** বিআরটিএ’র ফির চেয়ে করের পরিমাণ পাঁচগুণ বেশি, ফলে সুযোগ দেওয়ার পরও মালিকরা মোটরযান ও ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়ন করছেন না
** খেলাপি মোটরযান মালিকদের চলতি অর্থবছর ও এর আগের বছরের কর পরিশোধের সুযোগ দিতে বিআরটিএ’র অনুরোধ, বাকি বকেয়া কর অফিস আদায় করবে
** ২০২৩-২৪ অর্থবছর মোটরযান কর ও ফি ২২১৪ কোটি এবং অগ্রিম কর, ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আদায় হয়েছে ২৫০৬ কোটি টাকা
মোটরযান বা মোটরগাড়ির কাগজপত্র হালনাগাদে বারবার জরিমানা মওকুফ করেছে সরকার। কিন্তু এতে সাড়া দিচ্ছে না গাড়ি মালিকরা। ফলে রাস্তায় প্রতিনিয়ত কাগজ মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। তবে কাগজপত্র হালনাগাদে জরিমানা মওকুফ করা হলেও করের ভার বা ভয়ে মালিকরা হালনাগাদ করছে না বলে মনে করে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় বলছে, সিসিভেদে একটি গাড়ির কাগজপত্র হালনাগাদ করতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষকে (বিআরটি) যে ফি দিতে হয়, তার প্রায় পাঁচগুণ দিতে হয় অগ্রিম কর। মালিকের একাধিক গাড়ি থাকলে দিতে হয় পরিবেশ সারচার্জ। অগ্রিম কর আর পরিবেশ সারচার্জ মিলে বিরাট অঙ্কের কর দিতে হয়।
ফলে বিআরটিএ এর জরিমানা মওকুফের সুযোগ দেওয়া হলেও করের ভয়ে মালিকরা কাগজপত্র হালনাগাদে উৎসাহ দেখাচ্ছেন না। এতে একদিকে বিআরটিএ তাদের ফি ও রাজস্ব (নন ট্যাক্স রেভিনিউ) পাচ্ছে না, অন্যদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) অগ্রিম আয়কর ও সারচার্জ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। মালিকদের সুযোগ দিতে মাত্র দুই বছরের (চলতি ও এর আগের অর্থবছর) অগ্রিম কর আদায়ের ব্যবস্থা করতে মন্ত্রণালয় থেকে সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) চিঠি দেওয়া হয়েছে। বাকি অর্থবছরসমূহের বকেয়া কর মোটরযান মালিকের রিটার্ন দাখিলের সময় আদায়ের ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করা হয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়েছে, বিআরটিএ প্রতিটি সেবার বিপরীতে মোটরযান কর ও ফি হিসেবে ‘নন ট্যাক্স রেভিনিউ’ খাতে উল্লেখযোগ্য রাজস্ব আদায় করে আসছে। এছাড়া প্রতিটি মোটরযানের বিপরীতে এনবিআর নির্ধারিত অগ্রিম আয়কর, ভ্যাট, পরিবেশ সারচার্জ ও সম্পূরক শুল্ক আদায় করে আসছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছর বিআরটিএ মোটরযান কর ও ফি হিসেবে ২ হাজার ২১৪ কোটি টাকা এবং এনবিআর নির্ধারিত কর হিসেবে ২ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা আদায় করেছে। বিআরটিএ’র সফটওয়্যারের মাধ্যমে এই দুই ধরনের ফি ও কর আদায় করা হয়। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছর থেকে একই সফটওয়্যারে এনবিআরের পরিবেশ সারচার্জ আদায় শুরু হয়েছে।
