রাজস্ব কমিশন নয়, বিভাগ হবে

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সংস্কারে পরামর্শক কমিটির সদস্য ও সাবেক এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আব্দুল মজিদ বলেছেন, রাজস্ব খাতের নীতি প্রণয়নে রাজস্ব কমিশন নয়, বিভাগ হবে। শুল্ক-কর আদায়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও নীতি প্রণয়নে বিভাগ—দুটিই অর্থ মন্ত্রণালয়ের আওতায় থাকবে। এ ছাড়া রাজস্ব খাত ডিজিটালাইজেশন এবং শুল্ক, ভ্যাট ও কর—তিনটি আইন পর্যালোচনা করে হচ্ছে। এ বিষয়ে দুটি প্রতিবেদন দেওয়া হবে। সোমবার (২৭ জানুয়ারি) দুপুরে এনবিআরের গোলটেবিল আলোচনা সভায় তিনি এ অভিমত ব্যক্ত করেন। দ্য ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি) ও ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) যৌথভাবে এই গোলটেবিল আলোচনা সভার আয়োজন করেছেন।

আইসিএবি প্রেসিডেন্ট সিইও শুভাশিস বোসের সভাপতিত্বে সাবেক এনবিআর চেয়ারম্যান নাসিরউদ্দিন আহমেদ, সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান, গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ, আইসিএবি প্রেসিডেন্ট মারিয়া হাওলাদার, ইআরএফ সভাপতি দৌলত আক্তার মালা প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ বলেন, আমরা একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে একটা প্রাথমিক রিপোর্ট দেব। তার পর কোনো প্রশ্ন এলে আরেকটি রিপোর্ট দেব। এরইমধ্যে আমরা একটি অন্তর্বর্তীকালীন রিপোর্ট দিয়েছি। রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব প্রশাসন সংস্কারের উপরে। রাজস্ব প্রশাসনে সেপারেশন অব অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এর প্রস্তাব করেছি। দ্বিতীয় বিষয় হিসেবে আমরা ডিজিটাইজেশনকে বেছে নিয়েছি। এখানেও যদি আমরা ভালভাবে প্রস্তাব দিয়ে বাস্তবায়ন শুরু করে দিতে পারি তাহলে ৭০ শতাংশ সংস্কার হয়ে যাবে। বাকিটা হচ্ছে কোথায়, কিসে কী ট্যাক্স নেওয়া হয়। সেটা তো চলমান প্রক্রিয়া, প্রতিবছর বাজেটে হয়। অর্থবিলে আসে। এই বিষয়েও আমরা সংস্কার প্রস্তাব দেব। এনবিআরের আইনগুলো নিয়েও আমরা প্রস্তাব দেব।

তিনি বলেন, ‘এনবিআরকে শক্তিশালী করতে হবে। তাকে সেপারেট করতে হবে। তাকে স্বাধীন করতে হবে। তাকে তার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে হবে। এবং এই দায়িত্ব এনবিআর পালন করবে। সেজন্য ১৯৭২ সালের এনবিআরের যে আইনটা আছে সেটিকে সংস্কার করব। অর্থনৈতিক সম্পদ বিভাগের (আইআরডি) নাম পালটে রেভিনিউ ডিভিশন করা হবে। পলিসিগুলো সেখানেই যাবে। সেখানে জ্ঞানী লোক থাকতে হবে। এই বিষয়ে আমরা উপদেষ্টাকে বলেছি।’

১৫ দিন বা ১ মাস পরে সংবাদ সম্মেলন করে নিজেদের কার্যক্রমে বিষয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া উচিত বলেও মনে করেন সাবেক এই এনবিআর চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, সম্প্রতি যে প্রায় শতাধিক পণ্যে ভ্যাট বাড়ানো হলো তা আগেই ব্যাখ্যা করা উচিত ছিল। প্রতিটা জিনিস আলোচনা করে মানুষকে জানালে, জনগণের সঙ্গে এনবিআরের দূরত্ব কমবে।

এনবিআরকে বড় লক্ষ্যমাত্রা দেওয়ার যুক্তি হিসেবে তিনি বলেন, অর্থনীতি বড় হচ্ছে। কিন্তু আমরা তার সুবিধা নিতে পারছি না, বা আমরা কর দিচ্ছি না। সেজন্য লক্ষ্যমাত্রাটা পুশ ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করছে। সবার মধ্যে সমন্বিত যোগাযোগ প্রয়োজন। সামাজিক সচেতনতা না বাড়লে কর আদায় বাড়বে না। আপনার পাশের লোক কর দেয় না। তার করের চাপ আপনার উপর পড়ে। আপনি কিছু বলবেন না, হা হুতাশ করবেন এটা তো হয় না।

পরামর্শক কমিটির সদস্য আমিনুর রহমান বলেন, ‘আমরা ধনীদের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত কর আদায় করতে পারছি না। অথচ ধনীদের কাছে সম্পদ পুঞ্জীভূত হচ্ছে। এতে অপ্রদর্শিত অর্থনীতি বড় হচ্ছে এবং বিপুল অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে।’

এনবিআর সংস্কার কমিটির উদ্দেশ্যে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, এনবিআরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনতে হবে। এ বিষয়ে আপনাদের প্রস্তাব দিতে হবে। আমরা যে ইএফডি আনতে পারিনি। এটার জন্য কাকে দায়বদ্ধ করে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? এখানে কেউ না কেউ তো দায়বদ্ধ। চার্টাড অ্যাকাউন্টেট ভুল অডিট করলেও তাদের ও দায় নিতে হবে। এটা মানতে হবে, আমাদের দেশে ঠিকমত কর আদায় হয় না, কারণ কর ফাকিঁ হয়। এটা আমাদের স্বীকার করতে হবে। একটা ঘুষ প্রথা আছে যার মাধ্যমে মেইনটেইন করা হয়। কর কমালেও ফাঁকি কমবে না। ভ্যাটর হার ১৫ শতাংশ থেকে ১০ করলেও সবাই দেবে না। ১০ এর নিচে হলেও ওনারা (ব্যবসায়ীরা) দেবে না। সেখানে স্বচ্ছতা আনতে হবে। নাগরিকদের দায়বদ্ধতার মধ্যে আনতে হবে।
ICAB ERF
এখনো কর্পোরেট ট্যাক্স ফাইলিং আধুনিকায়ন হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, ডিভিএসের সঙ্গে মিলিয়ে এটি করা যেতে পারে। নিজেদের মধ্যেও তথ্য আদান-প্রদানে সমন্বয় নেই। বাড়ি ও সম্পদের মালিক কী পরিমাণ কর দিচ্ছে তা বের করার কোনো উপায় নেই। এই সংস্কারগুলো প্রয়োজন। এ তথ্যগুলো বের করা খুব বেশি কঠিন না। তথ্যের ডিজিটাইজেশন আপনারা আনেন। কী প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে ১০০টা পণ্যের দাম বাড়ানো হলো তা আমরা জানতে পারিনি। হয়তো নীতিনির্ধারকদের কাছে এই বার্তা ছিল যে এর ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে না। সেটি জনগণের কাছে পরিষ্কার করতে হবে। এনবিআরের কাছ থেকে তথ্য উপাত্ত পাওয়া খুবই কঠিন।

যদিও অর্থনীতিবিদ মাসরুর রিয়াজের মতে সংগৃহীত রাজস্ব ব্যবহারের পরিকল্পনা ও আর্থিক শৃঙ্খলা ঠিক না হলে এনবিআররের সংস্কার কাজে আসবে না। তিনি বলেন, কর আদায় হলেও তার ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ। রাজস্ব আদায়ে নানান সমস্যা আছে। এনবিআরের কর কর্মকর্তাদের বিবেচনামূলক দায়িত্ব, যৌক্তিক হারে কর আদায় ঠিক করতে হবে। ১৫ শতাংশের জায়গায় ১০ শতাংশ দিলেও কর দিতে চায় না। আরজিএসসি রেজিস্ট্রার্ড কোম্পানির ক্ষেত্রে মোট কর ৪৫-৪৬ শতাংশের কম কোথাও নেই। কাল একজন বললো তাকে ৮৩ শতাংশ কর দিতে হয়। অর্থাৎ ১০০ টাকায় ৮৩ টাকা দিতে হয়। এগুলো ঠিক করতে হবে। এই সংস্কার কমিটি হয়তো ভালো কিছু সংস্কার করবে। কিন্তু কেন কর বাড়াতে চাইছি, কত বাড়াতে চাইছি, কোন সময়ের মধ্যে চাইছি। অর্থাৎ ব্যবহারের জায়গা যদি ঠিক না হয়; তাহলে সব সংস্কার যা হবে এক বছরের মধ্যে তা ভেঙে পড়বে।

অনুষ্ঠানে এনবিআর সংস্কারে সরকার গঠিত পরামর্শক কমিটির সদস্য ও সাবেক এনবিআর চেয়ারম্যান নাসিরউদ্দিন আহমেদ বলেন, অর্থবিলের মাধ্যমে প্রতিবছর করনীতির নানা রকম পরিবর্তন হয়। কিন্তু এভাবে পরিবর্তন করা যাবে না। নীতির ধারাবাহিকতা রাখতে হবে। কমিটি এমন সুপারিশ করবে। আইসিএবির সভাপতি মারিয়া হাওলাদার বলেন, এখনই এনবিআরের সংস্কারের প্রকৃত সময়। ব্যবসায়ীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। ব্যবসা ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক কর ব্যবস্থা তৈরি করা দরকার। বিদেশিরা বিদ্যমান করনীতির ওপর ভিত্তি করে পরিকল্পনা করে থাকেন। যখন-তখন নীতি পরিবর্তন করা হলে তাঁরা হতাশ হন। রাজস্ব খাত সংস্কারে পরামর্শক কমিটির সদস্য ফরিদউদ্দিন আহমেদ বলেন, এনবিআরে এ পর্যন্ত যত সংস্কার হয়েছে, তাতে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সম্পৃক্ততা ছিল না। দাতা সংস্থা চেয়েছিল, রাজস্ব খাতের কার্যকারিতা বাড়ুক। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মইনুল খান বলেন, এনবিআরের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি তৈরি করতে হবে। একই সঙ্গে তাদের স্বাধীনতাও দিতে হবে।

** প্রশাসন ও নীতি উইং পৃথক করার সুপারিশ
** আয়কর, ভ্যাট ও কাস্টমস থেকে হবে ‘চেয়ারম্যান’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!