিষ্ঠানের আমদানি করা কাঁচামাল, ব্যাংকের তথ্য ও কমিশনারেটে থাকা তথ্য পর্যালোচনা করে ২৪২ কোটি ৫৯ লাখ ৬১ হাজার ৩০ টাকা শুল্ককর ফাঁকি উদ্ঘাটন করে, যার মধ্যে রয়েছে প্রায় ৭ দশমিক ১৯ লাখ টাকা, ২৪ দশমিক ৬৪ কোটি টাকা, ৯ দশমিক ১০ কোটি টাকা, ১৬ দশমিক ৩১ লাখ টাকা, দুই কোটি টাকা, ১৩৫ দশমিক ৯২ কোটি টাকা, ৭০ দশমিক ৬৬ কোটি টাকা। ফাঁকি দেয়া এই রাজস্ব আদায়ে সাতটি দাবিনামা জারি করা হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কোনো জবাব দেয়া হয়নি এবং বকেয়া পরিশোধ করা হয়নি।
এনবিআর সূত্রমতে, প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। কাঁচামালের হদিস নেই। প্রতিষ্ঠানের মালিকরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব বিলীন। তবুও প্রতিষ্ঠান থেকে শুল্ককর আদায়ে বারবার প্রতিষ্ঠানের ঠিকানায় চিঠি দিয়েছে কমিশনারেট, কিন্তু চিঠি ফেরত এসেছে। আমদানি-রপ্তানি স্থগিত করেছে, অথচ প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নেই। প্রতিষ্ঠানের মালিকরা দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার প্রায় ১৬ বছর পর প্রতিষ্ঠানের মালিকদের কাছ থেকে প্রায় ৪২২ কোটি টাকার বকেয়া রাজস্ব আদায়ে উদ্যোগ নিতে এনবিআরকে কমিশনারেট থেকে চিঠি দেয়া হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং পরিচালকদের কাছ থেকে বকেয়া রাজস্ব আদায়ে জারি করা দাবিনামা ও বিচারাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে মালিকদের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করা হয়েছে।
এই বিষয়ে এনবিআরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শতভাগ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান হলে বন্ড কমিশনারেটের দুর্বলতা ছিল, নাহলে প্রতিষ্ঠানকে কেন প্রতিবছর নিরীক্ষা করা হয়নি। নিরীক্ষা করা হলে ফাঁকি উদ্ঘাটিত হতো। প্রতিষ্ঠান যখন বন্ধ হয়ে গেল, মালিক পালিয়ে গেল, তখন নিরীক্ষা করে কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করে লাভ কী? তিনি বলেন, ব্যাংকে ঋণ নিতে গেলে মরগেজ দিতে হয়, সিকিউরিটি রাখতে হয়। প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলে অন্তত সম্পদ বিক্রি করে টাকা তোলা যায়। কিন্তু রপ্তানিকে উৎসাহিত করতে বন্ড লাইসেন্স দেয়া হয়। এতে কোনো জামানত নেই, ইচ্ছামতো আমদানি-রপ্তানি করে। সুযোগ বুঝে আমদানি বা রপ্তানির আড়ালে পাচার করে। শুল্ককর পরিশোধ না করেই প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে বা পালিয়ে যায়। বন্ড প্রতিষ্ঠানের শুল্ককর ফাঁকি রোধে বন্ড লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে এনবিআরের পদক্ষেপ নেয়া উচিত। শুধু নর্থপোল নয়, ইপিজেডগুলোর এমন বহু প্রতিষ্ঠান এবং অন্য অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠানের মালিকরা একইভাবে কোটি কোটি টাকার শুল্ককর পরিশোধ না করেই প্রতিষ্ঠান বন্ধ করেছেন, কেউ কেউ পালিয়ে গেছেন। প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব না থাকলেও শুল্ককর কীভাবে আদায় হবে?