সড়ক মন্ত্রণালয় বলছে, প্রতিটি গাড়ির কাগজপত্র হালনাগাদ বা নবায়নে বিআরটিএ’র কর ও ফি’র চেয়ে এনবিআর নির্ধারিত কর প্রায় ৫ গুণ বেশি। যেমন—শেখ আসলাম (প্রতীকী নাম) নামের একজন ব্যক্তির একটি ১৫০০ সিসির গাড়ি রয়েছে। যদি এই গাড়ির কাগজপত্র নবায়ন করতে হয়, তখন তাকে বিআরটিএ’র ফি (ফিটনেস ফি ১৬০৫ টাকা ও সড়ক কর ৫৮০২ টাকা) হিসেবে সর্বমোট দিতে হয় ৭ হাজার ৪০৭ টাকা। সঙ্গে শেখ আসলামকে ওই গাড়িতে এনবিআর নির্ধারিত অগ্রিম কর দিতে হয় ২৫ হাজার টাকা। ফলে বিআরটিএ’র ফি ও এনবিআর নির্ধারিত অগ্রিম করসহ এই গাড়ি নবায়নে শেখ আসলামকে পরিশোধ করতে হয় ৩২ হাজার ৪০৭ টাকা।
আবার শেখ আসলাম এর ১৫০০ সিসির গাড়ির সঙ্গে যদি ২০০০ সিসির একটি জিপ থাকে, তাহলে কর পরিশোধ করা তার জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। কারণ একাধিক গাড়ি থাকলে পরিবেশ সারচার্জ দিতে হয়। শেখ আসলামের ১৫০০ সিসির সঙ্গে ২০০০ সিসির একটি জিপ রয়েছে। কাগজপত্র নবায়ন করার সময় আসলামকে বিআরটিএ’র ফি (প্রতিটির ফিটনেস ফি ১৬০৫ টাকা ও সড়ক কর ৫৮০২ টাকা) দিতে হবে মোট ১৪ হাজার ৮১৪ টাকা। সঙ্গে দুইটি গাড়িতে অগ্রিম কর এক লাখ টাকা ও পরিবেশ সারচার্জ এক লাখ ৫০ হাজার টাকাসহ মোট কর দিতে হয় এক লাখ ৬৪ হাজার ৮১৪ টাকা। অর্থাৎ শেখ আসলামকে দুইটি গাড়িতে বিআরটিএ এর ফি হিসেবে ৩২ হাজার ৪০৭ টাকা আর দুইটি গাড়ি থাকলে এনবিআর নির্ধারিত কর হিসেবে দিতে হচ্ছে এক লাখ ৬৪ হাজার ৮১৪ টাকা, যা বিআরটিএ’র ফি’র চেয়ে প্রায় ৫ গুণ বেশি।
একাধিক সূত্রমতে, সারাদেশে ফিটনেস বিহীন যানবাহনের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। এসব যানবাহনের কারণে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। পাশাপাশি এসব যানবাহন পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ করছে। আবার অনেক মোটরযানের মালিক বছরের পর বছর কাগজপত্র হালনাগাদ করে না। মূলত বিআরটিএ’র জরিমানা ও করের ভয়ে কাগজপত্র নবায়ন করেন না। ফিটনেস বিহীন গাড়ি বাতিল ও অন্যান্য মোটরযানের মালিকদের কাগজপত্র নবায়নে আগ্রহী করতে মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নেয়। পরে অর্থ মন্ত্রণালয়কে জরিমানা ব্যতীত মোটরযানের কাগজপত্র (ফিটনেস, ট্যাক্স টোকেন ও রুট পারমিট) ও ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়নের সুযোগ দিতে অনুরোধ জানানো হয়। অর্থ মন্ত্রণালয় সম্মতি দেওয়ার পর একাধিকবার বিআরটিএ মোটরযানের কাগজপত্র নবায়নের জন্য বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। কিন্তু মোটরযান মালিকরা আশানুরূপ সাড়া দেয়নি। এনবিআর নির্ধারিত করের কারণে সাড়া দেয়নি বলে মনে করে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। কারণ বিআরটিএ এর অনলাইন ব্যাংকিং সফটওয়্যারে মোটরযানের কর ও ফি জমা প্রদান করতে গেলে পূর্ববর্তী অর্থবছরের বকেয়া আয়কর পরিশোধ করতে হয়, যা আর্থিক বিবেচনায় বিআরটিএ-এর সেবামূল্যের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়—১৫০০ সিসির একটি গাড়ির মালিক যদি পাঁচ বছর কাগজপত্র নবায়ন না করেন, তাহলে নবায়নের সময় তাকে বিআরটিএ’র ফি ৭ হাজার ৪০৭ টাকা হিসেবে দিতে হবে ৩৭ হাজার ৩৫ টাকা। আর অগ্রিম কর হিসেবে দিতে হবে এক লাখ ২৫ হাজার টাকা। একই মালিকের একাধিক গাড়ি থাকলে বিপুল পরিমাণ সারচার্জ দিতে হবে। যেমন—৩৫০০ সিসির অধিক একটি গাড়ির অগ্রিম আয়কর দুই লাখ টাকা। একের অধিক গাড়ির ক্ষেত্রে সাড়ে তিন লাখ টাকা। অথচ এই গাড়িতে বিআরটিএ’র ফি মাত্র পাঁচ হাজার টাকা। আর অধিক সিসির গাড়ির ক্ষেত্রে বিআরটিএ এর ফি’র সঙ্গে এনবিআরের নির্ধারিত অগ্রিম কর ও সারচার্জের পার্থক্য অনেক বেশি।
এনবিআর সূত্রমতে, আয়কর আইন, ২০২৩ এর ধারা ১৫৩ অনুযায়ী গাড়ি নিবন্ধন ও ফিটনেস নবায়নের সময় আয়কর রিটার্ন জমার প্রাপ্তিস্বীকার (পিএসআর) জমা না দিলে অগ্রিম করের পরিমাণ দ্বিগুণ করা হয়েছে। যেমন—১৫০০ সিসির একটি গাড়িতে অগ্রিম কর ২৫ হাজার টাকা। তবে গাড়ি নিবন্ধন বা ফিটনেস নবায়নের সময় পিএসআর দিতে না পারলে জরিমানা দিতে হবে ৩৭ হাজার ৫০০ টাকা। আর একাধিক গাড়ির ক্ষেত্রে ৫৬ হাজার ২৫০ টাকা। একইসঙ্গে ৩৫০০ সিসির একটি গাড়িতে অগ্রিম কর দিতে হয় দুই লাখ টাকা। পিএসআর দিতে না পারলে জরিমানা দিতে হবে তিন লাখ টাকা। একাধিক গাড়ি থাকলে দিতে হবে চার লাখ ৫০ হাজার টাকা। একইভাবে সব গাড়ির নিবন্ধন ও ফিটনেস নবায়নের সময় পিএসআর দিতে না পারলে সিসিভেদে মোটা অংকের জরিমানা দিতে হয়। এই জরিমানার অনেক গাড়ি মালিক ফিটনেস নবায়ন করেন না।
অপরদিকে, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় ‘মোটরযান মালিকদের উৎসাহ’ এনবিআরের কাছে ‘দুই অর্থবছরের’ কর আদায়ের একটি প্রস্তাবনা দিয়েছে। বলা হয়েছে, খেলাপি মোটরযান মালিকদের কাগজপত্র নবায়নের ক্ষেত্রে যত বছরের বকেয়া থাকুক না কেন, কাগজপত্র নবায়নের সময় চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছর ও এর আগের এক বছরের (২০২৩-২৪) বকেয়া অগ্রিম কর আদায় করা যেতে পারে। বিআরটিএ’র সফটওয়্যারে এনবিআর এই দুই বছরের কর পরিশোধে এনবিআর সুযোগ প্রদান করলে বিপুল সংখ্যক মোটরযান মালিক কাগজপত্র নবায়ন করবেন। পূর্ববর্তী অর্থবছরসমূহের বকেয়া অগ্রিম আয়কর মোটরযান মালিকদের আয়কর রিটার্ন দাখিলের সময় আয়কর অফিস আদায়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। এছাড়া ইলেকট্রিক মোটরযানের পরিবেশ সারচার্জ মওকুফ করারও অনুরোধ জানানো হয়েছে।
এই বিষয়ে এনবিআরের কর বিভাগের একজন কর্মকর্তা বিজনেস বার্তাকে বলেন, কোনো পরিবহন মালিক একসঙ্গে পাঁচ বছরের কাগজপত্র নবায়ন করতে গেলে করের জন্য স্বাভাবিকভাবে অসুবিধায় পড়বেন। তবে তিনি প্রতি বছর কাগজপত্র নবায়ন করলে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। আর একসঙ্গে পাঁচ বছরের নবায়নের সময় দুই বছর (চলতি ও এর আগের বছর) কর নেয়ার সুযোগ নেই। কারণ পুরনো বকেয়া পরিশোধ না করলে এই সুবিধা দেয়ার এনবিআরের কোন সুযোগ নেই। এরপরও মন্ত্রণালয় যে চিঠি দিয়েছে, তা আমরা আলোচনা করে দেখবো। ইলেকট্রিক মোটরযানের উপর পরিবেশ সারচার্জের বিষয়ে আগামী বাজেটে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি।