Header – Before
Header – After

শিমের বাজার ১৭০ কোটি টাকার

আকলিমা বেগমের (৪০) একমাত্র সম্পত্তি ছিল বসতবাড়ির ৩ শতাংশ জমি। বাকপ্রতিবন্ধী স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে সংসারের সমস্ত দায়ভার ছিল তাঁর কাঁধে। ২০১৬ সালে তিনি লিজ নেন ১০ বিঘা জমি। সেখানে ধানের পাশাপাশি শুরু করেন মাছ চাষ। ঘেরের আইলে লাগান শিম—সেখান থেকেই ভাগ্য পরিবর্তনের সূচনা। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি তাঁকে। এখন পুরোদস্তুর চাষি আকলিমার শিমক্ষেত শুধু তাঁর নয়, অনেক মানুষের জীবিকারও প্রধান ভরসা।

খুলনার ডুমুরিয়ার খর্নিয়া ইউনিয়নের আঙ্গারদহ গ্রামের বাসিন্দা আকলিমা বেগম জানান, গত বছর এক বিঘা জমিতে শিম আবাদে তাঁর খরচ হয়েছিল তিন লাখ টাকা, আর লাভ হয়েছিল দুই লাখ টাকা। ২০১৬ সাল থেকে শিম চাষের আয় দিয়েই তিনি পাকা ঘর তুলেছেন। ঘরে এনেছেন আসবাবপত্র, কিনেছেন টিভি ও ফ্রিজ। পাশাপাশি করেছেন গরুর খামারও।

একসময় ডুমুরিয়ার বিস্তীর্ণ বিলজুড়ে হতো মাছ চাষ। কিন্তু সময়ের সঙ্গে পাল্টে গেছে স্থানীয়দের চিন্তাধারা। এখন চিংড়ি ঘেরের বেড়িবাঁধ, পরিত্যক্ত জমি কিংবা বেড়া ও মাচায় হচ্ছে শিম, লাউসহ নানা সবজির বাণিজ্যিক চাষ। এর মধ্যে শুধু শিমের আবাদই হচ্ছে উপজেলার অন্তত ২২৬ গ্রামে। এই ফসলকে ঘিরে বছরে প্রায় ১৭০ কোটি টাকার বাজার সৃষ্টি হয়েছে। সরাসরি চাষাবাদের সঙ্গে যুক্ত সহস্রাধিক নারী গ্রামীণ অর্থনীতিতে রাখছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

উপজেলা কৃষি অফিস সূত্র জানায়, ডুমুরিয়ায় গ্রীষ্মে শিমের আগাম জাতের চাষ হচ্ছে। এটি শেষ না হতেই শুরু হচ্ছে শীতকালীন আবাদ। গ্রীষ্মকালীন বারি-৩, বিস্কুট, আইরেট, এনএসসি, রূপসী বাংলা ও হাবিব জাতের শিম চাষ হচ্ছে। তবে এ অঞ্চলের কৃষকরা বেশি আবাদ করছেন বারি-৩ লাল ফুল জাতের শিম। কৃষি অফিসের তথ্যে, গত বছর ডুমুরিয়ায় দুই মৌসুম মিলে প্রায় ৮০০ হেক্টর জমিতে শিম চাষ হয়। এর মধ্যে গ্রীষ্মে ৩৮০ ও শীতে ৪২০ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়। হেক্টরপ্রতি আগাম জাতের ফসল ওঠে গড়ে ২০ টন। আর শীতে উৎপাদন হয় গড়ে ২৫ টন।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইনসাদ ইবনে আমিন জানান, গ্রীষ্মকালীন শিম জুন থেকে শুরু হয়ে চলে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। আগস্টের শুরুতে স্থানীয় বাজারে প্রতি কেজি শিম ২২০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। ধীরে ধীরে কমে হয় ১৩০ টাকা। চাষিরা আগাম জাতের কেজি গড়ে ১৪০ ও শীতকালীন শিমের দাম পান ৬০ টাকা। গত বছর গ্রীষ্মে ৩৮০ হেক্টর জমিতে শিমের উৎপাদন হয়েছে সাত হাজার ৬০০ টন। ১৪০ টাকা কেজি দরে ডুমুরিয়ার চাষিরা আগাম জাতের শিম বিক্রি করেছেন প্রায় ১০৭ কোটি টাকা। একইভাবে শীত মৌসুমে ৪২০ হেক্টর জমিতে শিমের আবাদ হয়। হেক্টরে ২৫ টন হিসাবে ফলন হয় ১০ হাজার ৫০০ টন। গড়ে ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে প্রায় ৬৩ কোটি টাকার শিম।

