** তাঁতি সমিতির সদস্যরা ‘সিপিসি’ সুবিধার শর্ত ভঙ্গ করে রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছেন প্রায় ২৪ কোটি টাকা
** বন্ড সুবিধার শর্ত ভঙ্গ করে নামমাত্র এসব তাঁত প্রতিষ্ঠান শুল্ককর ফাঁকি দিয়েছে প্রায় ৩৯ কোটি টাকা
গরিব তাঁতিদের সুরক্ষায় সরকার সুতা, রং ও রাসায়নিক আমদানির সুযোগ দিচ্ছে। কিন্তু বন্ড ও রেয়াতি সুবিধায় আমদানি করা এসব কাঁচামাল প্রকৃত তাঁতিরা পায় না বলে অভিযোগ রয়েছে। তাঁতি সমিতি নাম দিয়ে একটি চক্র এসব কাঁচামাল আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। রাজস্ব ফাঁকি দেয়া এসব সুতা, রং ও রাসায়নিক বাজার সয়লাব হওয়ায় দেশীয় সুতা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। অনুসন্ধানে ৪১টি নামমাত্র তাঁতি সমিতির বন্ড ও রেয়াতি সুবিধার অপব্যবহারের তথ্য পেয়েছে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। এসব সমিতি রেয়াতি (সিপিসি) ও শুল্ককর (বন্ড) ফাঁকি দিয়েছে প্রায় ৬৩ কোটি ১৪ লাখ টাকা। অনুসন্ধান শেষে সম্প্রতি এনবিআরকে এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। তাঁতি সমিতির নামে কাঁচামাল আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি রোধে প্রতিবেদনে কয়েকটি সুপারিশ করা হয়েছে। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্রমতে, ‘সিপিসি’ ও ‘বন্ড সুবিধায়’ তাঁতি সমিতির আমদানি করা সুতায় বাজার সয়লাব—এমন অভিযোগের ভিত্তিতে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে। অনুসন্ধানে নেমে এর সত্যতা পাওয়া যায়। অনুসন্ধানে তাঁতি সমিতির সদস্যদের ‘সিপিসি’ সুবিধার শর্ত ভঙ্গ করায় রাজস্ব ফাঁকি পেয়েছে প্রায় ২৪ কোটি টাকা। এছাড়া বন্ড সুবিধার শর্ত ভঙ্গ করায় শুল্ককর ফাঁকি পেয়েছে প্রায় ৩৯ কোটি টাকা। প্রতিবেদনে সমিতির সদস্যদের কাছ থেকে ফাঁকি দেয়া এ রাজস্ব আদায়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসকে নির্দেশনা দিতে এনবিআরকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড থেকে প্রতিটি তাঁতি সমিতির অনুকূলে তাঁতির সংখ্যা, চালু তাঁতের সংখ্যা বিবেচনা করে ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মোট ৫১টি সমিতিকে ২০১৫ সালে একটি আদেশের অধীনে সিপিসি ২২৩-এর রেয়াতি সুবিধায় রং, রাসায়নিক ও সুতা আমদানির সুপারিশ করা হয়। তবে তাঁতি সমিতিকে কাস্টমস গোয়েন্দা শুনানিতে ডাকা হলে তারা প্রত্যেকেই অপব্যবহার ও শুল্ককর ফাঁকির বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তারা বলেছেন, সুপারিশ করা সমিতিগুলোকে নিয়ে একটি কুচক্রী মহল তাঁতিদের হয়রানি করছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। আবার অনুসন্ধানকারী দলের সদস্যরা সরেজমিন গেলে তাঁতিরা জানিয়েছেন, বেশিরভাগ কাঁচামাল তারা স্থানীয় বাজার থেকে সংগ্রহ করেন। মাঝে মধ্যে তাঁতি সমিতি থেকে সংগ্রহ করেন। তবে কোনো কাগজপত্র ছাড়াই। অর্থাৎ আমদানি করা কাঁচামাল বেশিরভাগ তাঁতি পান না।