স্থানীয়দের মতে, ডুমুরিয়ার শোভনা গ্রাম ব্রিটিশ আমল থেকেই সবজি চাষের জন্য পরিচিত। গ্রামের প্রবীণ কৃষক পরিমল মণ্ডল জানান, তখন থেকেই কাপালি সম্প্রদায়ের মানুষ নিয়মিত সবজি চাষ করে আসছেন। আর নব্বইয়ের দশকে ডুমুরিয়ার বিস্তীর্ণ বিল এলাকায় বাণিজ্যিক মাছ চাষের জোয়ার দেখা দেয়।

দুই মৌসুমে শিম আবাদে নারীর সাফল্য

উপজেলার সদর, গুটুদিয়া, খর্নিয়া, ভান্ডারপাড়া, শোভনা, মাগুরখালী, সাহস, শরাফপুর, মাগুরাঘোনা, আটলিয়া, রংপুর, ধামালিয়া, রঘুনাথপুর ও রুদাঘরা ইউনিয়নের অন্তত ২২৬ গ্রামে শিমের আবাদ হচ্ছে। গ্রীষ্ম ও শীত—দুই মৌসুমেই এই ফসল চাষ করা হয়। বর্তমানে উপজেলায় দুই হাজার ২৮০ কৃষক শিম চাষে যুক্ত আছেন। তাদের মধ্যে ৯১০ জন নারী সরাসরি চাষাবাদে অংশ নিচ্ছেন। এছাড়া স্বামী ও সন্তানের সহযোগী হিসেবে আরও অনেকে শিম আবাদে শ্রম দিচ্ছেন।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার তথ্য অনুযায়ী, উপজেলায় বর্তমানে ৩১৫ হেক্টর জমিতে লাউ চাষ হচ্ছে। এ কাজে নারী-পুরুষ মিলে তিন হাজার ১৫০ জন কৃষক যুক্ত রয়েছেন। প্রতিবছর গড়ে সাত কোটি ৮৮ লাখ টাকার লাউ বিক্রি হয় এখানকার বাজারে।

জ্যেষ্ঠ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সোয়েল মো. জিল্লুর রহমান রিগান জানান, উপজেলায় বর্তমানে ১১ হাজার ১৪৬ হেক্টর জমিতে ১৮ হাজার ৭১২টি গলদা চিংড়ির ঘের রয়েছে। এ খাতে ২৩ হাজার ৭৬ জন মানুষ যুক্ত আছেন। প্রতিবছর এসব ঘেরে ছয় হাজার ৩৫৩ টন গলদা উৎপাদিত হয়, যার বাজারমূল্য প্রায় ৫৭৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা। অন্যদিকে, বাগদা চিংড়ির জন্য রয়েছে ছয় হাজার ৭৯২ হেক্টর জমিতে সাত হাজার ৮২১টি ঘের। এ খাতে যুক্ত আছেন সাত হাজার ৫১ জন চাষি। বছরে এখানে উৎপাদন হয় দুই হাজার ৬৫৩ টন বাগদা, যার বাজারমূল্য প্রায় ২৬৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা।

শিমকে কেন্দ্র করে ২৩টি বাজার সক্রিয়

ডুমুরিয়ার শিমের আবাদকে কেন্দ্র করে খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়ক এবং গ্রামীণ সড়ক সংলগ্ন এলাকায় অন্তত ২৩টি বড় বাজার গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে মহাসড়ক সংলগ্ন রয়েছে ছয়টি পাইকারি বাজার। এছাড়া উপজেলার মইখালী, খর্নিয়া, ঘোনাবান্দা, জাবড়া, বকুলতলা, উলা, আঠারো মাইল, শরাফপুর, আটলিয়া, রংপুর, বটতলা, হাজিবুনিয়া, রঘুনাথপুর, তেঁতুলিয়া, গুটুদিয়া ও শোভনা এলাকার গ্রামীণ সড়ক ধরে আরও ১৭টি বাজার গড়ে উঠেছে।

কৃষকরা জানান, তারা ক্ষেত থেকে শিম সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করেন। অনেক সময় ফড়িয়ারা সরাসরি ক্ষেত থেকে শিম কিনে নিয়ে যান। শিমের বাজার কেন্দ্র করে উপজেলায় অন্তত সাত হাজার মানুষের জীবিকা নির্বাহের পথ তৈরি হয়েছে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!