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৪১টি তাঁতি সমিতি সিপিসি ২২৩-এর রেয়াতি সুবিধায় ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আমদানি করা কাঁচামালে প্রায় ২৪ কোটি টাকার শুল্ককর ফাঁকি দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে—১১ নং কাট্টলী ইউনিয়ন প্রাথমিক তাঁতি সমিতি প্রায় ৬৩ লাখ টাকা; দেলদুয়ার ইউনিয়ন প্রাথমিক তাঁতি প্রায় ৮৫ লাখ টাকা; পাথহার আলী ১নং ওয়ার্ড প্রাথমিক তাঁতি প্রায় ৩১ লাখ টাকা; হোগরা ইউনিয়ন প্রাথমিক তাঁতি সমিতি প্রায় ৮৪ লাখ টাকা; পোড়াবাড়ী ইউনিয়ন প্রাথমিক তাঁতি প্রায় সাড়ে ৩ লাখ টাকা; মেহেরপাড়া ইউনিয়ন ১নং ওয়ার্ড প্রায় ৩১ লাখ টাকা; আমদিয়া ইউনিয়ন ২নং ওয়ার্ড প্রাথমিক প্রায় ৯৪ লাখ টাকা; ৯নং কালিয়া হরিপুর ইউনিয়ন ১নং ওয়ার্ড প্রায় ২৬ লাখ টাকা; পাইকাসা প্রাথমিক তাঁতি সমিতি প্রায় ২৬ লাখ টাকা; মেসার্স সায়েদাবাদ ২নং ওয়ার্ড প্রাথমিক প্রায় ৮৮ লাখ টাকা; বেলকুচি পৌরসভা ৬নং ওয়ার্ড প্রায় ৬ লাখ টাকা; সায়েদাবাদ ইউনিয়ন ৮নং ওয়ার্ড নিউ প্রায় ৬৯ লাখ টাকা; বহুলি ইউনিয়ন ১নং ওয়ার্ড প্রায় ১৭ লাখ টাকা; ফতেপুর ইউনিয়ন ৩নং ওয়ার্ড প্রাথমিক প্রায় ১৯ লাখ টাকা; সাদিপুর ইউনিয়ন ১নং ওয়ার্ড প্রাথমিক প্রায় ১৯ লাখ টাকা; সাদিপুর ইউনিয়ন ২নং ওয়ার্ড প্রাথমিক প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকা; জামপুর ইউনিয়ন ২নং ওয়ার্ড প্রাথমিক প্রায় ২৬ লাখ টাকা; দুর্গানগর ইউনিয়ন ২নং ওয়ার্ড প্রায় এক কোটি ৮৫ লাখ টাকা; দুর্গাপুর ইউনিয়ন ৩নং ওয়ার্ড প্রাথমিক প্রায় ৩ কোটি টাকা; দৌলতপুর ইউনিয়ন ২নং ওয়ার্ড প্রায় ২ কোটি ৪১ লাখ টাকা; দৌলতপুর ইউনিয়ন ৩নং ওয়ার্ড প্রায় ৭৭ লাখ টাকা; রাজাপুর ইউনিয়ন ১নং ওয়ার্ড প্রাথমিক প্রায় পৌনে দুই লাখ টাকা; বেলকুচি ইউনিয়ন ৩নং ওয়ার্ড প্রায় ৭১ লাখ টাকা; বেলকুচি পৌরসভা ৭নং ওয়ার্ড ৬৮ লাখ টাকা; দৌলতপুর ইউনিয়ন ১নং ওয়ার্ড ২ কোটি ৯৬ লাখ টাকা; বেলকুচি পৌরসভা ৩নং ওয়ার্ড প্রায় ১ কোটি ৩১ লাখ টাকা; বাঘাবাড়ী ইউনিয়ন ৩নং ওয়ার্ড প্রায় ১ কোটি ৫৯ লাখ টাকা; রাজাপুর ইউনিয়ন ২নং ওয়ার্ড প্রাথমিক প্রায় ৫০ লাখ টাকা; ভানগাবাড়ী ইউনিয়ন ৮নং ওয়ার্ড প্রায় ১ কোটি ৪১ লাখ টাকা; ভোলা ইউনিয়ন ২নং ওয়ার্ড প্রাথমিক প্রায় ৮৩ হাজার টাকা; ভোলা ইউনিয়ন ১নং ওয়ার্ড প্রাথমিক প্রায় ১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা; নাগবাড়ী ইউনিয়ন ৩নং ওয়ার্ড প্রাথমিক প্রায় ১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা; হাবিবুল্লাহ নগর ইউনিয়ন ২নং ওয়ার্ড প্রায় ৯৬ লাখ টাকা; কইজুরি ইউনিয়ন ৩নং ওয়ার্ড প্রাথমিক প্রায় ১৫ লাখ টাকা; শাহজাদপুর পৌরসভা ৪নং ওয়ার্ড প্রায় ১ কোটি টাকা; খুকাই ১নং ওয়ার্ড প্রাথমিক তাঁতি প্রায় ৪২ লাখ টাকা; মেসার্স হাবিবুল্লাহ নগর ইউনিয়ন ১নং প্রায় ৬০ লাখ টাকা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৪১টি তাঁতি সমিতি এসআরও’র অধীন সিপিসি ২২৩-এর রেয়াতি সুবিধায় আমদানির ফলে প্রায় ৩৯ কোটি ১০ লাখ ২৭ হাজার ১৬৩ টাকার শুল্ককর ফাঁকি দিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের আমদানি করা কাঁচামালের চালান তাঁতিদের মধ্যে বণ্টন ভ্যাট অফিস যাচাই করে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসকে প্রতিবেদন দেয়নি। ফাঁকি দেয়া এই শুল্ক তাঁতি সমিতির সদস্যদের থেকে আদায় করতে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসকে নির্দেশনা দেয়ার অনুরোধ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। একইসঙ্গে যে ৩৩টি তাঁতি সমিতি বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড থেকে বরাদ্দের অতিরিক্ত মূল্যের কাঁচামাল আমদানি করে সিপিসি সুবিধার অপব্যবহার করেছে, সেই ২৪ কোটি ৩ লাখ ৮৫ হাজার ৬৫২ টাকা আদায়েও কাস্টম হাউসকে এনবিআর থেকে নির্দেশনা দিতে প্রতিবেদনে অনুরোধ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও দুটি সুপারিশ করা হয়েছে। তাহলো—তাঁতি সমিতি এই অব্যাহতি সুবিধায় কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে এসআরও’র ৫নং শর্ত সঠিকভাবে পালন করছে কি না—তা কাস্টম হাউসকে কঠোরভাবে মনিটরিং এবং প্রতিষ্ঠানের আমদানি করা কাঁচামাল ভ্যাট অফিস যাচাই করে কাস্টম হাউসকে প্রতিবেদন দেয়ার বিষয়েও এনবিআর থেকে নির্দেশনা দিতে অনুরোধ করা হয়েছে।
অপরদিকে, তাঁত শিল্পে ব্যবহারের জন্য সুতা ও কেমিক্যাল ছয়টি শর্তে শুল্ককর অব্যাহতি দিয়ে ২০১৫ সালের ৪ জুন এনবিআর আদেশ (এসআরও) জারি করে। তাতে সাতটি এইচএস কোডের অধীনে নয় ধরনের কেমিক্যাল ও সুতা আমদানিতে এই অব্যাহতি সুবিধা দেয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে—কস্টিক সোডা, সোডিয়াম সালফাইড, হাইড্রস, গ্লুবার সল্ট, সোডা অ্যাঁশ, বেসিক ডাই, ভ্যাট ডাই, পলিয়েস্টার ইয়ার্ন। শর্তের মধ্যে রয়েছে—এসব কেমিক্যাল ও সুতা বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড কর্তৃক নিবন্ধিত তাঁতি সমিতি কর্তৃক কেবল তাঁত শিল্পে ব্যবহারের জন্য আমদানি করতে হবে; শুধু নিবন্ধিত তাঁত শিল্পে ব্যবহার হবে—আমদানিকারককে ৩ টাকা নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে অঙ্গীকারনামা কাস্টম হাউসে দাখিল করতে হবে; সদস্যরা যে কাঁচামাল আমদানি করবেন—তা প্রয়োজন অনুযায়ী তাঁত বোর্ড অনুমোদন দেবে; আমদানি করা কাঁচামাল কীভাবে সদস্যদের মধ্যে বণ্টন করা হবে, তা বোর্ড আগেই স্থানীয় ভ্যাট অফিসকে জানাবে; আমদানি করা কাঁচামাল ব্যবহার হয়েছে কি না—তা যাচাই করে ভ্যাট অফিস কাস্টম হাউসকে প্রতিবেদন দেবে এবং যদি যাচাইয়ে দেখা যায়, কাঁচামাল ব্যবহার হয়নি, তাহলে প্রতিষ্ঠানকে শুল্ককর, জরিমানা দিতে হবে।
অনুসন্ধান দলের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রকৃত তাঁতি সরকারের দেয়া সুবিধা পায় না বললেই চলে। কয়েকটি চক্র তাঁত বোর্ডের সঙ্গে আঁতাত করে এসব কাঁচামাল আমদানি করে বাজারে বিক্রি করে দেয়। কাস্টম হাউস ও ভ্যাট কমিশনারেট সঠিকভাবে তদারকি করলে অপব্যবহার কমে আসবে।
নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম কাস্টমস গোয়েন্দার প্রতিবেদন বিষয়ে বলেন, কাস্টমস গোয়েন্দা যে প্রতিবেদন দিয়েছে, তা যে সঠিক আমি বলতে পারব না। কারণ অতীতে তাদের অনেক তদন্ত দেখা গেছে যে সঠিক না। সঠিক জিনিস তারা তুলে আনতে পারেনি। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ১০টি গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানের স্যাম্পলের নামে ৩০০ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ করে মামলা করা হয়েছে। ১০টি গার্মেন্টস যে জড়িত নয়—তা শুল্ক গোয়েন্দার রিপোর্টে বলা হয়েছে। এরপরও তাদের দায়ী করে মামলা দিয়েছে। এটা তো অন্যায়। এজন্য তাঁতি সমিতি নিয়ে শুল্ক গোয়েন্দার রিপোর্ট আমাদের কাছে সঠিক মনে হয় না। হয়তো কোনোটা সঠিক থাকতেও পারে। এ ধরনের কেউ কিছু করে থাকলে সঠিক তদন্তের দাবি জানান তিনি। সত্যতা পাওয়া গেলে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হোক। শুল্ক গোয়েন্দার পাশাপাশি এফবিসিসিআই বা বিজিএমইএ, বিকেএমইএ’র একজন প্রতিনিধি নিয়ে যেন একটি তদন্ত কমিটি করা হয়। কমিটি প্রতিবেদন দিলে আমরা তা আমলে নিতে পারি।